ব্যর্থতা থেকেই মমতার সফলতা

তনিমা রহমান
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২: ২৭

প্রথম প্রচেষ্টায় খুব কম ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন, তবে বারবার ব্যর্থ হলেও কখনো ভেঙে পড়েননি। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবে বাবার উৎসাহে আর আল্লাহর রহমতে আজ তিনি পৌঁছে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে (এমএসইউ)। তিনি হলেন মমতা আক্তার।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালে এমএসইউ থেকে পূর্ণ আর্থিক সহায়তায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান তিনি। বর্তমানে জৈব রসায়নে (অরগানিক কেমিস্ট্রি) পিএইচডি করছেন এবং গ্র্যাজুয়েট টিচিং ও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও কাজ করছেন।

মমতার গবেষণা প্রাণঘাতী গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া, বিশেষত এন্টারোব্যাকটেরিয়াসি পরিবারকে দমন করার টেকসই ভ্যাকসিন উন্নয়ন নিয়ে। তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাকটেরিয়া রক্তনালী ও মূত্রনালী সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়া ওষুধ-প্রতিরোধী সংক্রমণের জন্য দায়ী। বিশেষ করে কার্বাপেনেম-রেজিস্ট্যান্ট এন্টারোব্যাকটেরিয়াসি (CRE) বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর সংকেত।’

করোনা ভাইরাস মহামারিই তাকে এই গবেষণায় অনুপ্রাণিত করেছে। টিকার বৈষম্যমূলক প্রাপ্তি দেখে তিনি মানবিক ও বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানমুখী গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। তার লক্ষ্য হলো একটি সর্বজনীন ও খরচসাশ্রয়ী ভ্যাকসিন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যা উন্নত দেশ থেকে শুরু করে সীমিত সম্পদসম্পন্ন অঞ্চলেও কার্যকর হবে। আগামী তিন বছরে গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশ এবং বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থাপন করতে চান মমতা। দীর্ঘ মেয়াদে তিনি সিডিসি, এনআইএইচ বা আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সংস্থায় একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতে চান, যাতে বহুমাত্রিক গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিয়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) মোকাবিলায় নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ভ্যাকসিন উন্নয়ন শুধু বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা নয়, এটি একটি মানবিক মিশন। ভবিষ্যতে এমন একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যা সমতা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে ভ্যাকসিন প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করবে।’

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সংক্রামক রোগের উচ্চহার ও সাশ্রয়ী চিকিৎসার প্রবল চাহিদার কারণে আমার গবেষণা এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটি ওষুধশিল্প, বায়োটেকনোলজি খাত ও জনস্বাস্থ্য নীতিনির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’ তিনি বিশ্বাস করেন, যে মেয়েটি ল্যাবের দিকে তাকিয়ে ভয়ে পিছিয়ে যায়, তাকে এগিয়ে নিতে একজন অন্য নারীরই দরকার হয়। তাই তিনি চান, সেই নারীটি যেন তিনি হতে পারেন।

মমতা আক্তারের জন্ম ময়মনসিংহ সদর উপজেলার রঘুরামপুর গ্রামে। ছোটবেলায় নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। ২০০৮ সালে ময়মনসিংহের লেতু মণ্ডল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০১০ সালে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে রসায়নে অনার্স এবং ২০১৮ সালে জৈব রসায়নে (অরগানিক কেমিস্ট্রি) মাস্টার্স শেষ করেন, আর সেখান থেকে সুদূর মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি। তার এই গল্প এক অনুপ্রেরণার যাত্রা।

মমতা বলেন, ‘যে গ্রামে কলেজে ওঠার আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, সেই গ্রামের মেয়ে হয়ে আমি এখন সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে।’

Momota-2

শিক্ষাজীবনে আর্থিক সংকট, ল্যাব ও লাইব্রেরির সীমাবদ্ধতা, ইন্টারনেটের অপ্রাপ্যতা—সবই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ‘লোডশেডিংয়ে পরিকল্পনামাফিক রুটিন মেনে পড়েছি। দিনের আলোতেই বাড়তি পড়াশোনা করেছি। ছোটবেলা থেকেই প্রাকৃতিক জগৎ ও বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহল ছিল।’

নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপসহ বেশ কিছু স্বীকৃতি পান তিনি। এমএস প্রোগ্রামে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ পান। ২০২২ সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সম্পূর্ণ তাদের অর্থায়নে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পান। ২০২৪ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-সুইডেন ট্রাস্ট ফান্ড ট্রাভেল গ্রান্ট ও মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইমার্জেন্সি ফেলোশিপ ফান্ডিং পান।

তিনি বলেন, ‘এমএসইউ’তে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।’

সম্প্রতি ‘দ্য জার্নাল অব প্যাথলজি রিসার্চ অ্যান্ড প্র্যাকটিস’-এ সহলেখক হিসেবে মমতার গবেষণা প্রকাশিত হয়। সেখানে ক্যানসারসংশ্লিষ্ট ফাইব্রোব্লাস্ট (CAFs), মস্তিষ্কে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়া এবং ওষুধ প্রতিরোধ ও সম্ভাব্য থেরাপি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সিএএফ হলো টিউমার মাইক্রোএনভায়রনমেন্টের অন্যতম প্রভাবশালী কোষীয় উপাদান, যা মেটাস্টেসিস, ইমিউন এভেশন এবং ওষুধ প্রতিরোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’ ‘মস্তিষ্কে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে উন্নত থেরাপিউটিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে,’ যোগ করেন তিনি।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেও মাত্র একটিতে অফার লেটার বা ভর্তির প্রস্তাব পান মমতা। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তখন যোগ দেননি। কিন্তু ২০২২ সালে আবারও আবেদন করেন আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকটি থেকে প্রস্তাব পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিকে বেছে নেন। তিনি বলেন, ‘আবেদন প্রক্রিয়ায় আমি নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে অধ্যাপক খুঁজে বের করেছি, তাদের ই-মেইল করেছি। জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে গবেষণা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং ও প্রফেসর ড. শুফেই হুয়াংয়ের গবেষণাকাজের সঙ্গে আমার আগ্রহের মিল থাকায় মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পূর্ণ আর্থিক তহবিলসহ পিএইচডি প্রস্তাব গ্রহণ করি।’

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশে ভর্তির আগে নির্ভরযোগ্য তথ্য না পাওয়ার কারণে বিভ্রান্ত হন। কনসালটেন্সির ওপর নির্ভর না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট দেখা, সিনিয়রদের পরামর্শ নেওয়া, ইংরেজি দক্ষতা ও সময় ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে চান বা বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা পিএইচডি করতে চান, তাদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘প্রথমেই পড়াশোনার বিষয় ও গবেষণার ক্ষেত্র নির্ধারণ করতে হবে। প্রস্তুতি নিয়ে ভাষাগত দক্ষতা সনদ (যেমন জিআরই, আইইএলটিএস, টোফেল ও ডুয়োলিঙ্গো ইংলিশ টেস্ট স্কোর, যেটা প্রযোজ্য) পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করার সময় শুধু র‌্যাংকিং নয়, অধ্যাপকদের গবেষণা আগ্রহের সঙ্গে নিজের আগ্রহ মেলাতে হবে। প্রয়োজনে তাদের গবেষণাপত্র পড়ে সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট ই-মেইল করা উচিত। এছাড়া আন্তর্জাতিক বৃত্তি, যেমন—ফুলব্রাইট স্কলারশিপ (যুক্তরাষ্ট্রের বৃত্তি), এরাসমাস মুন্ডুস (ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃত্তি), ডাড (জার্মান একাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস) প্রভৃতি সম্পর্কেও আগে খোঁজ নিতে হবে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞদের সহায়তা নিতে হবে।’ মমতা নিজেকে একজন গবেষণানির্ভর শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক নীতিনির্ধারণে অবদান রাখা পেশাজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত