উন্নয়ন ও নারীর সামাজিক অবস্থান

দিল আফরোজ রিমা
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ১১
অঙ্কন : মুকুল রেজা

নারী ও পুরুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতায়ই সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। উভয়ের সহযোগিতায় আসে সমৃদ্ধি। সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। জাতীয় উন্নতির কাজ নারীকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সাহিত্য-বিজ্ঞানে নারীর অসামান্য অবদান রয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় নারী সমাজ পিছিয়ে নেই। দেশ বা জাতি গঠনে যদি নারীকে পেছনে ফেলে রাখা হয়, তবে সে জাতি কখনোই উন্নতি করতে পারবে না।

বিজ্ঞাপন

ঘর থেকে বাইরে এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। ঘর-সংসার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তথা সব ক্ষেত্রেই নারীরা অপরিসীম ভূমিকা রাখছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা অগ্রণী। পুরুষের পাশাপাশি সব কাজে, খেলাধুলায় নারীরা অংশগ্রহণ করছেন। নারীরা পর্বত জয় করেছেন।

জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর, নৌবাহিনীর মতো সশস্ত্র পদে কাজ করছেন নারীরা। শুধু সরকারি বা রাষ্ট্রীয় পদে নয়, নারীরা আজ সব ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর পরিচয় দিয়েছেন। সর্বশেষ বিজিএমইএ নির্বাচনে একজন নারীই প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শুরু হয়েছিল বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের হাত ধরে। তার দেখানো পথে হেঁটে আমরা যেটুকু করতে পেরেছি, তা নগণ্য নয়।

সমাজ-সংসারে ও বৃহত্তর সভ্যতা বিনির্মাণে নারী-পুরুষের সমান গুরুত্ব সম্যকভাবে বোঝাতে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত একটি গাড়ির দুটি চাকার ভূমিকার কথা বলেছিলেন। গাড়ির একটি চাকা যেমন বিকল হলে গাড়িটি চলার কোনো সামর্থ্য রাখে না, তেমনি নারীকে বাদ দিয়ে কিংবা তাকে পিছিয়ে রেখে কোনো দিন জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়।

দুঃখের বিষয়, সামাজিকভাবে নারীদের এখনো মনে করা হয় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। এখনো একজন কন্যাশিশুকে হতে হয় নানামুখী অবহেলা ও নিগ্রহের শিকার। সমাজে ধর্ষণ ও নির্যাতনের চিত্র আমাদের শঙ্কিত করে। ৯ মাসের কন্যাশিশুটিও ধর্ষণের নির্মমতা থেকে রেহাই পায় না। এসব ঘটনা নারীর ক্ষমতা বা উন্নয়নকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ব্যাহত করে, বাধাগ্রস্ত করে।

কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়—সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ আশাজাগানিয়া। তবে এই শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় কি? সিংহভাগ নারী আজ পোশাকশিল্পে শ্রম দিচ্ছেন। ২৫ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, নারী-পুরুষবৈষম্য, স্বীকৃতিবিহীন নারীশ্রম, পারিবারিক বোঝাপড়ার অভাব—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীশ্রমিকরা সর্বাধিক অবহেলিত।

নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।’ এ কথাটি কারো অজানা নেই। তবে তার ভেতরের সত্যাটা কী ভালো করে বুঝতে পারি?

মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথে, নারীমুক্তির পথে শিক্ষার বিকাশই একমাত্র উপায়। এ কথাও সবার জানা। তবু নারী সমাজের একটি বড় অংশ আজ লক্ষ্যহীন, সংসারের জালে আবদ্ধ, পাষণ্ড হাতের অত্যাচারে জর্জরিত, শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত, বাল্যবিয়ের শিকার, রক্ষণশীলতার আবদ্ধে আড়ষ্ট এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয়ে তলিয়ে যাচ্ছেন অন্ধকারের অতলে।

নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হয়েছে, হচ্ছে। তবে সংকট রয়েছে অনেক। রয়েছে নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও ন্যায্যতার সংকট, নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মর্যাদার প্রতি অবজ্ঞা, নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতা, নারীর প্রতি সামাজিক অসংগতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং চিত্রজগতেও নারীর অবমূল্যায়ন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অমর্যাদা ও নিরাপত্তাহীনতা, নারীর অর্থনৈতিক বঞ্চনা।

মানুষ যত শিক্ষিত বা সভ্য হচ্ছে, ততই যেন অসভ্যতা বেড়ে যাচ্ছে। সমাজে কিছু খারাপ রীতির মধ্যে যৌতুকপ্রথা বিশেষ অগ্রগণ্য। এই অমানবিক প্রথা মানুষকে অবমূল্যায়ন করছে। বৃদ্ধি করছে সামাজিক সমস্যা। নিয়ে আসছে মানব জীবনে দুঃখ-দুর্দশা। ধনীদের বেলায় এই প্রথা একটি শৌখিনতা বা বিলাসিতা। তবে দরিদ্রের জন্য এটি একটি অভিশাপ। ধনীরা ইচ্ছা করেই মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় বাড়ি-গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। ধনীদের দেখাদেখি সমাজে সর্বস্তরে যৌতুক বাধ্যতামূলক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সাধ্য থাক আর না থাক যৌতুক দিতেই হবে।

কঠোর আইন আছে, সমাজের ঘৃণাও আছে। তবু দুষ্টক্ষতের মতো যৌতুকপ্রথা সমাজ জীবনে নিরাময়ের অযোগ্য হয়ে আছে। যৌতুকের জন্য কত নিরপরাধ নারীর জীবন যে বিসর্জন দিতে হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যেন মেয়েরা পৃথিবীতে এক মহা-অভিশাপ মাথায় নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মই যেন তার আজন্ম পাপ। যৌতুকের পরিমাণ সন্তোষজনক না হলেই নিরপরাধ বধূকে অসহ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়। পরিত্যক্ত হতে হয়, এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়। আমাদের সমাজে অহরহ এরূপ গৃহবধূ স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির নির্যাতনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

যৌতুকের ভার যত বেশি, একজন মেয়ের সমাদরও তত বেশি, এমন একটা প্রত্যাশা বাবা-মাকে উদ্দীপ্ত করে। যৌতুকের পরিমাণের সঙ্গে পাত্রের যোগ্যতার সম্পর্কও বিদ্যমান। আবার মেয়ের যোগ্যতার অবলুপ্তির জন্য যৌতুক শূন্যস্থান পূরণে সহায়তা করে। যৌতুকের সুযোগ আছে বলেই উত্তম পাত্র ধরার ফাঁদ হিসেবে তা ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে। অধঃপতিত সমাজের বর বা বরপক্ষ মনে করে যৌতুক তার ন্যায্য পাওনা এবং স্বীকৃত শর্তের যদি একতিলও কম পড়ে, তাহলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। আর তার সর্বনাশা পরিণতি ভোগ করতে হয় নিরপরাধ বউটিকেই। ঘর ভাঙা তো অতি সাধারণ ব্যাপার।

মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে শিকার বউটির বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতাই থাকে না। যৌতুকের সর্বনাশা রীতিতে মানুষের মর্যাদা হারিয়ে মেয়েরা হয়ে যান কেনাবেচার বস্তু। আর মেয়েদের অক্ষম অসহায় বাবা-মা হয়ে পড়েন একজন নতজানু ব্যক্তি মাত্র। সব অত্যাচারের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক মানসিকতার পরিচয় দেয় বরপক্ষ। সমাজে নারীর অবমূল্যায়ন যৌতুকপ্রথার উৎপত্তির উৎস। কন্যাকালে পিতার, যৌবনে পতির আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীনরূপে নারীর মূল্য দেয় আমাদের সমাজ। বস্তুত উন্নত-অনুন্নত-উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সব দেশেই নারীরা কমবেশি বৈষম্যের শিকার। সে জন্য দরকার নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ইতিবাচক সচেতনতা সৃষ্টি।

নারী হলো সমাজ গড়ে তোলার স্থপতি। সমাজের নারী-পুরুষের বৈষম্য ও নারী নির্যাতন প্রতিকার করতে হলে দরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ। একদিকে আইনের পাকাপোক্ত শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিচারের প্রক্রিয়া দ্রুত করার মাধ্যমে সামাজিকভাবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে। সমাজ থেকে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূরীকরণের প্রয়োজনে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় হাত দেওয়া খুব দরকার। নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে কঠোর ও সক্রিয়ভাবে।

একাট যৌতুকমুক্ত সমাজ, বাল্যবিয়েমুক্ত দেশ এবং নারী নির্যাতনমুক্ত বিশ্ব এখন সময়ের দাবি। নারী সুরক্ষার বিষয়টি সমাজের এবং পুরুষের চেতনায়, ধারণায়, জ্ঞানে, বিশ্বাসে, কর্মে, জীবনচর্চায় স্থায়ী ও সুদৃঢ় করতে হবে। নারীর প্রতি ন্যায়বিচারের সঠিক আইনপ্রণয়ন ও প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বাবা বা স্বামী হিসেবে নিজ মেয়ে বা স্ত্রীর যথাযথ মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সব কাজে আইনের অনুগত থাকার চর্চা করতে হবে। নারী শিক্ষার অগ্রগতি, নারীর মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রধান হাতিয়ার নারীশিক্ষা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নারীর ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিকতার পরিবর্তন, মর্যাদাবোধের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

সবশেষ বেগম রোকেয়া যে গাড়ির দুটি চাকার কথা বলেছিলেন, সে কথা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই। সমাজ নামক গাড়ির যে দুটি চাকা, তা হলো পুরুষ ও নারী। আহ্বান করছি, সহকর্মী হিসেবে পুরুষরাও এগিয়ে আসুন নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সবাই সচেতন হই এবং সবাই সঠিক পথ অবলম্বন করি।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত