শিক্ষার্থীদের ঈদ আনন্দ

ফাহিম হাসনাত
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৫, ১৩: ১৩

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এবারের ঈদ কেটেছে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতায়—কেউ নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন ভার্চুয়াল আনন্দের সীমাবদ্ধতায়, কেউ মেতেছেন পারিবারিক উচ্ছ্বাসে, আবার কেউ ডুব দিয়েছেন গভীর আত্মত্যাগ ও আত্মজিজ্ঞাসায়।

বিজ্ঞাপন

মোবাইলের স্ক্রিনেই ঈদের আনন্দ

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান অর্পিতা এবারের ঈদকে দেখেছেন এক অদ্ভুত শূন্যতার মাঝে। তার মতে, একসময় ঈদ মানে ছিল প্রাণভরে হাসি, আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে মিলন আর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস; কিন্তু এখন ঈদের আনন্দ যেন ডিজিটাল পর্দায় বন্দী। নামাজের পরই ছবি তোলা, পোস্ট দেওয়া ও স্টোরি আপলোড করা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি আড্ডা না দিয়ে চ্যাটিং আর ভিডিও কলেই

কেটেছে অধিকাংশ সময়। এমনকি শিশুরা পর্যন্ত মোবাইল গেম আর ইউটিউবে ব্যস্ত। আত্মীয়দের বাড়িতে না গিয়ে ফোন কল আর মেসেজেই সীমাবদ্ধ থাকছে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অন্যরকম ঈদ

একই বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম সেফার জন্য এবারের ঈদ ছিল কিছুটা অন্যরকম। ছোটবেলা থেকেই তিনি ঈদের জন্য অপেক্ষা করেন এবং পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ভালোবাসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা ও অ্যাসাইনমেন্টের ব্যস্ততার পর ঈদের ছুটি ছিল এক প্রশান্তির পরশ। বাড়ি ফিরে কোরবানির প্রস্তুতি নেওয়া, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো এবং পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার মধ্য দিয়ে ঈদ খুব ভালো কেটেছে। ঈদের আগের রাতে ছোট ভাইবোনদের হাতে মেহেদি পরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়েই তার ঈদ শুরু হয়। কোরবানির মাংস বিতরণ করা, আম্মুকে রান্নার কাজে সাহায্য করা এবং বিকালে নতুন জামা পরে বেড়াতে যাওয়ার মাধ্যমে ঈদ শেষ হয়।

ত্যাগের আনন্দে আলোকিত

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত জান্নাত ঈশা অনুভব করেন, পশু জবাই করার মাধ্যমে তারা যেন নিজেদের ভেতরের লোভ, অহংকার ও স্বার্থপরতাকেও ত্যাগ করছেন। ঈদের দিন গরিব আত্মীয়দের বাড়িতে কোরবানির গোশত পৌঁছে দেওয়ার পর তাদের চোখে আনন্দ দেখে ঈশার ঈদ পূর্ণতা পায়। মায়ের ব্যস্ততা, ছোট ভাইবোনদের হাসি আর চালের রুটি দিয়ে গরম গরুর মাংস খাওয়ার আনন্দ—সব মিলিয়ে তার ঈদ ছিল পরিপূর্ণ।

অন্তরের আয়নায় ঈদ

লোকপ্রশাসন বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী তাহাসিনুল ইসলামের ঈদ কেটেছে এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসায়। তার কাছে ঈদুল আজহা শুধু উৎসবের বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি এক আত্মজিজ্ঞাসার দিন। ঈদের নামাজে ইমামের তাকবির শুনে তার মনে হয়েছে, ইব্রাহিম (আ.)-এর পরীক্ষা তাকে নতুন করে প্রশ্ন করছে, ‘আমি কি কিছু ত্যাগ করেছি? আমি কি কিছু আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত?’ কোরবানি করার সময় তিনি কেবল পশু জবাই করেননি, চেয়েছেন নিজের মনের পশুটিকেও ছুঁয়ে দেখতে—লোভ, রাগ ও অহংকার আদৌ কমেছে কি না। তিনি উপলব্ধি করেন, এটি এক চলমান প্রক্রিয়া, যা এক দিনে শেষ হয় না।

উৎসবে উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া

লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র হাবিবুল বাশার সুমন এবারের ঈদকে দেখেছেন আত্মতৃপ্তি ও আত্মপর্যালোচনার সুযোগ হিসেবে। ঈদের নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করেছেন, এই একটি দিনে যেন সব বিভাজন ভেঙে সবাই এক হয়ে যায়। কোরবানির সময় তিনি কেবল ধর্মীয় রীতি পালন করেননি, বরং নিজের ভেতরের পশুত্বকে ছিন্ন করার সংকল্প গ্রহণ করেছেন। কোরবানির মাংস বণ্টনের সময় সবার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় তিনি এক অন্যরকম আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন, যা শুধু গ্রহণে নয়, বরং দেওয়ার মাঝেই নিহিত থাকে।

শৈশবের ঈদ এখন তারুণ্যে যেমন

ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী রানা শৈশবের ঈদ আর তারুণ্যের ঈদের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন। শৈশবের ঈদ ছিল নির্মল চঞ্চলতা আর উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনায় ভরা এক বহুল প্রত্যাশিত দিন, যেখানে পোশাক কেনা থেকে শুরু করে সারা দিন ঘোরাঘুরি আর খেলনা দিয়ে খেলার আনন্দ ছিল। এখনকার শিশুদের মধ্যে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এই উচ্ছ্বাস কম দেখা যায়। সময়ের বিবর্তনে জীবন যান্ত্রিক হয়েছে, বেড়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্য, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও পড়ালেখার ব্যস্ততা। গ্রাম থেকে শহরে আসার পর বহু সংস্কৃতির মানুষের ভিড়ে মিশেছেন তিনি। এতকিছুর পরও বছরে এই দুটি ঈদে শহর থেকে গ্রামে প্রিয়জনদের কাছে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তার কাছে ঈদের প্রকৃত আনন্দ। এই বয়সে শৈশবের সেই চপলতা আর ছোট ছোট খুশি হারিয়ে গেছে। মেহেদী রানা মনে করেন, ঈদের আসল আনন্দ শিশুদেরই, তাই পরিবার ও আশেপাশে থাকা দরিদ্র শিশুসহ পথশিশুদের ঈদকে সুন্দর ও ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত