ডিবি থেকে মুক্ত ছয় ছাত্রনেতা, নিহতদের স্মরণ করে প্রতিরোধের বার্তা

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৪: ৪৯

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হেফাজতে থাকা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় ছাত্রনেতাকে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট (৩২ জুলাই) ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কেউ ছয়দিন, কেউ পাঁচদিন আবার কেউ চারদিন ডিবি হেফাজতে ছিলেন। সেদিন দুপুর দেড়টার দিকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে তাদের নিজ নিজ বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

সমন্বয়কদের পরিবার জানায়, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের এক কক্ষে দীর্ঘ সময় ছিলেন এবং সবাই ৩২ ঘণ্টা টানা অনশনে ছিলেন। নাহিদের মা মমতাজ নাহার সেদিন গণমাধ্যমে বলেন, তার ছেলে আগে থেকেই অসুস্থ ছিল, এখন বাসায় রেখে চিকিৎসা চলছে। নুসরাত তাবাসসুমকে আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল। তিনি ৩২ ঘণ্টা অনশনে ছিলেন। পুলিশের পক্ষ থেকে অনশনের বিষয়ে তখন কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞাপন

মুক্তির পর সারজিস আলম ছয় সমন্বয়কের পক্ষে ফেসবুকে লিখেছিলেনÑ‘ছয়দিন ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা যায় কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে আটকানো সম্ভব নয়। যতদিন জুলুম চলবে, ততদিন আন্দোলন চলবে।’ এই স্ট্যাটাস লেখার কিছুক্ষণ পরই তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অকার্যকর হয়ে যায়।

গত বছরের ১৯ জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁও থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়। একদিন পর গুরুতর আহতাবস্থায় পূর্বাচলে ফেলে দেওয়া হয়। আসিফ ও বাকেরকেও একই ভাবে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পাঁচদিন পর চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এরপর তারা গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচিতে স্মরণ, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ

এদিকে ১ আগস্ট দেশের অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরীতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচির মাধ্যমে নিহত ও আহতদের স্মরণে গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াল লিখন, চিত্রাঙ্কন ও প্রতিবাদী স্লোগান অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আইনজীবী ও অভিভাবকরা এসব কর্মসূচিতে অংশ নেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মিছিল করেন। জাহাঙ্গীরনগর ও সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের বাধা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যান। ময়মনসিংহ, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় পুলিশের বাধা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির মধ্যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন অনেক জায়গায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নতুন কর্মসূচি হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জুমার নামাজ শেষে দোয়া ও গণমিছিলের আহ্বান জানানো হয়। আন্দোলনকারীরা বলেন, এ কর্মসূচি স্মরণ নয়, এটি একটি প্রতিরোধের বার্তা।

প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ আগস্ট কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে চান তিনি। প্রয়োজনে জাতিসংঘ বা অন্য দেশের বিশেষজ্ঞ তদন্তকারী পাঠানোর জন্য রাজি আছেন।

তিনি জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে এ সহিংসতার পেছনে দায়ী করে বলেন, তারা কোটা আন্দোলনের নামে নিজেদের সন্ত্রাস চালিয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছে, যারা তদন্ত করছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা দেশের উন্নয়ন চায় না, তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি গাজা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থী দমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, বাংলাদেশ সরকার এমন পথ অনুসরণ করছে না।

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ, কার্যকর হলো সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রজ্ঞাপন

সরকার ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ করে। এ নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী জামায়াত-শিবির ও তাদের অঙ্গসংগঠন আর কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত কোটা আন্দোলনের সময় সহিংসতায় জামায়াত-শিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপরাধের প্রমাণসহ সাম্প্রতিক সহিংসতায় তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য সরকার হাতে পেয়েছে।

তৎকালীন আইনমন্ত্রী জানান, যারা নতুন করে দলগত রাজনীতি করবে, তাদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যাওয়ার চেষ্টা আটকানো হবে।

নিহতদের ৭৮ শতাংশের শরীরে প্রাণঘাতী ক্ষত

কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় তৎকালীন সরকারের হিসাবে ১ আগস্ট পর্যন্ত ২১২ জন নিহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। যদিও নিহতের সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি ছিল। আহত প্রায় ছয় হাজার ৭০০ জনের মধ্যে ২৩১ জন গুলিবিদ্ধ, অনেকের চোখে ছররা গুলি লাগে, কয়েকজনের পা কেটে ফেলতে হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তখন এক বিবৃতিতে বলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভ দমনকালে বেআইনিভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে।

জাতিসংঘ বাংলাদেশে সহিংসতা ও গুলির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সংস্থাটির মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছিলেন, বাংলাদেশে গুলির দৃশ্য নিন্দনীয় এবং সরকারের প্রতি জনগণের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত