চার দফা মেনে নিতে সরকারকে আলটিমেটাম

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৬: ৫০
ছবি: সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক কঠোর বার্তা দেন। তারা স্পষ্ট করেন, চলমান আন্দোলনের মূল আট দফা দাবির মধ্যে চার দফাকে ‘জরুরি দাবি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই চার দফা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনো আলোচনায় তারা অংশ নেবেন না। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা সরকারের কাছে দৃঢ় সংকেত দিয়েছিলেন যে, তাদের ধৈর্য সীমিত এবং বৈষম্য দূরীকরণে বাস্তব পরিবর্তন ছাড়া আন্দোলন থামানো সম্ভব নয়।

তারা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে এই চার দফা পূরণের জন্য আরো দুদিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। জরুরি চার দফার মধ্যে ছিল ইন্টারনেট সংযোগ পুনরায় চালু, কারফিউ প্রত্যাহার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাম্পাস থেকে সরিয়ে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা।

বিজ্ঞাপন

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদ ১৮ জুলাই থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। আসিফের বাবা মো. বিল্লাল হোসেন ছেলের সন্ধানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করেও কোনো সুরাহা পাননি।

সেদিন সমন্বয়করা আরো বলেন, চার দফা দাবি পূরণ না হলে তারা আট দফার দাবিও প্রত্যাহার করবেন না এবং আন্দোলন আরো বিস্তৃত ও তীব্র হবে। সমন্বয়ক সারজিস আলম সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, ‘সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবে না।’

আন্দোলনের আট দফায় অন্তর্ভুক্ত ছিল নিহতদের বিচারের দাবি, ক্ষতিপূরণ ও তাদের পরিবারের জন্য চাকরির নিশ্চয়তা, ছাত্র সংসদ চালু, মামলা প্রত্যাহার এবং শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হয়রানি থেকে সুরক্ষা।

সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সেদিন বলেন, ‘সরকারের প্রজ্ঞাপন সংলাপ ছাড়া জারি করা হয়েছে, যা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। কোটা-সংক্রান্ত স্পষ্ট ব্যাখ্যার দাবি রয়েছে।’

হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চলছিল গণগ্রেপ্তার

আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৃশংসতায় ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশজুড়ে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে হয় তিন শতাধিক, যদিও প্রকৃত সংখ্যা ছিল আরো বেশি। অনেককে গুম করেছিল পুলিশ। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। হৃদয় চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। একই দিন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ পোশাকশ্রমিক শুভ শীলসহ আরো দুজনের মৃত্যু হয়। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার দিন থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছিল।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন নিহত-আহতদের সংখ্যার সঠিক হিসাবের প্রয়োজনীয়তা ও বিচার দাবিতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানান।

এদিকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তিন হাজারের বেশি বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিএমপি তখন জানিয়েছিল, এসব গ্রেপ্তারের অধিকাংশই বিএনপি, জামায়াত ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সদস্য।

কারফিউ শিথিল, অফিস ও কারখানা খোলা শুরু

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ কয়েকটি অঞ্চলে সাত ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি অফিস খোলা শুরু হয় বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত।

রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোও সীমিত পরিসরে চালু হয়। সীমিত ব্যাংকিং কার্যক্রমও শুরু হয়, যেখানে নির্দিষ্ট কিছু শাখা সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা ছিল। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল বন্ধ রাখা হয়।

১১ বছরের সামিরের মৃত্যু ঘিরে জনমনে শোক ও ক্ষোভ

মিরপুরের একটি বাসায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ১১ বছরের শিশু সাফকাত সামির। সে কোনো আন্দোলনে যোগ দেয়নি; কেবল জানালায় দাঁড়িয়ে বাতাস নিচ্ছিল।

তার বাবা সাকিবুর রহমান সেদিন গণমাধ্যমকে জানান, ‘ঘরেও নিরাপদ না থাকলে কোথায় যাব?’ তিনি স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সমালোচনা করেন নিরাপত্তাহীনতার জন্য।

দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রকাশকরা কোটা আন্দোলনের সহিংসতা এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তারা বলেন, সংঘর্ষের সময় অনেক সাংবাদিক আহত বা নিহত হয়েছেন; অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় তথ্য যাচাই বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।

সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বে এক সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ১৬ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের কঠোর নিপীড়ন ও সহিংসতা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। সাধারণ জনগণের ওপর জুলুমের মাত্রা বাড়ার ফলে সরকারের প্রতি দরদ ও আস্থা ধীরে ধীরে তলানিতে চলে যায়। শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, গ্রেপ্তার এবং কারফিউর মাধ্যমে দমন-পীড়ন চালায়। ফলে তা দেশব্যাপী অসন্তোষ ও প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গকে আরো তীব্র করে তুলেছিল।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত