বিদায় গণবুদ্ধিজীবিতার প্রতীক

রেজাউল করিম রনি
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯: ৩৫

বাংলাদেশের বিরলপ্রজ পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল বদরুদ্দীন উমর। সম্ভবত একমাত্র প্রতিনিধি। গত ৭ সেপ্টেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ৯৪ বছরের এক বিপুল কর্মময় জীবন তিনি রেখে গেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় নজির রেখে গেছেন- নিজের বিশ্বাস ও সততার সঙ্গে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা। এটা আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

গণবুদ্ধিজীবিতা নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত আছে। বুদ্ধিজীবী পরিচয়ে রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির নির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক লেখালেখি ও মতভিন্নতা আছে। বিরাট তত্ত্বকথা বাদ দিয়েও পাবলিক বুদ্ধিজীবী চেনার একটা উপায় আমপাবলিকের মতন সে বাজারে যায় কি না, সুপারশপে না। গরিব মানুষের দেশে ধনী হলেও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সবসময় সুপারশপে গিয়ে বাজার করলে বুঝতে হবে, আপনি যা বলেন তা মিন করেন না।

বিজ্ঞাপন

সাধারণ মানুষের বাজারে না গিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে কেউ এলিট বুদ্ধিজীবী হতে পারে, কিন্তু পাবলিক বুদ্ধিজীবী অন্য জিনিস। উমর ভাই বাজার করতেন। বহু দিন বাজারে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। ফুটপাতে কলা কিনেছেন বা মাছের দরদাম করছেন। এখন বুদ্ধিজীবীরা বাজারে যান না, এম্বাসিতে ঘুরঘুর করেন। ফাইভ স্টারে খেতে পারলে ধন্য হন। এই মানসিক ফকিরির দেশে উমর ভাই পাবলিক বুদ্ধিজীবীর শেষ প্রতিনিধি। বাকিরা হয় প্রতিষ্ঠানের গোলাম, দলের দাস, না হয় এনজিওবাজ। তারা নিজেদের সুবিধাবাদী পজিশন জাস্টিফাই করেন নানা ছুতায়। বুদ্ধিজীবিতার বেসিক সূত্রও অনেকে জানেন না।

সক্রেটিস অনেক সন্ধান শেষে বলেছিলেন, সদ্‌গুণই জ্ঞান; আলাদা করে জ্ঞান বলে কিছু নেই। জ্ঞান যদি আপনাকে সদ্‌গুণের অধিকারী না করতে পারে, তাহলে সেই জ্ঞানের আদৌ জ্ঞান হিসেবে ফাংশন করার লেজিটিমেসি তৈরি হয় না। কিন্তু একদল বিকারগ্রস্ত কবি-সাহিত্যিক নিজেদের পারভারশনকে স্বাধীনতা মনে করেন। যেকোনো নৈতিক পজিশনকে আন্ডারমাইন্ড করে দিন দিন গণবিরোধী হয়ে ওঠেন বুদ্ধিজীবিতার নামে। কবে শিল্প-সাহিত্য কোন দার্শনিক চর্চায় না থেকেও বুদ্ধিজীবিতা হয়, হতে পারে? এদিক থেকে উমর ভাই ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি সাহিত্যিকগিরি করেননি; ইতিহাস, রাজনীতি ও দর্শনচর্চাই করেছেন। যদিও সেটা মার্কসবাদী দর্শন। কিন্তু তেমন কোন ডাইমেনশন ছিল না তাতে। তার কাজ নিয়ে ভবিষ্যতে কথা হবে, চর্চা হবে।

বিপুল কাজ আমাদের জন্য রেখে তিনি চলে গেলেন। যে কোন বিদায় কষ্টের। তবে তিনি সৌভাগ্যবান হাসিনার পতন দেখে যেতে পেরেছেন। অনেকে তা পারেননি; যেমন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তিনিও আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। উমর ভাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী বিজয়ী হিসেবে হাসিনার পতন দেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমরা তাকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেয়েছি। হাসিনার আমলে এটা সম্ভব হতো না। তার পরও এই শোক অনেক দিন আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।

তিনি সারা জীবন ফ্যাসিবাদবিরোধী ছিলেন। ফ্যাসিবাদ-বিষয়ক তার লেখার সংখ্যা অনেক। সেসব লেখা থেকে ফ্যাসিবাদ বিষয়ে যে লাইনগুলো বিশেষভাবে স্মরণীয় তার কয়েকটি ‘আওয়ামী লীগ ও তার ফ্যাসিস্ট সরকার মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে’, ‘মিথ্যার প্রচার ফ্যাসিবাদের এক অপরিহার্য এবং অপরিত্যাজ্য দিক’, ‘এখানে আছে মিথ্যা প্রচারের এক পরিকল্পিত ও সংগঠিত ব্যবস্থা’ এবং ‘ফ্যাসিবাদী মিথ্যার এক অসাধারণ ক্ষেত্র হলো ইতিহাস’।

তার চিন্তার ঠিক বিপরীত মেরুর মানুষ আমি। কিন্তু তার সত্যনিষ্ঠার জন্য ভিন্নতা সত্ত্বেও তাকে পছন্দ করি। তিনিও আমাকে বেশ স্নেহ করতেন।

উমর ভাই যাপন করেছেন অনেস্ট জীবন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রশ্নে সবসময় ছিলেন সোচ্চার। ভারতের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা করেছেন। যদিও ক্যালকেশিয়ান সাহিত্য ঐতিহ্যের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তার। তিনি ছিলেন প্রগতিবাদী মানুষ। কিন্তু দিল্লির যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। উমরের এই সাহসী চৈতন্য বাংলাদেশে অমর হোক।

২.

আমি অনেক দিন উমর ভাইয়ের পাশের বাসায় ছিলাম। আমার বারান্দা দিয়ে তার জানালা দেখা যেত। তখন থেকে একটা মজার সম্পর্ক তার সঙ্গে। তখন মনে হয় ঢাকা কলেজে পড়ি। বিকাল হলেই তার বাসায় চলে যেতাম। তিনি খুব রাগ করতেন; বলতেন, কতবার বলেছি, আগে কল করে আসবে? তুমি কোনোদিন কল দিয়ে আস না, হুট করে চলে আস।

আমি ইচ্ছে করেই এটা করতাম এবং পরে এটাই স্বাভাবিক হয়ে যেত। উমর ভাইয়ের চিন্তার বেশির ভাগ জায়গাই আমি নেই না। তার দার্শনিক পজিশন নিয়ে আমার ক্রিটিক আছে। আমি তার মতো ‘ঈমানদার’ মার্কসিস্টও নই। তবু তার আপসহীন ভূমিকা ও সৎ চিন্তার সাহস দেখে অনেক শিখেছি। তার কাছ থেকে অনেক বইপত্র আনতাম একসময়। বেশ কিছু ইনটারভিউও করেছি।

সিম্পল লিভিং এবং হাই থিংকিং এটা ছিল উমর ভাইয়ের শক্তি ও সৌন্দর্য। এজন্যও তাকে ভালোবাসি। সব মিলে উমর ভাই আমার দাদার বয়সি হওয়ার পরেও ছিলেন ভাই। এই আনন্দ-হাসি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক চিরজয়ী স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে।

মৃত্যুর পরে আমি তাকে দেখতে যাইনি। তার হাসিমাখা মুখের স্মৃতি সরে গিয়ে নিথর চেহারার ইমেজ মনে থাকুক, তা চাইনি। জীবনকে এত সিম্পল ও সহজভাবে যাপন করা যায়, এটা তিনি দেখিয়েছেন। মৃত্যুকেও তিনি খুব সহজে নিতেন; বলতেন, ‘অনেক তো বয়স হলো। এখন যেকোনো দিন—আই কিক দ্য বাকেট। চলে যাব। কোনো আক্ষেপ নেই। যে ধরনের কাজ করতে চেয়েছি, সে ধরনের জীবনযাপন করেছি।’

সততা জীবনকে পূর্ণতা দেয়। উমর ভাই সেই পূর্ণতা পেয়েছেন; কিন্তু তার না থাকার অপূর্ণতা পূরণ হওয়া কঠিন।

মাওলানা মুহিবুল্লাহ মাদানি নিখোঁজ, সন্দেহের তীর ইসকনের দিকে

সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন তালুকদারের মৃত্যুতে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের শোক

রাবাদার রেকর্ডে স্বস্তিতে প্রোটিয়ারা

যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় ট্রাম্প-বিরোধী বিক্ষোভ নিয়ে খামেনির উপহাস

হোয়াইট হাউসে বলরুম নিয়ে রহস্য, নির্মাণে টাকা দিচ্ছে কারা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত