জুলাই বিপ্লবের কালচারাল জিনিয়ালজি

আবু তাহের তারেক
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ২১: ২৭
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ২৮

জুলাই এক দিনে সংগঠিত হয় নাই। যখন পিলখানা সংগঠিত হইল বা যখল শাপলায় লৌ ঝরল, জুলাই তখন থেকেই শুরু হইয়া গেল। হাসিনা এরপরে আগায় নাই। একটু একটু কইরা লাল জুলাইয়ের পতনের দিকে পৌঁছাইতেছিল শুধু।

বিজ্ঞাপন

আমাদের মতো অসংখ্য-অগণিত লেখক, শাপলার ঘটনার আগে, নিতান্তই ফুল-পাখি লতা-পাতা নিয়া মগ্ন আছিল। কিন্তুক, শাপলা একটা সইত্য সইত্য রুহানি ঘটনা আছিল। শাপলা লেখক অ্যাক্টিভিস্ট, চিন্তকের চউখের ধান্ধা খুইলা দিছিল।

নিজের কথা বলি—তখন অল্পদিন হয়। আমি দেশ থাকি হিজরত করি। হিজরতের পরে পরে, ঢাকার শাহবাগে তথাকথিত একটা ‘জাগরণ’ সংগঠিত হয়। পয়লা ত, আমি এই জাগরণে উল্লসিতই আছিলাম! কিন্তুক, এমন একদিন আসল আমাদের দুনিয়ায়, যখন নিদ হইতে জাইগা দেখি; ইতালি প্রবাসী কবি হজরত মজনু শাহ লাল লাল পাঞ্জাবি পরিহিত মাদরাসার ছেলেদের ছবি দিয়া পোস্ট করছেন। ছবির উপরে আছিল কিছু উপহাসমূলক লেখা! আমার দিল কইল, এইটা, এই উপহাসটা, বেইনসাফি। নিশ্চয় কিছু একটা আছে, শাহবাগের ভিতরে, যা মন্দ। নইলে, কেন দেশের মানুষরে মাইরা লালে লাল করতে হয়, আর, কেনইবা এইটা নিয়াও মানুষ কুৎসিত আনন্দ উদ্‌যাপন করে!

এইরকম সময়ে, হজরত ব্রাত্য রাইসুরে অনলাইনে পাই। তিনি বিচারিক প্রক্রিয়ায় মানুষ খুনের বিপক্ষে কথা বলতেন। এই বাবদে, উনারে তখন নিদারুণ গঞ্জনা সহ্য করতে হইছিল। অবশ্য, রাইসু অল্প দম নিয়া অনলাইনে অ্যাক্টিভিজম করতে নামেন নাই। এইটা উনার কামে-কাজে খিয়াল করতাম। তান ভাষা আছিল অপ্রমিত। তাতে থাকত শার্প লজিক। তিনি যেমন কবি, শিল্পী, অ্যাক্টিভিস্ট, তেমন বুদ্ধিজীবীও। হজরত রাইসু নিজের কামে-কাজে একটা অপ্রমিত ভাব ধারণ করতেন। তিনি অপ্রমিত জবানে লেখতেন। অপ্রমিত জবানের পক্ষে অ্যাক্টিভিজমও করতেন।

অনেকেই বইলা থাকেন, তিনি অপ্রমিত বাংলা চর্চা পয়লা-পরথম শুরু করেন। আমরা যারা ২০১২ হইতে অনলাইনে আসছি, তাদের পক্ষে এর সত্যতা নিরূপণ করা মুশকিল। কারণ কবি-সাহিত্যিকরা গণহারে ফেইসবুকে আসার আগেও উনাদের একটা ব্লগযুগ আছিল। সেইখানেও অপ্রমিত বাংলার চল আছিল। (সেইটাও কি হজরত রাইসু সাহেব শুরু করছিলেন! যুক্তির খাতিরে আমরা তা মাইনা নিলেও কথা থাকে—কথা হইল, অপ্রমিত বাংলায় পয়লা লেখা হয় আনুমানিক ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। আমাদের পয়লা কিতাব, ‘চর্যাপদ’ অপ্রমিত বাংলায় লেখা। এরপরে আমাদের গ্রেট ট্রাডিশনই এমন আছিল, যার ভাষা আছিল ‘জঙ্গম বাংলা’। সংস্কৃত-প্রধান বাংলার একটা ক্ষীণস্রোত, হঠাৎ একসময় ‘জঙ্গম বাংলার’ জায়গা অধিকার করে। বিশেষ করে, সাদা কলোনাইজারদের সহায়তায়; পলাশীর পরের বাস্তবতায়, বামনবাদীরা এক নয়া বাংলার জন্ম দিতে থাকে। কালের পরিক্রমায়, সংস্কৃতপ্রধান এই বাংলাই তখন সাহিত্যের মূল স্রোত হইয়া উঠে। তবুও এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না; যে জঙ্গম বাংলায় রচিত সাহিত্য কুনুদিন বন্ধ হয় নাই। কলকাতায় যখন কলোনাইজারদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সো কলড ‘রেনেসাঁ’ সংগঠিত হইতেছিল, তখন কলকাতার অপর পিঠে, কারবালার সাহিত্য উদ্‌যাপিত হইতেছিল। এদিকে জালাল খাঁ, লালন শাহ, হাসন রাজা, রাধা রমণ ইত্যাদি অজস্র রথী-মহারথী সিনে আসতে শুরু করলেন। আজও হজরত কারী আমির উদ্দিন, মাতাল রাজ্জাক, আলেয়া আলোরা এই ধারারে পুষ্ট কর‍তেছেন। কলোনিয়াল কলকাতা কখনোই এদের মূলধারার সাহিত্যিক হিসাবে জায়গা দেয় নাই। আমরাও, এখনো, উনাদেরকে এই প্রাপ্য সম্মান দেই না।)

তো, ভদ্রবিত্ত সমাজে নয়া করি ‘অপ্রমিত’ জবানে লেখার চল শুরু করার পেছনে, হজরত ব্রাত্য রাইসুর একটা বড় অবদান স্বীকার করাই যায়। (যদিও, এমনকি কলোনিয়াল কলকাতায়ও, অপ্রমিত জবানে আধুনিক সাহিত্য লেখার নজির আছে। স্বাধীন বাংলাদেশে, আবুল মনসুর আহমদদের একটা বড় মেহনত আছে, বাংলাদেশি কালচার, জবান ইত্যাদির স্বরূপ বিষয়ে)। এদিকে হজরত ব্রাত্য রাইসু ছাড়াও মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী ব্যাপকভাবে উনার নাটকে-সিনেমায়, কমন বাংলা নিয়া আসলেন। (আবারো বলি, ফারুকীর আগেও জঙ্গম বাংলায় সিনেমা প্রচুর হইছে। কিন্তুক, মিডল ক্লাসের যে একটা কমন বাংলা, এইটার সাম্প্রতিক চর্চা মূলত ব্রাত্য রাইসুর বিচিত্র লেখালেখিতে, ফারুকীর নাটক-সিনেমায়, শহীদুল জহীরের ফিকশনে ব্যাপক অর্থে পাই।) ফারুকী বা শহীদুল জহীরের লগে রাইসুর পার্থক্য হইল এই, যে রাইসু একনাগাড়ে এক যুগেরও অধিক কাল ধইরা অপ্রমিত বাংলার পক্ষে বুদ্ধিজীবিতা করছেন। এদিকে, মাস মিডিয়া, যেমন সোশাল প্ল্যাটফর্মগুলার ব্যাপক ইউজের কারণে, অপ্রমিত বাংলা রাতারাতি আমাদের লেখার মূলস্রোতে পরিণত হয়। (অবশ্য, এই ঘটনারে প্রতিষ্ঠান এখনো খুব একটা স্বীকার করে না। বাংলা একাডেমির ডিজি লাল জুলাইয়ের পরে ‘এজমালি ভাষা’ নিয়া বক্তিমা করলেও, বাংলা একাডেমির পুরস্কারগুলা ‘এজমালি ভাষাওয়ালারা’ প্রায় কেউ পায় নাই।)

ব্রাত্য রাইসুর কাছাকাছি সময়ে হজরত রিফাত হাসান নামের এক ভদ্রোলোকরে আবিষ্কার করি। তিনি শুধু বিচারিক খুনের বিপক্ষে নয়; বরঞ্চ রাজাকারদের বিচারকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। এইটা যে বিচার আছিল না, হাসিনার মসনদরে চিরস্থায়ী করার মহড়া আছিল—এই বাবতে উনি অজস্র লেখা, যুক্তি ও তর্ক উৎপাদন করতে থাকলেন। এছাড়া তিনি আমাদের রাষ্ট্রের আইডিওলজি নিয়া আলাপ করতে গিয়া, এইটারে ‘রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্র’ বইলা সাব্যস্ত করলেন। এরপর হইতে, লাল জুলাই পর্যন্ত, রিফাত হাসান অনবরত রাষ্ট্র, রাষ্ট্রযন্ত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়া কথা বইলা গেছেন। কিতাব তৈয়ার করছেন, এইসব লেখাজোকা দিয়া। নোট করার বিষয় হইল, রিফাতও তান নিজের মতো, একটা অপ্রমিত জবানে লেখেন। এদিকে, হজরত ব্রাত্য রাইসুর মতো, হজরত রিফাত হাসানও একজন কবি!

ব্রাত্য রাইসু ও রিফাত হাসানদের রাষ্ট্রবিষয়ক বিচিত্র অ্যাক্টিভিজমের সময়ে আরো আরো চরিত্র হাজির আছিল। স্বয়ং ‘কওমি’ নিজেই একটা ফোর্স আছিল। কওমির অ্যালাই হিসাবে মাঠে আছিলেন ফরহাদ মজহার ও তান ফ্যান-ফলোয়াররা। (এদিকে হজরত রাইসুরও ফ্যান-ফলোয়ার বেইস আছিল। বাম ঘরানার কিছু লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট, যেমন মাহবুব মোর্শেদ, মৃদুল মাহবুব, সালাহ উদ্দিন শুভ্ররা রাইসুর চিন্তার কাছাকাছি জায়গা হইতে অ্যাক্টিভিজম করতেন। অবশ্য রাইসুর একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ঝোঁক আছিল। মাহবুব মোর্শেদরা আছিলেন অ্যাকশন-ওরিয়েন্টেড। ফলত, একসময় তাদের বন্ধনে ফাটল ধরল)। আমাদের পরিচিত খ্যাতনামা সলিমুল্লাহ খান তখন শাহবাগের পক্ষে কিছুদিন অ্যাক্টিভিজম করছিলেন। (অবশ্য, লাল জুলাইয়ের শেষদিকে আইসা উনি একটা আগুন ধরানো বক্তব্য দিবেন, যা ব্যপকভাবে শেয়ারড হইব।) তো, সলিমুল্লাহ খান, বা ফরহাদ মজহাররা যে পক্ষেই অ্যাক্টিভিজম করেন না কেন, বাংলাদেশে আর্ট কালচারের যে একটা প্যারাডাইম শিফট ঘটছে, গত প্রায় এক-দুই যুগে, এতে উনাদের অবদান মিশ্র পকরিতির। উনারা এই প্যারাডাইম শিফটের ডাইরেক্ট কর্তা নন। যদিও, ইনডাইরেক্টলি, সলিমুল্লাহ খানের লেখাজোখা, বা ফরহাদ মজহারের, বিশেষ করে, ‘কবিতা’ এই শিফটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফরহাদ মজহার শাহবাগের বিপক্ষে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করলেও পরের দিকে তিনি এই বিপ্লবী ধারা অব্যাহত রাখতে পারেন নাই। একজন বামাচারী বিপ্লবী হিসাবে, তিনি যদিও সবসময় মুখর আছিলেন, তবুও, তার কাজকাম প্রশ্নহীন আছিল না। বিশেষ করে, লাল জুলাইয়ের পরে, ফরহাদ মজহারের আশেপাশের লোকজন যেই হারে ক্ষমতায়িত হইছেন, তাতে উনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা থাকবারই কথা! একইরকম কথা, হজরত ব্রাত্য রাইসুর ব্যাপারেও খাটে। মানে, শাপলার পরে একটা দীর্ঘ সময়, আমাদের মতো ইয়াং রাইটার-অ্যাক্টিভিস্টদের চিন্তা-চেতনারে ব্যাপকভাবে উদ্দীপিত করতেছিলেন তিনি। কিন্তুক, একটা সময় পরে, উনারে নিয়া মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মাহবুব মোর্শেদদের কেউ কেউ, উনার রাজনৈতিক সততা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন।

রাইসু ও রিফাতদের অল্প পরে, ইমরুল হাসান ও রক মনু নামের দুইজন চিন্তক, কবি ও অ্যাক্টিভিস্টের আগমন ঘটে। উনারা ‘বাছবিচার’ নামে একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈয়ার করেন। যেইটা আরবান-বেইজড ছেলেমেয়েদের চিন্তায় একটা শেইপ দিতে হেল্প করে। বাছবিচার বিষয়ে অনেক কথা বলা সম্ভব। একটা বিষয় বড় করে বলা দরকার। ইমরুল হাসানরা হাইপ তোলার লাগি এই প্ল্যাটফর্ম করেন নাই। অল্পদিন পরে, হারাইয়াও যান নাই। শুরু হইতেই তারা আছিলেন সিলেক্টিভ। এরা যেমন ধৈর্যের চরম লেভেল-সহকারে কাম করছেন, তেমন, নিজেদের ফিলসফির প্রতি আছিলেন নিষ্ঠ। ইমরুল হাসান ও রক মনু ‘অপ্রমিত বাংলা’ আন্দোলনরে আরেকটা পর্যায়ে নিয়া যান, নিজেদের লেখালেখির মাধ্যমে। তখন রক মনু ‘আম-বাংলার’ কথা বলেন, আর ইমরুল হাসান ‘কমন বাংলার’ কথা বলেন। বিশেষ করে, ইমরুল হাসানের আরবান স্টাইলে অসংখ্য কবি-সাহিত্যক লেখা শুরু করেন। নোট করা দরকার, যে ব্রাত্য রাইসু ‘অপ্রমিত বাংলায়’ লেখলেও, উনি আছিলেন ক্লাসিসিস্ট। উনি প্রমিত অনেক রীতিপদ্ধতিরেও ছাড়েন নাই। ফলে, রাইসুর বাংলা কিছুটা বুকিশ আছিল। কিন্তুক, ইমরুল হাসানদের বাংলার বেইজটা আছিল শহুরেদের মুখের ভাষা। এদিকে, রক মনু এই শহুরেদের মুখের ভাষায় আরেকটা ফ্লেভার অ্যাড করলেন। তিনি একটা লোকাল কালার আনতে চাইলেন তান লেখায়। যদিওবা, উনার লেখালেখিতে মুসলমানের চিহ্নওয়ালা বুলি যত আধিক্য পাইল, বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন বুলি ততটা গুরুত্ব পাইল না। মানে, মনু এবং ইমরুল একটা ‘কমন’ বাংলার পক্ষেই থাকলেন।

ভাষা-বিষয়ক এইরকম অবস্থানের পরে পরে, একটা ‘জঙ্গম বাংলার’ জোয়ার খিয়াল করা গেল। ‘কমন বাংলা’ বিষয়ক অবস্থানের সমস্যা হইল, এই অবস্থান ‘আনকমন বাংলারে’ হেলা করে, রিজেক্ট করে, বা ছোট করে। এই লেখাখানার লেখক রচিত পয়লা কবিতার বই ‘আইয়ো রেগো ময়না’ লেখা হইছিল তথাকথিত ‘অপ্রমিত’ বা ‘কমন বাংলার’ বাইরে গিয়া। এই কিতাবের লেখক মনে করেন, আমাদের কমন বাংলারও রূপভেদ আছে। যেমন, চাটগাইয়া বা সিলেটিদের কমন বাংলা, ঢাকাইয়াদের কমন বাংলার মতন নায়। এদিকে, বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপগুলাও ত, বাংলা ভাষাই! ফলত, একজন লেখকের পক্ষে (বিশেষ করে, সৃজনশীল লেখক) ‘নির্দিষ্ট কুনু ভাষিক ফরম্যাটে’ লেখার বাধ্যবাধকতা নাই। তদুপরি, কবিতা হইল ‘কনশাস’, ‘আনকনশাস’ আর ‘কালেক্টিভ আনকনশাসের’ খেলাঘর। একজন সিলেটের লেখক যদি লেখা শুরু করার আগেই মনস্থ করেন যে, তিনি তথাকথিত ‘কমন’ বা ‘প্রমিত’ বাংলাতেই লেখবেন, তাহলে পয়লাই তিনি তার আনকনশাস ও কালেক্টিভ আনকনশাসের ন্যাচারাল ফ্লো-টারে বাধাগ্রস্ত কইরা ফেলবেন। একই কথা অন্য অন্য অঞ্চলের লেখকদের বেলায়ও সইত্য।

বলা বাহুল্য, ‘জঙ্গম বাংলাই’ আমাদের সাহিত্য-ভাষার প্রধান রাস্তা। এই কারণেই চর্যাপদের ভাষারে কেউ কেউ যেমন চাটগাইয়া বলেন, তেমন, কেউ কেউ সিলেটিও বলেন! এদিকে, অপরাপর কিছু ভাষারও, সাহিত্যিক রূপের প্রথম প্রকাশ ‘চর্যাপদ’! চর্যার পরে, আমাদের বড় বড় সাহিত্যিকদের অনেকের লেখায়ই স্থানিক চেতনার প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসতে দেখি। বিশেষ করে বাউল-ফকির-লোকাল পদকর্তাদের মইদ্যে এই চেতনা আরো পষ্ট।

আশির দশকে যখন ব্যাপকহারে কলকাতার ভাষিক ও বয়ানগত হেজিমনি আমরারে গ্রাস করছিল, বিশেষ করে কবিতারে; তখন হইতেই, এর বিপরীতে একটা ফৌর্স খাড়া হইয়া গেছল। নব্বইয়ের দশকে বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধী কবিতার জন্ম হইল। কাজল শাহনেওয়াজ, জহির হাসান, ব্রাত্য রাইসু, কামরুজ্জামান কামু, ইমরুল হাসান, মুজিব ইরম, মোস্তাক আহমাদ দীনরা বিচিত্র ভাব ও রূপ নিয়া হাজির হইলেন কবিতায়। এদের সকলেরই নিজস্ব এজেন্ডা আছিল। প্রকাশের নিজ নিজ স্কিমা আছিল। উনাদের মইদ্যে, ব্রাত্য রাইসু ও ইমরুল হাসানের কথা উপরে বলা হইছে। যেমন, ব্রাত্য রাইসুর কবিতা অপ্রমিত হইলেও এইটা ক্লাসিক গন্ধী। এদিকে ইমরুলের কবিতায় বাংলাদেশের একটা উদীয়মান নগরের স্বাদ পাওয়া যায়। ব্যক্তির আনাগোনা খিয়াল করি উনার কাব্যে। জহির হাসানের কবিতা নিয়াও এইরকম বলার জায়গা আছে। বিশেষ করে, ইমরুল হাসান যেমন, কবিতায় একটা নাগরিক পরিসর তৈয়ার করতেছিলেন; জহির হাসানও তখন গ্রাম ও শহরের একটা কসমোলজি সন্ধান করতেছিলেন। জহির হাসান লেখতেছিলেন একটা কালেক্টিভ আনকনশাসের কবিতা। যেই আনকনশাসরে এইখানকার প্রায় সকল মানুষই একভাবে না একভাবে ফিল করে, ঠার পায়। এদিকে জহিরের কবিতার জবানও আছিল ‘জঙ্গম’। এই ঘরানায় কামরুজ্জামান কামু, মুজিব ইরম, মোস্তাক আহমাদ দীনরা পড়বেন। যদিও, কাব্যিক সফলতার বিচারে ও এই ধারায় পরবর্তী কবিদের অনুসরণের দিক দিয়া, জহির হাসানরে উপরে রাখা লাগে। জহির হাসানের ‘আম্মার হাঁসগুলি’ নামক কাব্য জঙ্গম বাংলারেই খালি উদ্‌যাপন করে না, পুব বাংলার কৃষি-সভ্যতারে ধারণ কইরা, কিতাবখানা নিজের সার্থকতাও জাহির করে। পরবর্তীতে নতুন কবিদের মইদ্যে, রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা, ওয়াহিদ রুকন, তুষার সাহিদুর রহমানরা এই ধারায় বেশ সাফল্য অর্জন করেন।

বাংলা ভাষা-বিষয়ক এই তিনস্তরীয় (অপ্রমিত, কমন ও জঙ্গম) অ্যাক্টিভিজমের পাশাপাশি অনেক নতুন ফেইসই সোশ্যাল মিডিয়ায় আগমন করেন। ইয়াংদের মইদ্যে, রাতুল মোহাম্মদের কথা না বললেই নয়। তিনি নিজের জান বাজি রাইখা বিচিত্র অ্যাক্টিভিজম চালাইয়া গেছেন। একইরকমভাবে তুহিন খানও বেশ পপুলার একটা চরিত্র হিসাবে আবির্ভূত হইলেন। (এই সময়ে আইসা, বামাচারীদের অনেকেই শাহবাগপন্থারে তরক কইরা, বাকশাল-বিরোধী হিসাবে মাঠে হাজির থাকলেন। দুইটা গুরুত্বপূর্ণ নাম এইখানে উল্লেখ করা দরকার। এক হইলেন, পারভেজ আলম। দুই, আ-আল মামুন। অবশ্য, সংগঠন হিসাবে, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নাম নেওয়া যায়। ‘অরাজ’ নামের একখানা অনলাইন প্ল্যাটফর্মও চলতে থাকে তখন। এদিকে বামাচারী না হইলেও রেজাউল করিম রনি সম্পাদিত অনলাইন ম্যাগাজিন ‘জবান’ কিছুদিন আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়।) উনাদের বয়সের তুলনায় জজবার ব্যাপারটা প্রশংসা করার মতন! এইরকম সময়ে, হাসান রোবায়েতের আবির্ভাব ঘটবে। হজরত রোবায়েত একটা উৎপল-জীবনানন্দীয় ঘরানার মইদ্যে নিজের কবিতার জার্নি শুরু করেন। কিন্তুক তিনি কখনো ফিকির থামান নাই। ফলত, খুব শীঘ্রই রাজনৈতিক কবিতা লেখতে শুরু করেন রোবায়েত। যার ফলে একটা সময় তার কলকাইত্তা লিখনভঙ্গিমা এতটাই ‘জঙ্গম বাংলারে’ ধারণ করতে সক্ষম হইল, যে তিনি পুথির আদলে লেইখা ফেলেন ‘ছায়াকারবালা’ নামক ইন্টারেস্টিং ও সাহসী কাব্য। এই কিতাবে অসংখ্য উপায়ে বাকশালরে তুলাধুনা করা হইছে। কবিতায় মগ্ন থাকা হাসান রোবায়েত বাকশালের বিরুদ্ধে এতটাই ক্ষিপ্ত হইলেন যে, লাল জুলাইয়ের সময়ে তিনি ‘খাঁটি জঙ্গম বাংলায়’ লেখতে থাকলেন জ্বালাময়ী স্লোগান, যার অনেকগুলাই শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে শোভা পায়! ফলত, জুলাইয়ের আন্দোলনে হাসান রোবায়েতের একটা ইউনিক ভূমিকা আছে।

একই রকম একটা বড় ভূমিকা আছে আম্রিকা প্রবাসী শিল্পী দেবাশীষ চক্রবর্তীর। তার আর্ট আমাদের জুলাইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘লিসান’ হিসাবে আবির্ভূত হইছিল। ভূমিকা আছে সেজানের মতন র‍্যাপারদেরও।

জুলাই কখনোই রাইসু, রিফাত, ইমরুল, মনু, জহির, রোবায়েত, দেবাশীষ, বা সেজানদের একলার লড়াই আছিল না। রাতুল বা তুহিনই আছিলেন না শুধু অ্যাক্টিভিস্ট। পিলখানা ও শাপলার পরে, বাকশালের বিরুদ্ধে লড়াই ঘটতে থাকে বিচিত্র ফ্রন্টে। এই দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষ দিকে আইসা যুক্ত হন অজস্র শ্রেণি-পেশার লেখক, চিন্তক, অ্যাক্টিভিস্ট। তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে জনপ্রিয় হইয়া উঠেন। যেমন পিনাকী ভট্টাচার্য, বা সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন। মধ্যবিত্তদের মইদ্যে জনপ্রিয় হন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও অ্যানালিস্ট। অ্যানালিস্টদের মইদ্যে ফাইয়েজ তৈয়্যব, ফাহাম আব্দুস সালাম বা আরো অনেকের নাম নেওয়া যায়। সাংবাদিদের কথা, ইউটিউবের মাধ্যমে, প্রায় সকলেই জানেন। এদিকে, শাপলার পরে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনগুলা, বা হেফাজতের আন্দোলনগুলা রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্র আন্দোলনের তখনকার ছোট্ট ভাই-বইনেরাই লাল জুলাইয়ের ছাত্রনেতা হইছেন! এদিকে শাপলার পর হইতে লাল জুলাই পর্যন্ত হেফাজতের একটা ডেফিনিটিভ ভূমিকা আছিল। অপরাপর রাজনৈতিক দল ও বিচিত্র মত-পথের মানুষের অবদানও তাতে আছিল। আছিল পাহাড়ি-বিহারি-রোহিঙ্গাদের অবদানও।

কিন্তুক, গুটিকয় লেখকই আসলে, জুলাইয়ের কালাম তৈয়ার করছিলেন। রাইসুর অপ্রমিত বাংলা, রিফাতের টার্মিনোলজি, যেমন ‘রাবীন্দ্রিক রাষ্ট্র’, রক মনুর ‘আমের বাংলা’, বা উনার হাতে পপুলার হওয়া ‘বাকশাল’ টার্মখানা, ইমরুলের ‘কমন বাংলা’, জহির হাসানের জঙ্গম বাংলা, রোবায়েতের ভাষিক দ্রোহ, দেবাশিষের শৈল্পিক বিপ্লব, সেজানদের র‍্যাপ গানের উচ্ছ্বাস, ফারুকীদের নাটক-সিনেমার জবান—এইগুলা আমাদেরকে জুলাইকেন্দ্রিক একটা ‘কালাম’ তৈয়ারে হেল্প করছে।

এই কালাম তৈয়ার না হইলে হয়তোবা আমরা রাবীন্দ্রিক বাংলার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতাম না। এই কালাম জন্ম না নিলে রাবীন্দ্রিক পুতুপুতু ভাষা, কালচার ও মুজিবীয় বাকশালের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই হয়তোবা অন্যরকম হইত! লাল জুলাইয়ের অনেক অনেক নায়কই থাকবেন। শহীদ আবু সাইদরা থাকবেন। গাজী মাহফুজ-নাহিদরা থাকবেন। লেখক সাংবাদিক অ্যানালিস্ট, শ্রমিক ও রাজনীতিকরা থাকবেন। কিন্তুক ওই গুটিকয় কবি, যারা নিজেদের জান হাতে লইয়া অ্যাক্টিভিজম ও চিন্তার জগতে মাইগ্রেট করছিলেন, তাদেরকে জুলাইয়ের রুহানিয়াতের অন্যতম কর্তা হিসাবে ভাবতে পারা যায় ত! র‍্যাপার, আর্টিস্ট, ফিল্মমেকার, অ্যানালিস্ট, অ্যাক্টিভিস্ট এমনকি ইসলামি বক্তারাও তাতে অন্তর্ভুক্ত হইবেন বৈকি!

জুলাই আমাদের সকলের। কিন্তুক, যারা লাল জুলাইয়ের ‘জবান’ দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, তারা এর রুহানি স্রষ্টা। উপরে যাদের নাম নেওয়া হইল, তাদের নাম নিলাম গুরুত্বের দিক দিয়া তারারে সিংগেল আউট করার খাতিরে। প্যারাডাইম শিফটে তাদের ভূমিকা পষ্ট ও সুদূরপ্রসারী। অন্যরা তাতে খাটো, বা আহত হইবেন না, বোধকরি! জুলাই আমাদের অহংকার।

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আইআরআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত