মোমের আলো ছড়ান জেবা

ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ০৮

আধুনিক যুগে মোমের আলো আর প্রধান আলোর উৎস নয়, বরং এটি উৎসব কিংবা শৌখিনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাতের নিস্তব্ধতায় জ্বলে ওঠা মোমের শিখা যেন এক নীরব কবিতা। ইলেকট্রনিক্সের যুগে সুইচে এক চাপ দিলেই আজ ঘর ভরে যায় আলোয়, অথচ একসময় একটা দিয়াশলাইয়ের টানে পৃথিবী আলোকিত হতো। সেই বিলুপ্ত ঐতিহ্যকেই নতুন জীবন দিচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তা জেবা তাসিন—বৈচিত্র্যময় রঙ, সুগন্ধি ও ঝলমলে আলোর মায়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন মোমের নতুন জগৎ।

নিজের হাতে তৈরি আলোর ঝলকে

বিজ্ঞাপন

জেবা মোম তৈরির কাজটা শুরু করেছিলেন নিছক শখের বশে। আজ সেটাই তার পেশা, তার উদ্যোক্তা জীবনের সূচনা। ছোটবেলা থেকেই ঘর সাজাতে ভালোবাসতেন তিনি। ওয়ালম্যাট তৈরি, ক্রাফটিং, আঁকাআঁকি—এসব ছিল তার শখের কাজ। যেখানে যাকে কিছু তৈরি করতে দেখতেন, মনোযোগের সঙ্গে সেটি নিজের মধ্যে আয়ত্ত করার চেষ্টা করতেন সবসময়। সৃষ্টিশীলতার সেই ঝোঁকই তাকে একদিন মোমের দুনিয়ায় নিয়ে আসে।

বর্তমানে জেবা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার খরচ জোগাতে আগে টিউশনি করতেন, এমনকি চাকরিও করার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু ব্যবসা শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে ব্যবসার প্রতি ছিল তার আলাদা টান। অন্যের অধীনে কাজ করার মানসিকতা কখনো ছিল না; বরং নতুন কিছু সৃষ্টি করার মধ্যেই তিনি খুঁজে পান নিজের পরিচয়। মোম ছাড়াও নানা ধরনের আর্ট, ক্রাফটিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার সমান দক্ষতা রয়েছে। এমনকি আর্টের মাধ্যমেও তিনি একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছেন।

তবে তার ব্যবসার পেছনের গল্পটা একেবারেই আলাদা। ছোটবেলা থেকেই জেবার হাতের কাজের প্রতি ভালোবাসা ছিল। রঙ, গন্ধ আর আলো—এই তিনটির প্রতিই ছিল তার এক অদ্ভুত টান। প্রথমে ভেবেছিলেন, আর্ট আর ক্রাফটিং নিয়েই কিছু করবেন; যেমন নিজের হাতে বানানো কাস্টম আর্ট বিক্রি করা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তিনি বুঝলেন—যেহেতু তিনি পেশাদার শিল্পী নন, তাই এমন কিছু করতে হবে, যা মানুষকে শান্তি, ভালো লাগা আর সাজানোর আনন্দ দেয়। প্রথম দিকটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। নিজের পকেটের মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে একটি কোর্স করেন, সঙ্গে প্রায় তিন হাজার টাকার মতো জিনিসপত্র কিনে শুরু করেন ব্যবসা। জেবার মতে, ‘অনেকেই বলেন, ৫০০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে কোটিপতি হয়েছেন। আসলে কথাটা একদমই ভুল—কোটিপতি হতে হলে অবশ্যই মূলধন বিনিয়োগ করতে হবে, তা না হলে কখনোই মুনাফা আসবে না।’

নিজ উদ্যোগে পরে কাজ শেখা শুরু করেন। সরঞ্জাম জোগাড়, প্যাকেজিং, গ্রাহক খোঁজা—সবই ছিল কষ্টকর। তবে জেবা থেমে থাকেননি। তিনি বলেন, ‘যখন প্রথম অর্ডার পেলাম তখন মনে হয়েছিল, সব পরিশ্রম যেন সার্থক হয়ে গেল।’

জেবার ব্যবসা মূলত অনলাইননির্ভর। ‘লুমিনা ফ্রেম বাই তাসিন’ নামে তার একটি পেজ আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তিনি সেখান থেকেই মূলত ক্যান্ডেলসহ নিজের তৈরি নানা শৈল্পিক পণ্য বিক্রি করেন। পরবর্তী সময়ে জেবা বিভিন্ন মেলা ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও গ্রাহকদের সঙ্গে পরিচিতি বাড়াতে থাকেন এবং নিজের তৈরি পণ্যের প্রসার ঘটাতে থাকেন। এ বিষয়ে জেবা বলেন, মানুষ যখন আমার ক্যান্ডেল হাতে নিয়ে বলেন, ‘এটার গন্ধটা একদম মন ভালো করে দেয়’—তখন মনে হয়, আমি ঠিক পথেই আছি।

সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, জেবার পরিবার সবসময় তার পাশে থেকেছে। বিশেষ করে জেবার মা তাকে প্রতিটি কাজে উৎসাহ দিয়েছেন। মায়ের অনুপ্রেরণাই জেবাকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে।

জেবার লক্ষ্য হলো ভালো মানের সুগন্ধি, আকর্ষণীয় ডিজাইন, আর চিত্তাকর্ষক প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে তার ক্যান্ডেলগুলো আরো প্রফেশনালভাবে উপস্থাপন করা। মোমের তৈরি আরো অনেক নতুন আইটেমও তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থাপন করার ইচ্ছা পোষণ করেন। জেবার কাছে ক্যান্ডেল শুধু আলো নয়, এটা এক অনুভূতি। প্রতিটি ক্যান্ডেলের মধ্যে জেবা যেন তার পরিশ্রম, ভালোবাসা আর স্বপ্ন ঢেলে দেন। তার বিশ্বাস—‘আমার ক্যান্ডেল মানুষের ঘর যেমন আলোকিত করে, তেমনি মনও ছুঁয়ে যাক।’

তার মূল লক্ষ্য, একদিন ‘লুমিনা ফ্রেম বাই তাসিন’ এমন একটি নাম হবে, যেটি মানুষ শুধু সাজসজ্জার জন্য নয়—ভালোবাসা ও প্রশান্তির প্রতীক হিসেবেও মনে রাখবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত