লাভবার্ডে শম্পার স্বপ্ন জয়

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ২০

ছোটবেলা থেকেই তার পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা। ২০২০ সালে এক জোড়া বাজরিগার দিয়ে পোষা পাখি পালন শুরু করলেও এখন তিনি একজন সফল লাভবার্ড ব্রিডার। সম্প্রতি তিনি লাভবার্ড পাখি পোষার জন্য আন্তর্জাতিক বিচারকদের কাছ থেকে গোল্ড মেডেল জয় করেছেন। বছরে তিনি এক থেকে দেড় লাখ টাকার পাখি বিক্রি করেন। তিনি হলেন নাদিয়া শম্পা, দুই সন্তানের জননী। স্বামী-সন্তানসহ বাস করেন ঢাকার মুগদা এলাকায়।

২০২০ সালে এক জোড়া বাজরিগার পাখি দিয়ে তার পোষা পাখি পালন শুরু। এরপর ২০২১ সালে বাজরিগার পাখি বিক্রি করে দেন। তার মনে লাভবার্ডের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। অবশ্য তার লাভবার্ড সম্পর্কে আগে থেকেই কিছুটা জানাশোনা ছিল। লাভবার্ডের প্রেমময় জীবন, জীবিকা ও সংসার—সবকিছুতেই তাদের নামের সঙ্গে স্বভাবের বিস্ময়কর মিল রয়েছে। এই বিষয়গুলো শম্পাকে আকৃষ্ট করে।

বিজ্ঞাপন

তাই তিনি সে সময় ঈদের শপিংয়ের টাকা বাঁচিয়ে এক জোড়া লাভবার্ড কিনে আনেন। এরপর শুরু হয় শুধু সফলতার গল্প। তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একজন গৃহিণী হয়ে সংসার সামলানোর পাশাপাশি লাভবার্ডে তার সফলতা সবার নজর কেড়েছে। শুধু তাই নয়, তার পালিত লাভবার্ড ক্রয় করে অনেকে সফলতার দেখা পেয়েছেন।

lovebird

পাখি পালন করতে গিয়ে টুকটাক যে চ্যালেঞ্জগুলো আসে, শম্পা তা নিজেই সমাধান করেন। শম্পা বলেন, ‘ইউটিউবের ভিডিও দেখে পাখি পালনের নানা বিষয় শিখেছি। আর এখন কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু শিখছি।’ যদিও তার প্রিয় পরিবার প্রথমে পাখি পালন করাকে সমর্থন দেননি। বাড়িওয়ালা পাখির জন্য ঝামেলা করেছিল। কিন্তু অদম্য শম্পাকে এসব বাধা রুখতে পারেনি। শম্পা কেবল পাখি পোষেন না, তিনি একজন সংগঠকও।

তিনি ‘লাভবার্ড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ল্যাব)’-এ এক্সিকিউটিভ ফিমেল মেম্বার হিসেবে যুক্ত আছেন। এই সংগঠনের নানা আয়োজনে শম্পা কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। কিছুদিন আগে ল্যাব আয়োজিত ‘ন্যাশনাল লাভবার্ড চ্যাম্পিয়ন শো ২০২৫’-এ তার ডে গ্রিন অপালাইন গোল্ড সিরিজ গোল্ড মেডেল জয় করে। এই প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন পাকিস্তান থেকে আগত আন্তর্জাতিক পাখি বিশেষজ্ঞ আদনান সালিম। এর আগেও অন্য একটি প্রতিযোগিতায় তার পাখি সেরা নির্বাচিত হয়েছিল।

বর্তমানে শম্পার কাছে গ্রিন অপালাইন, প্যালফ্যালো ফিশার, অপালাইন, লুটিনো অপালাইন, পার ব্লু অপালাইন, ভায়োলেট অপালাইন, ডার্ক গ্রিন অপালাইন ইত্যাদি মিউটেশনের পাখি রয়েছে। তার সাত জোড়া ব্রিডিং পেয়ার আছে। বছরে তিনি দুই থেকে তিনবার ব্রিড করান। এতে ৩৫ থেকে ৪০টি বেবি পান। বারান্দায় খাঁচায় সাজানো তার পাখি দেখতে প্রায়ই পাখিপ্রেমীরা ছুটে আসেন।

নিজের হাতখরচ এবং শখ করে কাছের মানুষদের কিছু কিনে দেওয়ার জন্য তাকে আর কারো কাছে টাকা চাইতে হয় না। পাখি বিক্রির আয় থেকেই তিনি এসব করতে পারেন। তিনি জানান, বছরে এক থেকে দেড় লাখ টাকার পাখি বিক্রি হয়। যেহেতু বারান্দায় পাখি পালন করেন, তাই উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে কম। সব খরচ বাদ দিয়ে যে লাভ থাকে, তাতেই তিনি খুশি।

lovebird1

গৃহিণীরা অবসর সময়ে ঘরের কাজ শেষ করে বসে থাকেন অনেকেই। সেই সময়টুকুকে কাজে লাগিয়ে হতে পারে বাড়তি আয়ের সুন্দর একটি পথ—লাভবার্ড পালন। নাদিয়া শম্পার মতে, শুরুতে একটি নন-রিং লাভবার্ডের জোড়া দিয়েই শুরু করা সম্ভব। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা বাড়লে কয়েক জোড়া পাখি থেকে একটি ছোট আয়ের উৎস গড়ে তোলা যায়। শম্পা বলেন, ‘গৃহিণী কিংবা শিক্ষার্থী, যে কেউ চাইলে লাভবার্ড পালন করে হাতখরচের টাকা রোজগার করতে পারেন। প্রতিদিন বেশি ঝামেলাও নেই। সকালে খাবার ও পানি পরিবর্তন করতে হয়, সপ্তাহে তিন দিন সফটফুড ও এগফুড দিতে হয়। আর ব্রিডিংয়ের সময় প্রতিদিন সফটফুড ও এগফুড দিলেই চলে।’ লাভবার্ডের যত্ন তুলনামূলকভাবে সহজ হওয়ায় শখের পাশাপাশি এটি দ্রুতই একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎসে পরিণত হতে পারে।

নানা কারণে শখের পাখি মারা যেতে পারে। তবে অন্য সব পাখির তুলনায় লাভবার্ডের রোগবালাই তুলনামূলকভাবে অনেক কম, নেই বললেই চলে। তবুও শম্পা জানেন, পাখি হারানোর কষ্ট কতটা তীব্র হতে পারে। একবার তার বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বাবার সেবাযত্নে ব্যস্ত থাকার কারণে প্রিয় পাখিগুলোর দিকে ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারেননি। সেই অবহেলার ফাঁকেই একে একে মারা যায় অনেক বাজরিগার। খাঁচার ফাঁকা জায়গাগুলো যেন হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। ছোট ছোট ডানার ঝাপটানি থেমে গেল চিরতরে।

love3

প্রতিটি হারানো পাখির সঙ্গে যেন ভেঙে যাচ্ছিল শম্পার বুকের ভেতরটাও। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, প্রিয়জন হারানোর কষ্ট আর পাখি হারানোর কষ্টে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।’ তবে তার পালিত পাখি যখন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায়, কিংবা অন্যরা তার কাছ থেকে পাখি নিয়ে সফল হন, তখন তার খুব ভালো লাগে। লাভবার্ড নিয়ে কেউ সমস্যায় পড়লে তিনি সাহায্য করেন এবং নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ দেন।

পাখি নিয়ে শম্পার অনেক স্বপ্ন। তিনি এই সেক্টরে অনেক কাজ করতে চান। পাখি পালনকে আরো বড় পরিসরে নিয়ে যেতে চান। নানা মিউটেশনের পাখি দিয়ে নিজের ঘর আলোকিত করবেন—এমনটাই তার স্বপ্ন। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই শম্পা যে সফলতা দেখিয়েছেন, তাতে ভবিষ্যতে তিনি আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবেন বলে জানালেন এ সেক্টরের অভিজ্ঞরা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত