পানি পাহাড়ের সান্নিধ্যে

বন্যা নাসরিন
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ১৪: ৫৪
আপডেট : ১৫ জুন ২০২৫, ১৪: ৫৯

সীমান্তবর্তী জেলা সিলেটে সারা বছরই কমবেশি পর্যটকের সমাগম থাকে। তবে বর্ষার সঙ্গে সিলেটের রূপবৈচিত্র্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই মৌসুমে ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা দলবেঁধে ছুটে আসেন প্রকৃতির অমৃত সুধা পান করতে।

রাজধানীর টিটিপাড়া থেকে রাত সাড়ে ১২টার বাসে উঠে বসলাম। গন্তব্য প্রকৃতির নিবিড় মায়ায় গড়া সিলেট জেলা। সংগত কারণে বাস ছাড়তে দেরি হলো এক ঘণ্টা। যাত্রাবিরতি ছিল রাজমনি হোটেলে। সেখানের বিফ খিচুড়ির স্বাদ বহু বছর মনে থাকার মতো। ফজর নামাজের বিরতি দেওয়া হলো হবিগঞ্জে। বাস থেকে নেমে হাইওয়ের পাশ দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম। দুপাশ জুড়ে ফসলের ক্ষেত। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কী যে কোমল সেই অনুভূতি! বিরতি শেষে বাস আবার চলতে শুরু করল।

বিজ্ঞাপন

সকালে সিলেটে নেমেই সবাই চা পান করলাম। তারপর শুরু হলো হোটেল খোঁজার পালা। কয়েকটি হোটেল ঘুরেফিরে, শেষমেষ সিটি লিংক হোটেলে উঠে গেলাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে, পোশাক বদলে, ব্যাগপত্র রেখে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। আবাসিক হোটেলের নিচেই খাবার হোটেল। তাই কষ্ট করে দূরে যেতে হলো না। দুদিনের জন্য পরিচিত এক প্রাইভেট কার রিজার্ভ করা হলো। সিলেটে আগত পর্যটকরা প্রাইভেট কার রিজার্ভ করলে আরাম করে ঘুরতে পারবেন।

যাই হোক, গাড়ি চলতে শুরু করল। গান ছেড়ে দিলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জাফলং। ততক্ষণে রোদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হেঁটে হেঁটে জাফলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। সংগ্রামপুঞ্জি জলপ্রপাতে গিয়ে সবাই নেমে পড়ল গোসলে। গোসল সেরে ওপরে আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। জাফলং থেকেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।

তারপর তামাবিল বর্ডারে গেলাম। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ গেট দেখলাম। গেটটা পেরোলেই অন্য একটা দেশ। কী অদ্ভুত! এরপর জৈন্তিয়া হিল রিসোর্টে গেলাম। জায়গাটাকে মিনি সুইজারল্যান্ড বললে ভুল হবে না। এত আশ্চর্য সুন্দর সবুজের আস্তরণ পায়ের নিচে, সামনে মেঘালয়ের পাহাড়, ঝরনা—সব মিলিয়ে অসাধারণ! সেখান থেকে চলে গেলাম জৈন্তিয়া রাজবাড়ির খোঁজে। রাজবাড়িটির এখন ভগ্নদশা; অথচ একসময় কত সমৃদ্ধ ছিল। হাতে সময় কম ছিল বলে সেখানে বেশিক্ষণ কাটাতে পারলাম না।

তখন শেষ বিকাল। সন্ধ্যা আসি-আসি করছে। ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে যেন স্বর্গে চলে এলাম। লালাখালকে দেখে তেমনই মনে হয়েছিল। সারা দিনের ক্লান্তি মুছে গিয়েছিল। আধা ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া করলাম। পাহাড় আর শান্ত জলের মাঝ দিয়ে চলতে থাকল আমাদের নৌকা। কিছুক্ষণের জন্য নৌকা থামিয়ে একটা চা বাগানে নামলাম। সন্ধ্যার আঁধার নামতে শুরু করেছে। আদিবাসীরা নিত্যদিনের কাজকর্ম সেরে ফিরে যাচ্ছিল ঘরে। কেউ কেউ লালাখালের পানিতে গোসল করছিল। এক অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছিল। এত সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ, অল্প সময়ে দেখে মন ভরবে না। তবু ফেরার পথ ধরতে হলো। নৌকা থেকে নেমে লালাখালেই সন্ধ্যার নাস্তা সেরে নিলাম। গরম গরম চা, পেঁয়াজু, পুরি ও শিঙাড়া তখন যেন অমৃত মনে হচ্ছিল ।

রাতের আঁধার কেটে আমাদের গাড়ি সিলেট শহরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। হজরত শাহপরান আর শাহজালালের মাজার দেখা মিস করলাম না। মাজার দেখা শেষে হোটেলে ফিরে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে আবার হোটেলের নিচে নামলাম। প্রায় সারা রাত চলল গল্প, গান আর আড্ডা।

পরদিন সকালবেলা আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। সিলেট এত বেশি সুন্দর যে, সেখানে যাত্রাপথে যা ল্যান্ডস্কেপ চোখে পড়ে সবই যেন দর্শনীয়। ভোলাগঞ্জে গাড়ি থেকে নেমে একটা নৌকা ভাড়া করলাম সাদা পাথরে যাওয়ার জন্য। প্রতি নৌকায় আটজন করে যাওয়া যায়। আমরা নয়জন ছিলাম। তাই অনুরোধ করে এক নৌকাতেই গেলাম। অপূর্ব সুন্দর ভোলাগঞ্জ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। পায়ের নিচে অসংখ্য সাদা পাথর, সামনে মেঘালয়ের বড় বড় পাহাড় আর চোখের সামনেই অনিন্দ্য সুন্দর পানির ধারা বয়ে যাচ্ছে। সবাই নেমে পড়লাম গোসলে। এত ঠান্ডা পানি, শরীর জুড়িয়ে যায় একেবারে। গোসল শেষে সেই একই নৌকায় আবার ফিরে এলাম। তারপর এক জায়গায় জনপ্রতি ২০ টাকা করে দিয়ে পোশাক বদলে নিলাম।

সেখানে বাহারি পণ্যের কিছু দোকান আছে। কেনাকাটা সেরে আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। পথের ধারে একটা খাবার হোটেলে গাড়ি থামল। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। সিলেটে আসার পর যত জায়গায় খেয়েছি, তার ভেতর সেই খাবারটাই সবচেয়ে ভালো মানের ছিল। এরপর আমরা চলে গেলাম রাতারগুলের উদ্দেশে।

রাতারগুলে যখন পৌঁছালাম তখন বিকাল হয়ে গেছে। জলাবনে ঘোরার জন্য নৌকা ভাড়া করলাম। রাতারগুল বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর জলাবন। পৃথিবীর সব সুন্দর আর নৈঃশব্দ্য যেন সেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত ঘুরে আবার ফেরার পথ ধরলাম।

সিলেট শহরে এসে গেলাম বইয়ের রাজ্য বাতিঘর দেখতে। সেখানে পরিচিত কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী এলো দেখা করতে। বাতিঘর থেকে চলে গেলাম ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজ দেখতে। কিন ব্রিজের নিচে সবাই গোল হয়ে বসলাম চেয়ার নিয়ে। জমে উঠল গানের আসর। রাত বাড়তে থাকল। একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। রাতের খাবার খেয়ে সাড়ে ১২টায় সবাই ফেরার বাস ধরলাম। ঢাকা ফিরলাম ভোরবেলায়। স্মৃতির ডায়রিতে জমা হলো সবুজ ছুঁয়ে থাকা রঙিন দিনের গল্প।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে আকাশপথ, সড়কপথ ও রেলপথে যেতে পারবেন সিলেটে। সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী, আবদুল্লাহপুর, ফকিরাপুল ও আরামবাগ থেকে ঢাকা টু সিলেট রুটে নিয়মিত এসি ও নন-এসি বাস চলাচল করে। নন-এসি বাসের ভাড়া ৫৫০ থেকে ৫৭০ এবং এসি বাসের ভাড়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা, কালনী এক্সপ্রেস ও উপবন এক্সপ্রেস চলাচল করে ঢাকা টু সিলেটের রেলপথে। ভাড়া ৩৭৫ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, নভো এয়ার ও ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসে যেতে পারেন আকাশপথে। সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে পরিবহন ভাড়ার তারতম্য হয় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে। আর সিলেট শহরে ঘোরার জন্য প্রাইভেট কার রিজার্ভ করতে পারেন। সাত সিটবিশিষ্ট একটা গাড়ি দিনপ্রতি ছয়-সাত হাজার টাকা নেবে।

কোথায় থাকবেন

সিলেট পর্যটন নগরী হওয়ায় সদরেই পর্যাপ্ত বাজেট হোটেল আছে। তাই আবাসিক ব্যবস্থা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।

সতর্কতা

বর্ষা মৌসুমে ভ্রমণ করলে সঙ্গে ছাতা রাখবেন। সাবধানে হাঁটাচলা করবেন। প্রয়োজনের চেয়ে দু-একটা বেশি জামাকাপড় সঙ্গে রাখবেন। স্থানীয় মানুষ কিংবা পর্যটকদের সঙ্গে আন্তরিক আচরণ করবেন। আর হ্যাঁ, সিলেটে নৌকাভাড়া একটু বেশি। তাই ঠিকমতো দরদাম করে নেবেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত