আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

‘হোয়াই নেশনস ফেইল’

আহমাদ সাব্বির

‘হোয়াই নেশনস ফেইল’

‘হোয়াই নেশনস ফেইল’ গ্রন্থে দারোন অ্যাসেমোগলু ও জেমস এ. রবিনসন পুরোনো গল্পকেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন। নিওলিথিক বিপ্লব থেকে শুরু করে আধুনিক বিশ্বের আরব বসন্ত পর্যন্ত মানব ইতিহাসের দীর্ঘ সময়জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানা সভ্যতা, রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার উত্থান-পতনের ব্যাখ্যা তারা দিয়েছেন একটি কেন্দ্রীয় তত্ত্বের মাধ্যমে। কেন কিছু সমাজ ভেঙে পড়ে, কেন কিছু রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায় এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানই এ বইয়ের মূল লক্ষ্য।

লেখকদ্বয়ের মূল তত্ত্বটি দাঁড়িয়ে আছে ‘প্রতিষ্ঠান’ ধারণার ওপর। কোনো সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই নির্ধারণ করে সে সমাজ কীভাবে পরিচালিত হবে, কার হাতে ক্ষমতা থাকবে এবং সম্পদ কীভাবে বণ্টিত হবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকেই লেখকদ্বয় দুই ভাগে ভাগ করেছেন ইনক্লুসিভ ইনস্টিটিউশন এবং এক্সট্রাকটিভ ইনস্টিটিউশন।

বিজ্ঞাপন

ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠান বলতে বোঝানো হয়েছে এমন রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে ক্ষমতা কেবল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না থেকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিস্তৃত থাকে। এখানে নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, আইন সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হয় এবং বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকেই জন্ম নেয় ইনক্লুসিভ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। অর্থনৈতিকভাবে ইনক্লুসিভ ব্যবস্থা হলো এমন এক মুক্তবাজারভিত্তিক কাঠামো, যেখানে সবাই সমান সুযোগ পায়, নিজের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে পারে এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষিত থাকে।

এ ধরনের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সুযোগ। নতুন প্রযুক্তি পুরোনো ব্যবস্থাকে সরিয়ে দেয়, যাকে লেখকদ্বয় বলেছেন ক্রিয়েটিভ ডিস্ট্রাকশন। ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থান করে একটি ভার্চুয়াস সার্কেল তৈরি করে, যা অর্থনীতিকে সচল রাখে, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে এবং সমাজব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী ও স্থিতিশীল করে তোলে।

এর বিপরীতে রয়েছে এক্সট্রাকটিভ ইনস্টিটিউশন। এ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা থাকে গুটিকয়েক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে। তারা নিজেদের স্বার্থে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ব্যবহার করে সম্পদ আহরণ ও শোষণের কাজে। এখানে অর্থনীতি থাকে বন্দি, মানুষের মৌলিক অধিকার উপেক্ষিত হয় এবং সাধারণ মানুষ ক্রমাগত শোষণের শিকার হয়। এর ফলে তৈরি হয় এক ভার্চুয়াস সার্কেল, যেখানে দারিদ্র্য বাড়তে থাকে, অর্থনীতি দুর্বল হয় আর ক্ষমতাসীনদের সম্পদের পাহাড় ক্রমেই উঁচু হতে থাকে।

এক্সট্রাকটিভ সমাজব্যবস্থা এক ধরনের ডিস্টোপিয়ান বাস্তবতা তৈরি করে, যার চরম রূপ আমরা জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে দেখতে পাই। যেহেতু এ ব্যবস্থায় ক্ষমতা সীমিত কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তাই অন্য গোষ্ঠীগুলো সে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। এখান থেকেই জন্ম নেয় সংঘাত, গৃহযুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা।

প্রশ্ন উঠতেই পারেÑযদি ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠানই উন্নতির মূল চাবিকাঠি হয়, তাহলে সব দেশ কেন এ পথে হাঁটে না? লেখকদ্বয়ের উত্তর স্পষ্টÑকোনো দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপথ পূর্বনির্ধারিত নয়। এটি নির্ভর করে ইতিহাসের নির্দিষ্ট কিছু সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্র কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু বা প্রাকৃতিক সম্পদ এক্ষেত্রে নির্ধারক নয়।

এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ইউরোপের ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ মহামারি। ওই মহামারিতে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা মারা যায়, যা শতাব্দীপ্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়। শ্রমিক সংকটের কারণে সামন্তপ্রভুরা আগের মতো নিপীড়ন চালাতে পারেননি। এতে সমাজের নিচু স্তরের মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে, শুরু হয় জমি ও ক্ষমতার পুনর্বণ্টন। ব্রিটেনে এ প্রক্রিয়া সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং এর ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠান। এ পরিবর্তনের চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখি ১৬৮৮ সালের গ্লোরিয়াস রেভিল্যুশনে, যেখানে রাজক্ষমতা সীমিত হয়ে পার্লামেন্টের হাতে যায়। যদিও এ পরিবর্তন ধীরে ধীরে এসেছে, তবুও এটি ব্রিটেনকে শিল্প বিপ্লবের পথে এগিয়ে নিতে মূল ভূমিকা পালন করে।

একই ভাবে ফরাসি বিপ্লব ইউরোপের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। অভিজাত ও সামন্ত শ্রেণির একচেটিয়া ক্ষমতা ভেঙে দিয়ে ওই বিপ্লব ইউরোপজুড়ে পরিবর্তনের ঢেউ তোলে। যদিও জ্যাকবিনদের শাসনামলে ‘রেইন অব টেরর’ দেখা যায়, তবুও সামন্ততন্ত্রের পতনের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠানের বীজ রোপিত হয়। বিপরীতে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অভাব শিল্প বিপ্লবের সুফল গ্রহণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

উত্তর ও লাতিন আমেরিকার পার্থক্যও এ তত্ত্বকে শক্তিশালী করে। লাতিন আমেরিকায় ইনকা সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এক্সট্রাকটিভ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ছিল, যা স্প্যানিশ উপনিবেশকারীরা আরো শক্তিশালী করে তোলে। স্বাধীনতার পরও শোষণমূলক এ কাঠামো ভাঙতে না পারায় অঞ্চলটি দারিদ্র্য ও অস্থিতিশীলতার চক্রে আবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকায় শক্তিশালী এক্সট্রাকটিভ প্রতিষ্ঠান না থাকায় এবং জনসংখ্যা কম হওয়ায় তুলনামূলকভাবে ইনক্লুসিভ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যদিও দক্ষিণাঞ্চলে দাসপ্রথা ও বর্ণবাদ দীর্ঘদিন এক্সট্রাকটিভ কাঠামো টিকিয়ে রেখেছিল, পরে নাগরিক অধিকার আন্দোলন সে বৈষম্য ভাঙতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

লেখকদ্বয় আফ্রিকার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠানের অভাব কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, কঙ্গো বা জিম্বাবুয়ের মতো দেশে কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অভাব, কখনো আবার সীমাহীন দুর্নীতি রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে তুলেছে। বিশেষ করে জিম্বাবুয়েতে মুগাবের শাসন দেখিয়েছে কীভাবে শক্তিশালী কিন্তু শোষণমূলক রাষ্ট্র অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

তবে এক্সট্রাকটিভ ব্যবস্থায় যে কখনো উন্নতি হয় না, এমন নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মাও সে তুং-এর চীন তার উদাহরণ। জোরপূর্বক শ্রম ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটলেও দুর্ভিক্ষ, দমন-পীড়ন ও প্রযুক্তিগত স্থবিরতা শেষ পর্যন্ত এ রাষ্ট্রগুলোর পতন ডেকে আনে।

লেখকদ্বয় বারবার জোর দিয়েছেন ইতিহাসের অনিশ্চয়তার ওপর। রোমান রিপাবলিক থেকে সাম্রাজ্যে রূপান্তর কিংবা জার্মানির নাৎসিবাদের উত্থান দেখায়Ñইনক্লুসিভ ব্যবস্থা কীভাবে ধীরে ধীরে এক্সট্রাকটিভ হয়ে উঠতে পারে। আবার দক্ষিণ কোরিয়া, চীন বা বতসোয়ানার মতো দেশ দেখায়Ñমন্দ সার্কেল ভেঙে ভালো লোকদের সার্কেল গড়াও সম্ভব।

বইটি পাঠককে নিজের দেশ নিয়েও ভাবতে বাধ্য করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু সন্ধিক্ষণ এলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান কখনোই প্রকৃত অর্থে ইনক্লুসিভ হয়ে উঠতে পারেনি। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থেকেছে সীমিত গোষ্ঠীর হাতে, দুর্নীতি কমেনি, গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগ স্বাধীনতা পায়নি। ফলে সর্বাত্মক বিপর্যয় না এলেও স্থায়ী সমৃদ্ধির পথও তৈরি হয়নি।

সব মিলিয়ে ‘হোয়াই নেশনস ফেইল’ মানবসভ্যতার উত্থান-পতনের একটি গভীর, যুক্তিনির্ভর ও চিন্তাজাগানিয়া ব্যাখ্যা প্রদান করে, যা পাঠককে অতীত বোঝার পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

বই : হোয়াই নেশনস ফেইল

লেখক : দারোন অ্যাসেমোগলু ও জেমস এ. রবিনসন

অনুবাদ : মোহাম্মদ আরিফ খান

বিষয় : আন্তর্জাতিক রাজনীতি

প্রকাশক : চৈতন্য

মূল্য : ৯৫০৳

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন