সুস্থ জীবনের জন্য চাই নারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ৩৮

নারীরা শুধুই একটি পরিবারের সদস্য নন—তারা পরিবারের প্রাণকেন্দ্র, সমাজের উন্নয়নের চালিকাশক্তি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নির্মাতা। একজন নারী সুস্থ থাকলে তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হয়। তবে বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের বহু নারী নিজের স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেন না। সংসারের কাজ, সন্তান লালন-পালন, কর্মজীবনের চাপ—সব সামলে তারা নিজের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার দিকে কম মনোযোগ দেন। এই অবহেলা থেকে জন্ম নেয় নানা জটিল রোগ, যা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ঠিক এই জায়গাতেই ‘নারীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র’ হয়ে উঠতে পারে সুস্থ জীবন ও সচেতনতার আলোকবর্তিকা।

বিশেষায়িত সেবা : নারীর জন্য নারীর যত্ন

বিজ্ঞাপন

নারীর শরীরের সমস্যা অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ যত্নের দাবি রাখে। প্রজনন স্বাস্থ্য, মাসিকজনিত জটিলতা, গর্ভাবস্থা ও প্রসব-পরবর্তী সমস্যা, মেনোপজ, স্তন ও জরায়ুর ক্যানসার—সব ক্ষেত্রেই নারীদের জন্য বিশেষ সেবা প্রয়োজন। প্রশিক্ষিত নারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা থাকলে রোগীরা স্বচ্ছন্দে নিজের কথা বলতে পারেন। এই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় আস্থা ও স্বস্তি এনে দেয়।

সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা

চিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনতা তৈরিই একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বড় দায়িত্ব। অনেক নারীই প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্য, কিংবা রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য জানেন না। নিয়মিত সেমিনার, স্বাস্থ্য শিক্ষা-বিষয়ক ক্লাস, কমিউনিটি ক্যাম্প ও ওয়ার্কশপের মাধ্যমে এসব জ্ঞান পৌঁছে দিলে তারা রোগ প্রতিরোধেও সক্রিয় হবেন।

গোপনীয়তা ও নিরাপদ পরিবেশ

আমাদের সমাজে অনেক নারী সামাজিক সংকোচ, লজ্জা বা পরিবারের বাধার কারণে চিকিৎসকের কাছে নিজের সমস্যা খোলাখুলি বলতে পারেন না। নারীদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যকেন্দ্র গোপনীয়তা ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, যা চিকিৎসা গ্রহণকে সহজ করে তোলে।

মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা

শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক সহিংসতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, কর্মক্ষেত্রের চাপ—এসব কারণে নারীরা প্রায়ই মানসিক চাপে ভোগেন। একজন মনোবিদ বা কাউন্সেলরের সাপোর্ট এবং সাপোর্ট গ্রুপের কার্যক্রম নারীদের মানসিকভাবে শক্তি জোগায়।

প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং, প্যাপ টেস্ট, টিকাদান, পুষ্টি পরামর্শ, যোগব্যায়াম ও ফিটনেস ক্লাস—এসব কার্যক্রম নারীর দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা নিশ্চিত করে।

গ্রামীণ নারীদের জন্য বিশেষ সেবা

গ্রামের নারীদের স্বাস্থ্যসেবা পেতে অনেক দূরে যেতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করলে তারা সহজে ও সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা পাবেন। মোবাইল মেডিকেল টিম ও টেলিমেডিসিন প্রযুক্তি যুক্ত করলে চিকিৎসা সুবিধা আরো প্রসারিত হবে।

কর্মজীবী নারীদের জন্য সময় ও সুবিধা

শহরে কর্মজীবী নারীরা ব্যস্ততার কারণে স্বাস্থ্য পরীক্ষা পিছিয়ে দেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যদি সাপ্তাহিক ছুটি, সন্ধ্যা বা অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা থাকে, তবে তারা সহজেই সময় বের করে সেবা নিতে পারবেন।

মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতক সেবা

গর্ভাবস্থা ও প্রসব-পরবর্তী সময় নারীর জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল ধাপ। মাতৃস্বাস্থ্য সেবা, নিরাপদ প্রসব, নবজাতকের টিকাদান ও স্তন্যপান পরামর্শ—এসব সেবা থাকলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমে আসবে।

পুষ্টি ও খাদ্য পরামর্শ

নারীদের জন্য বয়স, গর্ভাবস্থা, দুধপান করানো বা শারীরিক কাজের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন পুষ্টির চাহিদা থাকে। সঠিক খাদ্য পরিকল্পনা তাদের কর্মক্ষমতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

স্বাস্থ্য বিমা ও অর্থনৈতিক সহায়তা

স্বাস্থ্যসেবা অনেক নারীর জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য বিমা, কম খরচে চিকিৎসা প্যাকেজ ও অর্থনৈতিক সহায়তা ব্যবস্থা থাকলে তারা বিনা দ্বিধায় চিকিৎসা নিতে পারবেন।

নারীর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির প্রোগ্রাম

ফিটনেস ট্রেনিং, কর্মস্থলের স্বাস্থ্য পরামর্শ, ফিজিওথেরাপি সেশন এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম নারীর কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

জরুরি সেবা ও রেফারেল ব্যবস্থা

যদি জটিল রোগ বা দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে দ্রুত রেফারেল ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা জীবন রক্ষা করতে পারে। নারীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই সুবিধা থাকলে আস্থা আরো বাড়ে।

পরিশেষে বলা যায়, নারীর স্বাস্থ্য শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়—এটি জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি। তাই ‘নারীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা এবং তা সহজলভ্য করা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের যৌথ দায়িত্ব। কারণ সুস্থ, সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী নারীই পারে আগামী প্রজন্মকে সুস্থ, শিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলতে।

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক লেখক ও চিকিৎসক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত