বইপ্রেমীদের অপূর্ব মেলবন্ধনের বার্ষিক আয়োজন বইমেলা। বইমেলায় বড়-ছোট সব বয়সের মানুষের আনাগোনা দেখা যায়। কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বড়দের মতো শিশুদের জন্যও বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই মেলায় শিশুদের রঙবেরঙের বইয়ের পসরা থাকে। শিশুদের জন্য ‘শিশুচত্বর’ নামে আলাদা কর্নার থাকার পাশাপাশি তাদের জন্য থাকে বিনোদনের ব্যবস্থাও। যেমন সিসিমপুর। ছোটবেলা থেকে শিশুরা যদি বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাহলে বইয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। শিশুদের বইমেলা নিয়ে লিখেছেন মোহনা জাহ্নবী
শিশুদের জন্য বইমেলার গুরুত্ব
অনুপ্রেরণা
বইমেলায় শিশুরা তাদের পছন্দের লেখকদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। সেসব লেখকের খানিক সান্নিধ্য শিশুদের অনুপ্রেরণা দিতে পারে, যা শিশুর জীবনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
বইয়ের প্রতি আগ্রহ
বইমেলার আনন্দপূর্ণ ও ইতিবাচক পরিবেশ, রঙিন সব বই এবং লেখকদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ শিশুদের মনে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। শিশুকাল থেকেই এই আগ্রহ তৈরি করতে পারলে শিশুর পরবর্তী জীবনে তা খুব কার্যকর প্রভাব ফেলে।
প্রতিভার বিকাশ
বইমেলায় শিশুদের কুইজ প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে। এতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুরা যেমন তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারে, তেমনই তারা আনন্দও পায়।
মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা
বইমেলার আনন্দপূর্ণ পরিবেশ ও মজার মজার রঙিন বই শিশুদের কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়। এ ছাড়া বইমেলা তাদের মাতৃভাষাকে আরও বেশি ভালোবাসতে শেখায়।
ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধি
শিশুরা বইমেলায় গেলে বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়। আর যত বেশি বই পড়া হয়, তত বেশি নতুন নতুন শব্দ ও বাক্য শেখার সুযোগ তৈরি হয়, যা তাদের ভাষা দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
সামাজিকীকরণ
বইমেলায় অনেক শিশুর সমাগম ঘটে। ফলে শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পায়। এতে তাদের সামাজিকীকরণ ঘটে, মিলেমিশে থাকার শিক্ষা পায়। তারা আরও বন্ধুসুলভ হয়ে ওঠে। এমনকি অন্যদের সঙ্গে মেশার মাধ্যমে তারাও নতুন কিছু শিখতে পারে।
জ্ঞানের বিকাশ
বইমেলায় অনেক ধরনের বই থাকে। সেসব বই শিশুদের সাধারণ জ্ঞান বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বইয়ের নানা বিষয় দেখে শিশুদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয় বা জানার কৌতূহল তৈরি হয়। আর সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ও জানার মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। শিশুরা একইভাবে যেমন প্রশ্ন করতে শেখে, আবার উত্তরও জানতে পারে। বই পড়ার মাধ্যমে শিশুদের চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের মানসিক বিকাশ ঘটে।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা
বইমেলার সাজসজ্জা বা আয়োজনে প্রতি বছর বাংলাদেশের চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের চিত্রও তাতে ফুটে ওঠে। এমনকি বিভিন্ন বইয়েও দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। ফলে শিশুরা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করতে ও ভালোবাসতে শেখে। একই সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কেও ধারণা লাভ করে।
শিশুদের নিয়ে বইমেলায় গেলে
শিশুদের নিয়ে বইমেলায় গেলে কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন:
শিশুর পছন্দ
বই কেনার ক্ষেত্রে শিশুদের বয়স ও রুচি অনুযায়ী বই কিনুন। তাহলে তারা বই পড়তে আরও আগ্রহী হবে। শিশুদের সঙ্গে কথা বলে তাদের পছন্দ সম্পর্কে ধারণা নিন। নিজের পছন্দের বই পেলে তারা খুশিও হবে। শিশুদের খুশিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সতর্কতা
মেলায় সবসময়ই কমবেশি ভিড় থাকে। তাই দরকার বাড়তি সতর্কতা। সবসময় শিশুদের হাত ধরে রাখুন। অসতর্কতাবশত তারা যেন হারিয়ে না যায়।
ছুটির দিন এড়িয়ে চলুন
ছুটির দিনে বইমেলায় বেশি ভিড় থাকে। ভিড় বেশি হলে চলাচল করে যেমন শান্তি পাওয়া যায় না, তেমনই বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণও বেড়ে যায়। এত ভিড়ে শিশুদের অস্বস্তি হতে পারে, শরীর খারাপ হতে পারে। তাই ছুটির দিন ছাড়া অন্য যেকোনো দিনে তাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আর ছুটির দিনে গেলেও সকাল সকাল মেলা ঘুরে চলে আসুন। এমনকি যেদিনই মেলায় যান না কেন, বেশি রোদের সময় শিশুদের নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
সৃজনশীল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ
বইমেলায় আয়োজিত বিভিন্ন সৃজনশীল কার্যক্রমে শিশুদের অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করুন। এতে শিশুরা আনন্দ পাবে, তাদের মেধার বিকাশও ঘটবে।
খাবারে সচেতনতা
মেলায় বেশ কিছু খাবারের স্টল থাকে। তবে বেশিরভাগ খাবারই পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। শিশুর শরীর বড়দের তুলনায় নাজুক হয়ে থাকে। তাই সেসব খাবার অনেক ক্ষেত্রে বড়দের ওপর প্রভাব না ফেললেও শিশুর জন্য ক্ষতিকর। তাই তাদের ওসব খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত থাকাই ভালো। আর খাওয়ানোর প্রয়োজন হলেও খাবারের ধরন বুঝে ভেবেচিন্তে খাওয়ান। আর সবসময় সঙ্গে পানি রাখবেন। কিছুক্ষণ পরপর শিশুকে পানি খাওয়াবেন।
শিশুদের বইমেলায় নিয়ে যাওয়া তাদের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনই শিশুকে আনন্দময় সময় কাটাতেও সাহায্য করে। তাই অভিভাবকের অবশ্যই উচিত শিশুদের বইমেলায় নিয়ে যাওয়া। মনে রাখতে হবে, আজকের শিশুদের হাতেই আগামী দিনের পৃথিবী। তাই তাদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠা খুব প্রয়োজন। আর বইয়ের সংস্পর্শ ছাড়া কোনো শিশুই সুন্দর মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে না।

