বাংলা একাডেমি ৭০ বছরে পদার্পণ করল। প্রশ্ন জাগে, ৭০ বছরে বাংলা একাডেমির অর্জন কী, কোথায় সাফল্য। অনেকে মনে করেন, প্রথম সাফল্য পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহে, যাকে বলা যায় ব্রিটিশ আমলে বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ যে সাফল্য অর্জন করেছিল তারই সম্প্রসারণ। দ্বিতীয় সাফল্য লোকসাহিত্য সংগ্রহে।
তবে লোকসাহিত্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দীনেশচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে যে সাফল্য দেখিয়েছে দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালে, ড. শহীদুল্লাহ্র আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তা দেখাতে ব্যর্থ হয়। শেষাবধি যা কিছু অর্জন করা সম্ভব হয় ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর, তাও অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংস হওয়ার পথে। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্তঘামে কেনা এ অর্জন হারিয়ে যাবে না বলেই মনে হচ্ছে। তারপরও প্রতিনিধিত্বমূলক পুঁথিগুলোর বিবরণসংবলিত গ্রন্থ প্রণীত হতে পারে অথবা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংকলিত বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ (১৯১৪) বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত আহমদ শরীফ সম্পাদিত পুঁথি পরিচিতির (১৯৫৮) পুনর্মুদ্রণ হতে পারে।
এরপর বাংলা একাডেমির বড় অর্জন সম্ভবত অভিধান রচনার ক্ষেত্রে, যার সূচনা করেছিলেন ষাটের দশকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আঞ্চলিক অভিধান প্রণয়ন করে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানগুলোর মধ্যে বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান যুগোপযোগী একটি উদ্যোগ নিঃসন্দেহে। তবে জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন আরো কয়েকটি অভিধান রচিত হতে পারেÑযেমন পেশা অভিধান, ঋতু অভিধান, নদী অভিধান, কৃষি অভিধান, আঞ্চলিক সাহিত্যের অভিধান প্রভৃতি।
অনুবাদ ও গবেষণা বিভাগের সূচনা হয়েছিল ১৯৫৮ সালে, তবে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু হয় ১৯৬১-৬২ সাল থেকে। অদৃশ্য কারণে এই দুই ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হয়নি। পাকিস্তান আমলে মোটাদাগে এই পাঁচটি বিভাগে সীমাবদ্ধ ছিল বাংলা একাডেমির মূল কার্যক্রম। বাংলা একাডেমি আজও তার লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি, এমনকি ১৯১১ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির যে ইশতেহার তৈরি করেছিলেন, সেখান থেকেও আমরা অনেক দূরে।
বাংলাদেশ আমলে অর্জন বৃহত্তর পরিধিতে বইমেলার আয়োজন। মনজুরে মওলার সময় (১৯৮২-১৯৮৬) নব আঙ্গিকে গ্রন্থমেলা উদ্বোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই বাংলা একাডেমির ইতিহাসে বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তন সম্ভব হয়। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে তার ওপর আক্রমণেরও অভাব হয়নি। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ১৯৯৫ সালের ১ ডিসেম্বর বাণিজ্যমেলা শুরু হওয়ার পর। এই মেলা এতটাই আগ্রাসী হয়ে ওঠে যে, ২০২২ সালে পূর্বাচলে স্থানান্তরিত হওয়ার পর জানুয়ারির সীমানা অতিক্রম করে ফেব্রুয়ারিতেও অনধিকার প্রবেশ করতে শুরু করে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের অজুহাতে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয়ে বাণিজ্যমেলা সম্প্রসারিত হয় ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত।
বাঘের তাড়া খেয়ে হরিণ যেমন লোকালয়ে ঢুকে পড়ে, অনেকটা তেমনি নানা আক্রমণে বইমেলা হয়ে পড়ে বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত। ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলাকে নির্বিঘ্ন ও নিষ্কণ্টক করতে এবং রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে আমাদের যা কিছু করা দরকার সে বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে।
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলা একাডেমির আন্দোলনে আরেকটি বাঁক পরিবর্তন ও মাইলফলক স্থাপন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। বাংলা একাডেমি এখন ৭০ বছরের অর্জন নিয়ে আত্মসমালোচনা করতে পারে, স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করতে পারে; একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণের জন্য যেতে পারে জনগণের কাছে তার মতামতের জন্য। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম অবস্থায় বাংলা একাডেমি দশশালা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। আমি প্রস্তাব করব ‘দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংরক্ষণ ও লেখকদের জীবনী গ্রন্থমালা প্রকাশের দশক’ ঘোষণা করার জন্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক মো. আব্দুর রাজ্জাকের ২৭ বছরের (১৯৬০-১৯৮৭) সাধনার ফসল ‘বাংলা ভাষায় মুসলিম লেখক গ্রন্থপঞ্জি ১৪০০-১৯৮৫’ শিরোনামে চার খণ্ডে সমাপ্ত গ্রন্থ হাতে আসার পর আমার মনে এ ধরনের পরিকল্পনা পেশের সাহস জন্মে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি ছয় হাজার লেখকের ২৫ হাজার পুঁথিপুস্তকের পরিচয় দিয়েছেন। তার মধ্যে প্রায় ৫০০ বছর ধরে রচিত পুঁথিপুস্তকের বেশির ভাগই দুষ্প্রাপ্য। তিনি এসব গ্রন্থ বিশ্বের কোনো লাইব্রেরি বা দেশের কোথায় পাওয়া যাবে, তারও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। দুষ্প্রাপ্য বইয়ের কোনটি কোন লাইব্রেরিতে পাওয়া যাবে, সারা দেশব্যাপী ডিজিটাল তল্লাশি করার পরই তার হদিস বের করা সম্ভব হবে, যেমনভাবে তল্লাশি দিয়ে বালাম বই থেকে বের করা হয় পুরোনো দলিলপত্র। কালের গর্ভে যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য দরকার এসব পুঁথিপুস্তকের ইউনিয়ন ক্যাটালগ তৈরি করে জাতীয় ভিত্তিতে সংরক্ষণ করা, যে কাজটি অনেক আগেই অন্যান্য দেশ করেছে জাতীয় গ্রন্থাগারের মাধ্যমে।
একই সঙ্গে প্রস্তাব করছি সাধারণ লেখকদের জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য। বাংলা একাডেমি বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের রচনাবলি ও জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করে; তাদের জন্মমৃত্যু-বার্ষিকী পালন করে। বরেণ্য লেখকদের পাশাপাশি আগামী দশক হতে পারে অখ্যাত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের রচনাবলি ও জীবনী প্রকাশের দশক। আঞ্চলিক অভিধান প্রণীত হয়েছিল স্কুল-কলেজে চিঠি প্রেরণ করে বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েÑএসব অবহেলিত লেখকদের জীবনী রচিত হতে পারে একই পদ্ধতিতে। এসব জীবনী রচিত হতে পারে এক পৃষ্ঠা থেকে এক ফর্মার মধ্যে। ৬৪ জেলাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা রচিত হয়েছে ৬৪ খণ্ডে, এটিও হতে পারে জেলাভিত্তিক। সাধারণ লেখকদের জীবনী প্রকাশ এজন্য জরুরি যে, তাদের রচনার মধ্যে রয়েছে আমাদের দেশের শত শত বছরের সামাজিক ইতিহাসের এমন সব উপাদান, যা নেই হাতেগোনা বরেণ্য লেখকদের মধ্যে।
আঞ্চলিক লেখকদের রচনায় রয়েছে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করছিÑ ওয়াইজুদ্দিন চৌধুরীর গরকির বচন (১৮৭৬ সনের জলোচ্ছ্বাসের প্রত্যক্ষ বিবরণ), আরকুমউল্লাহ শাহের কবিনামা (১৩০৪ বাংলার ভূমিকম্প উপলক্ষ্যে রচিত); মুনসী শাহ খাজা আবদুর রহিমের তেরো সনের দুর্ভিক্ষের নানা বিবরণ, ১২৮০ সালের দুর্ভিক্ষের পুঁথি; আব্দুল আমিন ভূঞার জাপান ও বঙ্গে প্রলয় ভূমিকম্প ১৯২৩; আব্দুছ ছুবহানের করিমগঞ্জের জালের কবিতা ১৯২৩; মৌলভী আবদুর রহমান বন্যার পুঁথি (১৯২৭ সালের বন্যার কবিতা); মৌলভী আবদুল কাদেরের বঙ্গে সার্ভ ও সেটেলমেন্ট ১৯২২; কাজী মুহম্মদ আবদুল হামিদের পাটের কবিতা ১৯৩০; আবুল হোসেনের খোয়াড় ও খেয়ার আইন ১৯৩২ প্রভৃতি। এসব লেখক স্থানীয় কীর্তিমানদের জীবনী রচনায়ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
তাদের বইয়ের আকারেও রয়েছে বৈচিত্র্য, যেগুলো নতুন দশকে অনুসৃত হতে পারে। এক ফর্মা, দেড় ফর্মার এরকম ১০টি বই নিয়ে এক মলাটে প্রকাশিত হতে পারে একটি যৌথ বই। এ প্রকল্পটি হবে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ, যার জন্য ‘দশক ঘোষণা’র প্রস্তাব করছি। মধ্যযুগের পুঁথি সংগ্রহের জন্য আমরা দশকের পর দশক ব্যয় করেছি, সংখ্যায় তার সমপরিমাণ দুষ্পাপ্য বই খুঁজে বের করে সংরক্ষণ করার জন্য এক দশক মোটেও ব্যয়বহুল নয়।
নতুন এ ক্ষেত্রটি একরকম অকর্ষিত ও জনবিরলÑযেমনভাবে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত অকর্ষিত ছিল আমেরিকা মহাদেশ। শেক্সপিয়ারের একটি চরিত্র মহাদেশ আবিষ্কার করে একে অভিহিত করে ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ড’ বলে—সম্ভবত আমরাও সেরকম একটি বিশ্ব আবিষ্কার করতে পারি নতুন যুগের উপযোগী সব প্রকল্প গ্রহণ করে।

