ষাট দশকে আহমদ ছফার (১৯৪৩-২০০১) সাহিত্যকর্মের সূচনা (১৯৬৭) ঘটলেও তার সাহিত্যিক চিন্তার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল মূলত স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের জনমানুষের প্রত্যয় ও প্রত্যাশাকে আশ্রয় করেই তার সাহিত্যসম্ভার প্রস্ফুটিত হয়েছিল। মূলত একটি বৃহৎ পরিসর থেকে জনজীবন ও জগৎকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। তার সাহিত্যচিন্তার পরিধি বৃহৎ হলেও তার সাহিত্যিক ভাব ও ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই দেশ, দেশের মাটি ও মানুষ। মূলত সামষ্টিক মানুষের জীবনধারাকে তিনি একটি মানবিক রূপ ও রেখায় রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন। সহস্র বর্ষের বাঙালির যাপিত জীবনধারা ও জনপদকে তিনি সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেছিলেন। সেই অনুভবের বয়ান ও বিন্যাসে তার সাহিত্যকর্ম বহুবিধ শিল্পশাখায় পল্লবিত হয়ে উঠেছিল।
বস্তুত বিপুল মানসিক শক্তি ও শিল্পসামর্থ্য নিয়েই আহমদ ছফা এই বাংলায় এসেছিলেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তিনি জনশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তি ও সাহিত্যিক জীবনে আহমদ ছফা ছিলেন আপসহীন। অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল সুদৃঢ়।
সত্য ও সুন্দরের পক্ষে, ন্যায় ও ন্যায্যতার পক্ষে এবং মানুষ ও মানবতার পক্ষে আহমদ ছফার অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর বুদ্ধিজীবীর সমালোচনা করায় একজন বুদ্ধিজীবী হয়েও আহমদ ছফা বুদ্ধিজীবী সমাজে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলেন। আদতে, প্রকৃত লেখকের বন্ধু থাকে না। সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে মূলত তিনি নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎ ও সাহসী শিল্পীসত্তায় রূপান্তর করতে পেরেছিলেন। খণ্ডকালীন নয়, তিনি ছিলেন পূর্ণকালীন শিল্পী।
এক
মূলত মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই আহমদ ছফার সাহিত্যচিন্তার শৈল্পিক স্ফুরণ ঘটেছিল। আহমদ ছফার কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল মহাসিন্ধুর কল্লোল ধ্বনির মতো। উনিশ শতকের মতো একাত্তরের মধ্যেও আহমদ ছফা রেনেসাঁর বীজ দেখতে পেয়েছিলেন; দেখতে পেয়েছিলেন পশ্চিমা ধাঁচের মতো নবজাগরণের সমূহ সম্ভাবনা। জাগ্রত বাংলাদেশসহ (১৯৭১) সমুদয় সাহিত্যকর্মের পাতায় পাতায় আহমদ ছফা সেই স্বপ্ন ও সাধনার বীজই বপন করে গিয়েছিলেন। এই বীজ থেকেই তিনি একটি মহিরুহ প্রত্যাশা করেছিলেন; প্রত্যাশা করেছিলেন পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সমতার ভিত্তিতে শাসন-শোষণমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্রের। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নিদারুণ বাস্তবতায় আহমদ ছফা হতাশ হয়েছিলেন। সংবিধানে সমাজতন্ত্র সংযুক্ত হলেও বৃহত্তর জনজীবনে তা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জন্য আহমদ ছফা সমসাময়িক রাজনৈতিক দীনতা ও দোদুল্যমানতাকেই দায়ী করেন। সমাজতন্ত্রের স্লোগানের অন্তরালে তিনি পুঁজিবাদের কালো ও কুৎসিত থাবা দেখতে পেয়েছিলেন। মুখে ও মিছিলে সমাজতন্ত্রের স্লোগান উচ্চারিত হলেও এদের অন্তরে ছিল পুঁজিবাদের প্রতি অন্তহীন বিশ্বাস ও ভালোবাসা। দেশটা তাই দ্রুত পুঁজিবাদের দিকেই ধাবিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে তুরস্ক সমুদয় বদ্ধমত উড়িয়ে দিয়ে একটি উদার ও আধুনিক রাষ্ট্ররূপে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশকে নিয়েও আহমদ ছফার অনুরূপ স্বপ্ন ও সাধনা ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্যে রূপান্তরিত না হওয়ার জন্য আহমদ ছফা ধর্মীয় নিরপেক্ষতার অন্তরালে লুক্কায়িত সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প এবং প্রগতির অন্তরালের লুক্কায়িত সুবিধাবাদী চিন্তাকেই দায়ী করেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আহমদ ছফা আগুনের ছবির সঙ্গে তুলনা করেছেন। আগুনের ছবি যেমন প্রকৃত আগুন নয়, এদেশের গণতন্ত্রও তেমনি প্রকৃত ও পরিশুদ্ধ গণতন্ত্র নয়। আহমদ ছফার বিবেচনায় সমসাময়িক গণতন্ত্র মূলত ছদ্মবেশী স্বৈরতন্ত্র। গণতন্ত্রের অন্তরালে লুক্কায়িত স্বৈরাচারী স্বভাবই জনমনে গণতান্ত্রিক বোধ ও ভাবনা জাগিয়ে তুলার পক্ষে বড় অন্তরায়।
দুই
জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলনে গণমানুষের অবদান ও অংশগ্রহণ সর্বোচ্চ হলেও গণমানুষ সবসময়ই বঞ্চিত হয়। সুবিধাবাদী স্বার্থপর উচ্চবিত্ত ও বিদ্বানেরা সবসময় সুযোগ-সুবিধার সর্বাগ্রে অবস্থান করে। বাস্তবে গায়ে কাদাজল মেখে কাদাজল মাখা জনমানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতার বড় অভাব। সেই অভাব পূরণের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। মূলত সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশ ও জাতিগত উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। জাতিগত সামষ্টিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য চাই যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির সহ-অবস্থান। কিন্তু এটি নিদারুণ সত্য, এই দেশে শিক্ষায় অগ্রগতি হয়নি বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষায়। মূলত বাঙালি মুসলমানের পিছিয়ে পরার অন্যতম কারণ তার বিজ্ঞানহীনতা। প্রায় ৮০০ বছর মুসলমানরা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য পরিচালনা করে। এসময় নেতৃত্বে মুসলমানেরা থাকলেও বাঙালি মুসলমান ছিল না। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান সর্বপ্রথম একটি নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পায়। নেতৃত্ব পেলেও বাঙালি মুসলমান অতীতের মোহমায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালিরা এত রক্ত, এত জীবন দিলেও আজও উচ্চশিক্ষায় আধুনিক বাংলা পরিভাষা তৈরি করতে পারেনি। এই না পারার জন্য আহমদ ছফা বাংলা ভাষার দুর্বলতা নয়, বাঙালির ঔপনিবেশিক মানসিকতাকেই দায়ী করেন।
তিন
আহমদ ছফা ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান। সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হননি তিনি, সমসাময়িক প্রচলিত প্রচল স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি; বরং সময়কেই সমাজের উপযোগী করে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, রাজনীতিকেও সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিকে একটি গণতান্ত্রিক পথ ও পদ্ধতিতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন; ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন; মানুষকে ভালোবেসে হানাহানিমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ জীবন ও জনরাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। আহমদ ছফা মূলত একটি স্বপ্ন ও সাধনার নাম; একটি সাহসী শিল্পীসত্তার নাম। এই শিল্পীসত্তা শাসনশোষণমুক্ত একটি উদার গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আহমদ ছফার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেবল দুঠোঁটের বুলি ছিল না, এটি হৃদয়ের গভীরতর তলদেশ থেকে উৎসারিত এক মানবিক চেতনার শিল্পময় প্রকাশ ও প্রত্যয়। এই প্রত্যয় ও প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির বিপুল ব্যবধানে তিনি ক্ষিপ্ত হতেন। আহমদ ছফার গল্প, কবিতা, উপন্যাস-আখ্যান থেকে শুরু করে প্রবন্ধ-নিবন্ধ পর্যন্ত সাহিত্যের প্রায় সর্বত্র, প্রায় সব শাখাপ্রশাখায় আহমদ ছফা ওই স্বপ্ন ও সাধনার বীজই বপন করে গিয়েছেন।
চার
জীবন ও জনপদের নিদারুণ বাস্তবতা দিয়েই আহমদ ছফা তার সাহিত্যের ভান্ডার সাজিয়েছিলেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তিনি সমসাময়িক সময় ও সমাজের দিকে তাকিয়েছিলেন, তাকিয়েছিলেন মানুষ ও মানবতার দিকে। জনজীবনের দুঃখকষ্টকে তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন। আলো ঝলমলে শহর রাজধানীতে বসে সাহিত্য সাধনা করলেও আহমদ ছফার সাহিত্যকর্ম গ্রামীণ জীবন ও জনপদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিল্প হয়ে ফুটে উঠত। এই দেশের মানুষজন, পশুপাখি, তরুলতা, বৃক্ষরাজি ইত্যাকার উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ প্রাণবান সত্তার সঙ্গে তিনি নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। কোনো বিচ্ছিন্নতা কিংবা একাকিত্ব অনুভব করেননি তিনি। সমুদয় সত্তার সঙ্গে তিনি সুগভীর আত্মীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং সবার মুক্তি কামনা করেছিলেন। আহমদ ছফা তার এই সাহিত্যিক জীবনে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বিশেষ করে ‘মহাযান পন্থা’ দ্বারা। আহমদ ছফা নিজেকে নিয়ে খুব একটা ভাবতেন বলে মনে হয় না; তিনি ভাবতেন দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে। আহমদ ছফার এই সামষ্টিক ভাবনার চূড়ান্ত রূপ ও রেখা দেখা যায় পুষ্পবৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) উপন্যাসে। ‘সকলে আমার মধ্যে আছে’Ñ সামষ্টিক এই উপলব্ধি ও অনুভব করার মতো মহামানব কেবল বর্তমানে নয়, পূর্বকালেও খুব একটা দেখা যায়নি। সুখী-সমৃদ্ধ একটি মানবিক সমাজ ও উন্নত জাতিরাষ্ট্র গঠনে আজকের এই বাংলাদেশে আহমদ ছফার এই জীবনদর্শন নিঃসন্দেহে জরুরি।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

