‘পুলিশ লোড করে দেয়, আর গুলি করে আ.লীগ সন্ত্রাসীরা’

ওয়াসিম সিদ্দিকী
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ১৪
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ১৫

শেখ হাসিনা ভারতে পলায়নের আগের দিন আওয়ামী বর্বরতার আরেকটি নজির দেখেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ চৌরাস্তায় অবস্থান নেওয়া ছাত্র-জনতা। গত বছরের ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের গুলিতে সে দিন ২৮ জন গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই আটজন নিহত হন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন সকাল ৮টা থেকে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ চৌরাস্তায় ছাত্র-জনতার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। চারদিকে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সশস্ত্র অবস্থান। এর মধ্যে কৌশলে একজন একজন করে বিক্ষিপ্তভাবে বসিলা চৌরাস্তায় উপস্থিত হতে থাকেন ছাত্র-জনতা। রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতা, রিকশাচালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ধীরে ধীরে উপস্থিত হতে থাকেন। সকাল ৯টা নাগাদ মোহাম্মদপুর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা মোড় লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

চৌরাস্তা থেকে আনুমানিক ১০০ মিটার দূরত্বে চারদিকের সড়কেই ব্যারিকেড দেয় ছাত্র-জনতা। বাঁশ, কাঠের অংশ, ইটসহ যা কিছু পাওয়া গেছে, তাই দিয়ে দেওয়া হয় ব্যারিকেড। সেখানে অবস্থান নিয়ে ছাত্র-জনতা নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ এক দফা দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে এলাকা।

এ সময় ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, ‘হাসিনার দুই গুণ, ধর্ষণ আর মানুষ খুন’ এসব নানা স্লোগান। আন্দোলনকারীদের মধ্যে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার সুমন আহম্মেদ বলেন, ‘মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডের দিক থেকে বেড়িবাঁধমুখী সড়কে পুলিশ র‍্যাবের সশস্ত্র টিম অবস্থান নেয়। সঙ্গে ছিল জলকামান, রায়ট কার, সাঁজোয়া যান (এপিসি)। মনে হচ্ছিল কথা বললেই যেন গুলি করবে।’

চৌরাস্তা দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ। চারদিকে থমথমে পরিস্থিতি। এর মধ্যেই দুপুর ১টার পর ছাত্র-জনতার সঙ্গে যোগ দেন মোহাম্মদপুর বাঁশবাড়ী এলাকার রহমানিয়া মাদরাসার ছাত্ররা। ৬ থেকে ৭ জন শিক্ষকের নেতৃত্বে কয়েকশ’ ছাত্র সেখানে মিছিল নিয়ে যোগ দেয়। মাদরাসাটি শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব প্রতিষ্ঠা করেন। বেলা যত বাড়তে থাকে; আশপাশের দোকানদার ও মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিতে থাকেন।

বেলা তিনটার দিকে খবর আসে, জাপান গার্ডেন সিটির সামনে দিয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন হেলমেট পরা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চৌরাস্তার দিকে আসছে। এ খবর প্রচারের পর ছাত্র-জনতার মাঝে উত্তেজনা তৈরি হয়। মনে হলো সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। সাড়ে ৩টার দিকে বাঁশবাড়ী এলাকা দিয়ে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আসতে থাকে। চৌরাস্তা থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সড়কে থাকা ফুটওভার ব্রিজের ওপরে আগে থেকেই অনেকে অবস্থান করছিলেন।

স্থানীয় ওয়ার্কশপের মালিক শরিফ জানান, ‘বেলা সাড়ে ৩টার পর হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। আমি তখন চৌরাস্তায় ছিলাম। একপর্যায়ে জানতে পারি হানাদার আওয়ামী বাহিনী হেলমেট পরে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করছে। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা একপর্যায়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। প্রতিরোধের মুখে পড়লে হেলমেট বাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে নিয়ে সাউন্ড গ্রেনেডের পাশাপাশি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করছিল।’

ঘটনাস্থলে সকাল ৮টা থেকেই উপস্থিত ছিলেন ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা ডা. তৌফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সকাল থেকে আমার সঙ্গে অটোরিকশা চালক কিশোর সাদ্দাম ও তার বন্ধু শিপন যোগ দেয়। দুপুর ১টার দিকে একজন ভাই আমাদের জন্য দুটি রিকশায় করে কাঠের লাঠি নিয়ে আসেন। লাঠিগুলো অমসৃণ হওয়ায় সাদ্দাম ও শিপন নিজেদের উদ্যোগে ইট দিয়ে ধরার জায়গাটা (হাতল) মসৃণ বানায়।

তৌফিকুল ইসলাম বলেন, বিকাল সাড়ে চারটার দিকে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হেলমেট বাহিনী গুলি শুরু করে দিয়েছিল। তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে আমাদের গুলি করছিল। পাশাপাশি তাদের কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি চালাতে থাকে। ওভার ব্রিজ থেকে নিচে নামতে নামতেই কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন।

বিস্ময় প্রকাশ করে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আশ্চর্যজনক বিষয় ছিল র‌্যাব-পুলিশ সেখানে তাদের অস্ত্রশস্ত্র হেলমেট বাহিনীর কাছে দিয়ে তারা নিজেরা নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে পরিস্থিতি দেখছে। সরকারি অস্ত্র দিয়ে গুলি চালাচ্ছে, রাবার বুলেট মারছে, টিয়ারশেল ছুড়ছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সশস্ত্র গুণ্ডারা। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো পুলিশ গুলি লোড করে দিচ্ছে; আর গুলি করছে হেলমেট বাহিনী।’

একদিকে পুলিশি মদত পাওয়া আওয়ামী সশস্ত্র ক্যাডাররা হেলমেট মাথায় দিয়ে গুলি করছে, আর নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা এদিক থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছে। চিকিৎসক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাদ্দাম আর শিপনসহ বেশ কয়েকজন দুরন্ত কিশোর-তরুণ সবাই গুলি উপেক্ষ করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। গুলির বিপরীতে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পাল্টা জবাব দিতে দিতে এভাবে দুঃসাহসিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। পেছন থেকে বড়রা তাদের ডাকলেও ছুটে চলছিলেন তারা। একপর্যায়ে গুলি খেয়ে দুজন রাস্তার ওপরেই পড়ে যায়। আমরা কয়েকজন সামনে এগিয়ে গিয়ে তাদের দুজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাই।’

সাদ্দামের কপালে দুটি গুলি লাগে। গুলি কপাল দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। অন্যদিকে শিপনের বাম কান দিয়ে গুলি ঢুকে ডান কান দিয়ে বের হয়ে গেছে। তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় ধরাধরি করে দ্রুত শিকদার মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন সহযোদ্ধারা। পরে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন দুই কিশোর। এ কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন মধ্যবয়সি এই চিকিৎসক।

চিকিৎসক তৌফিকুল ইসলাম আরো বললেন, ‘সাদ্দাম ও শিপন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা পেছনে চলে আসি। একপর্যায়ে হেলমেটধারীরা মনে করেছিল পিছু হটে আমরা নতুনভাবে আক্রমণ করব। সম্ভবত এই কারণে তারা সেখান থেকে পিছু হটে। কিন্তু এরই মধ্যে আমাদের ২৮ জন ভাই গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন অন্তত ১০ জন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের মতো নিরাপদে বিচ্ছিন্নভাবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ এড়িয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয় সবাইকে। আর আহতদের স্থানীয় হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার জন্য আলাদাভাবে ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সামান্য আহতদের আশপাশের ক্লিনিকগুলোতে সুবিধাজনকভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত