কাজী নাসির মামুন
এ বছর গত ১৪ মে পূর্ব লন্ডনে ‘শিকড়’ আয়োজিত ‘বহুজাতিক কবিতা সন্ধ্যা’য় ব্রিটিশ কবি ডেভিড লি মর্গান নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আবৃত্তি করলেন। বিস্ময়কর আবেগ-আন্তরিকতা নিয়ে কবিতাটি তিনি উপাদেয় করে তুলেছেন। বাচন ও দেহভঙ্গি ছিল কবিতার দুর্দান্ত গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। কাজেই আজকের দিনে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা অনিবার্যভাবে স্বীকৃত হচ্ছে।
শেলির কবিতার প্রাণপ্রাচুর্যের সঙ্গে নজরুলের প্রাণোচ্ছ্বাস বহুলাংশে সমিল। হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেলফ’ কবিতায় যে-সর্বজনীন ‘আমি’ তথা ‘আমিত্ববোধ’, তার সঙ্গে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ‘আমি’ও সামঞ্জস্যশীল। নজরুলের অহংবোধ ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে ব্যক্তিনিরপেক্ষ সর্বজনীন ‘আমি’তে রূপান্তরিত। তবে নজরুলের দ্রোহী চেতনার যে-প্রলয়ংকরী ঝংকার, হুইটম্যানের কবিতায় তা নেই।
জীবনকে উদ্দীপিত করার বৈশিষ্ট্য নজরুলের সব প্রধান কবিতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় যে-জয়ধ্বনি ‘তড়িৎ চাবুক হানে’ তাতে কেবল তারুণ্যই উচ্ছ্বসিত আবেগে জেগে ওঠে না, জরাগ্রস্ত বৃদ্ধরাও দুরন্ত অনুভবে বুঝতে পারেন, ‘প্রলয় নূতন সৃজন বেদন।’ আর ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘জাম-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও।’ কাজেই এ কথা স্মরণ রাখা জরুরি, নজরুলের কবিতায় আমরা এত-যে ভাঙন লক্ষ করি তা সৃজনের পূর্বশর্ত। ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতায় ‘রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে’ যে ‘দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে’র প্রসঙ্গ, তাও সৃষ্টির উন্মাদনা; দুর্মর প্রাণপ্রাচুর্যভরা সেই অন্তর্গত উদ্দীপনাকেই তিনি বহির্জগতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাতেও অপূর্ব প্রাণোচ্ছ্বাস ছত্রে ছত্রে সঞ্চারিত। সেই রোমান্টিক প্রাণপ্রণোদনা অনেকটাই বহির্জগৎ থেকে কবির গহনে প্রবেশ করেছে। নজরুলের কবিতার যে-অনুভব, অনেকটাই তার বিপরীত ধারায়। ‘থর থর করে কাঁপিছে ভূধর’; আর সেই কম্পনে উচ্ছ্বসিত রবি ঠাকুরের অন্তর্জগৎ। তাই তার বিস্ময়—‘আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর।’ প্রাকৃতিক প্রাণশক্তি তার নিজের ভেতরে আত্মজাগরণ ঘটিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে উদ্দীপিত। আর নজরুল উদ্দীপক। এই দুই কবিতার প্রেক্ষিতে তাদের পার্থক্য অন্তরে নেওয়া আর অন্তর দেওয়ার মধ্যে।
নজরুল তার সৃষ্টিসুখের মধ্য দিয়ে যে-আত্মশক্তি অর্জন করেছেন, তা জনজাগরণের স্বার্থে বিস্তার করতে চেয়েছেন। তাই তিনি দুর্মর ও দুর্দমনীয়। ‘শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী’ ধ্বংস করে দিতে ‘ভাঙার গান’ গাইতে পারেন দুর্দণ্ড প্রতাপে। ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ লিখে বঞ্চিত মানুষের বুকে সাহস সঞ্চার করতে পারেন, আর হতে পারেন সত্যিকারের প্রাণোদ্দীপক। জীবনকে তিনি উজ্জীবনে উত্তীর্ণ করেছেন। যাপনকে দিয়েছেন উদ্যাপনের মহিমা। এখানে তিনি শিল্পোত্তীর্ণ। এ কারণে নজরুলের কাছে আমাদের ফিরতে হয়, বারবার। কেননা জীবন যখন কাতর করে তোলে, তখনই প্রয়োজন উজ্জীবন। যাপন যখন প্রাত্যহিকতার ভারে ক্লান্তিকর, তখনই দরকার উদ্যাপনের।
জাতীয় জীবনের বিভিন্ন কালপর্বে কবি ও কবিতার ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কবিতার এই জাতিবাদী অবদানকে তাই সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠী কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে। ঐতিহাসিক স্মরণিকা হিসেবে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে পাঠযোগ্য করে তোলে। ঔপনিবেশিক আমলের ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতার মৌলমন্ত্রে মানুষকে জাগ্রত করার যে অনন্য ভূমিকা রেখেছে নজরুলের কবিতা ও রচনা, তার তুলনা দুষ্কর। বাঙালিত্বের চেতনা ছিল তার মননে। বলেছেন, “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাঙলা’, সেদিন তারা সাধ্য সাধন করবে।”
বাঙালিত্বের এই চৈতন্যকে ধারণ করেছেন বলেই হয়তো ১৯২৯ সালে কলকাতা শহরের এলবার্ট হলে নেতাজি সুবাস বসু ও আচার্য প্রফুল্ল রায় নজরুলকে বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিমকে তিনি বিবেচনা করেছেন ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম’ হিসেবে। কাজী আবদুল ওদুদ ঠিকই বলেছেন, ‘যে বৃহৎ জীবনের অথবা জাতীয় জীবনের চেতনা দেশে অনুভূত হয়েছে, তাতে তারও প্রতিভার স্পর্শ লেগেছে। এই জনজাগরণের দিক থেকে দেখলে সহজেই চোখে পড়ে নজরুলের ঐতিহাসিক মর্যাদা কত বড়।’
জাতের নামে বজ্জাতিকে ঘৃণা করতেন বলেই তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সর্বজাতের, সর্বমানবের। একথা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন; বলেছেন, ‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, জাতিসত্তার সকল চেতনা সম্বল করেও তিনি অনন্যসাধারণ এক বিশ্ববোধে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ‘সংকল্প’ নামক কবিতায় ‘দেখব এবার জগৎটাকে’ এই ঘোষণা দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শিশু-কিশোরদের। কবি হিসেবে এই ঔদার্যের মধ্যেই লুক্কায়িত আছে তার ব্যক্তিত্বের দার্শনিক সত্তা। দার্শনিকের কাছে জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক যে-প্রত্যয় আমরা আশা করি, কবির কাছ থেকে সেই বাণীবদ্ধ প্রজ্ঞা হয়তো পাওয়া যাবে না; কিন্তু নজরুলের জীবনাদর্শের মধ্যে সর্বমানবের প্রতি যে অকুণ্ঠ মমত্ববোধ সক্রিয়, সেখানে একটা দার্শনিক ভাবাদর্শ প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে।
কবিতার আধুনিকতা মানে দেবতা নয়, মানুষকে বড় করে দেখানো। এক্ষেত্রে আধুনিক মননচর্চায় তিনি তিরিশের আধুনিক কবিদের চেয়েও বেশি অগ্রসর। ‘মানুষ’ কবিতায় বললেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ ‘নারী’ কবিতায় দেখালেন তার চোখে ‘পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’ এ সময়ের প্রখর নারীবাদী প্রবণতার আগেই তার এই আধুনিক বয়ান। ‘সাম্যবাদী’ কবিতাসহ অপরাপর বহু কবিতায় বৈষম্যবিহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা তিনি প্রকাশ করেছেন। কাজেই তিরিশি আধুনিক কবিরা ব্যক্তিসত্তা ও কবিসত্তার মধ্যে যে কৃত্রিম ভণিতার প্রশ্রয় দিতেন, নজরুলের মধ্যে তা ছিল না। কবিতায় তিনি যা প্রকাশ করেছেন ব্যক্তিগত জীবনে তা-ই বিশ্বাস করতেন। এই কাব্যিক তথা সাহিত্যিক সততা তাকে বিশিষ্ট করেছে।
বিনয় সরকার বলেছেন, ‘নজরুল-কাব্যের প্রথম মুদ্দা বিপ্লব, আর দ্বিতীয় মুদ্দা ভালোবাসা।’ কাজী আবদুল ওদুদ নজরুলের মধ্যে জন্মগত তাত্ত্বিকতা আবিষ্কার করেছেন। সেই তত্ত্বের নাম দিয়েছেন লীলাবাদ, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ করেছেন Pantheism, যেখানে সবকিছুই ঈশ্বরের লীলা হিসেবে স্বীকৃত। যদিও Pantheism-এর বাংলা সমার্থক হিসেবে আমরা জানি ‘সর্বেশ্বরবাদ’কে। যাই হোক, নজরুল-কাব্যে এই মরমি দার্শনিক প্রবণতা কতটা গভীরে প্রোথিত তা গবেষণার বিষয়। তবে দুর্জয় শক্তির প্রতি তার অভিনিবেশ অনেকটা উপাসনার মতো। তার উচ্চকিত কাব্যভাষার পেছনে এটিও কারণ হতে পারে। জীবনকে গতিশীল করতে এবং মানুষের কানে পৌঁছানোর তাগিদ থেকেই হয়তো দার্শনিক গভীরতা নয় বরং নান্দনিক ‘কলহ’কে তিনি কবিতায় উপজীব্য করেছেন। শিল্পতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যা-ই হোক, কবিতাকে প্রায়োগিক সত্যে প্রতিষ্ঠা দিতে এই সরবকণ্ঠ অসামান্য ভূমিকা রাখে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ হয়তো এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই কাব্যগ্রন্থের নামই দিয়েছেন ‘Howl’ বা ‘চিৎকার’। আর নজরুল নিজেই বলেছেন, ‘এ-কথা স্বীকার করতে আজ আমার লজ্জা নেই যে, আমি শক্তিসুন্দর রূপ-সুন্দরকে ছাড়িয়ে আজও উঠতে পারিনি।’ জরাগ্রস্ত, আলস্যপীড়িত ও দাসসুলভ পরাধীন জাতিকে ঝাঁকি দিয়ে চাঙ্গা করতে সেই শক্তিসুন্দরের বিকল্পও তো নেই। কাজেই যতদিন ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে’, ততদিন শক্তিসুন্দরের স্বরূপে শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে নজরুল আমাদের আপন সত্তায় জেগে থাকবেন। শুধু দ্রোহ নয়, প্রেমের সারথি হয়েও।
এ বছর গত ১৪ মে পূর্ব লন্ডনে ‘শিকড়’ আয়োজিত ‘বহুজাতিক কবিতা সন্ধ্যা’য় ব্রিটিশ কবি ডেভিড লি মর্গান নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আবৃত্তি করলেন। বিস্ময়কর আবেগ-আন্তরিকতা নিয়ে কবিতাটি তিনি উপাদেয় করে তুলেছেন। বাচন ও দেহভঙ্গি ছিল কবিতার দুর্দান্ত গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। কাজেই আজকের দিনে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা অনিবার্যভাবে স্বীকৃত হচ্ছে।
শেলির কবিতার প্রাণপ্রাচুর্যের সঙ্গে নজরুলের প্রাণোচ্ছ্বাস বহুলাংশে সমিল। হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেলফ’ কবিতায় যে-সর্বজনীন ‘আমি’ তথা ‘আমিত্ববোধ’, তার সঙ্গে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ‘আমি’ও সামঞ্জস্যশীল। নজরুলের অহংবোধ ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে ব্যক্তিনিরপেক্ষ সর্বজনীন ‘আমি’তে রূপান্তরিত। তবে নজরুলের দ্রোহী চেতনার যে-প্রলয়ংকরী ঝংকার, হুইটম্যানের কবিতায় তা নেই।
জীবনকে উদ্দীপিত করার বৈশিষ্ট্য নজরুলের সব প্রধান কবিতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় যে-জয়ধ্বনি ‘তড়িৎ চাবুক হানে’ তাতে কেবল তারুণ্যই উচ্ছ্বসিত আবেগে জেগে ওঠে না, জরাগ্রস্ত বৃদ্ধরাও দুরন্ত অনুভবে বুঝতে পারেন, ‘প্রলয় নূতন সৃজন বেদন।’ আর ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘জাম-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও।’ কাজেই এ কথা স্মরণ রাখা জরুরি, নজরুলের কবিতায় আমরা এত-যে ভাঙন লক্ষ করি তা সৃজনের পূর্বশর্ত। ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতায় ‘রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে’ যে ‘দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে’র প্রসঙ্গ, তাও সৃষ্টির উন্মাদনা; দুর্মর প্রাণপ্রাচুর্যভরা সেই অন্তর্গত উদ্দীপনাকেই তিনি বহির্জগতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাতেও অপূর্ব প্রাণোচ্ছ্বাস ছত্রে ছত্রে সঞ্চারিত। সেই রোমান্টিক প্রাণপ্রণোদনা অনেকটাই বহির্জগৎ থেকে কবির গহনে প্রবেশ করেছে। নজরুলের কবিতার যে-অনুভব, অনেকটাই তার বিপরীত ধারায়। ‘থর থর করে কাঁপিছে ভূধর’; আর সেই কম্পনে উচ্ছ্বসিত রবি ঠাকুরের অন্তর্জগৎ। তাই তার বিস্ময়—‘আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর।’ প্রাকৃতিক প্রাণশক্তি তার নিজের ভেতরে আত্মজাগরণ ঘটিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে উদ্দীপিত। আর নজরুল উদ্দীপক। এই দুই কবিতার প্রেক্ষিতে তাদের পার্থক্য অন্তরে নেওয়া আর অন্তর দেওয়ার মধ্যে।
নজরুল তার সৃষ্টিসুখের মধ্য দিয়ে যে-আত্মশক্তি অর্জন করেছেন, তা জনজাগরণের স্বার্থে বিস্তার করতে চেয়েছেন। তাই তিনি দুর্মর ও দুর্দমনীয়। ‘শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী’ ধ্বংস করে দিতে ‘ভাঙার গান’ গাইতে পারেন দুর্দণ্ড প্রতাপে। ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ লিখে বঞ্চিত মানুষের বুকে সাহস সঞ্চার করতে পারেন, আর হতে পারেন সত্যিকারের প্রাণোদ্দীপক। জীবনকে তিনি উজ্জীবনে উত্তীর্ণ করেছেন। যাপনকে দিয়েছেন উদ্যাপনের মহিমা। এখানে তিনি শিল্পোত্তীর্ণ। এ কারণে নজরুলের কাছে আমাদের ফিরতে হয়, বারবার। কেননা জীবন যখন কাতর করে তোলে, তখনই প্রয়োজন উজ্জীবন। যাপন যখন প্রাত্যহিকতার ভারে ক্লান্তিকর, তখনই দরকার উদ্যাপনের।
জাতীয় জীবনের বিভিন্ন কালপর্বে কবি ও কবিতার ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কবিতার এই জাতিবাদী অবদানকে তাই সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠী কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে। ঐতিহাসিক স্মরণিকা হিসেবে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে পাঠযোগ্য করে তোলে। ঔপনিবেশিক আমলের ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতার মৌলমন্ত্রে মানুষকে জাগ্রত করার যে অনন্য ভূমিকা রেখেছে নজরুলের কবিতা ও রচনা, তার তুলনা দুষ্কর। বাঙালিত্বের চেতনা ছিল তার মননে। বলেছেন, “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাঙলা’, সেদিন তারা সাধ্য সাধন করবে।”
বাঙালিত্বের এই চৈতন্যকে ধারণ করেছেন বলেই হয়তো ১৯২৯ সালে কলকাতা শহরের এলবার্ট হলে নেতাজি সুবাস বসু ও আচার্য প্রফুল্ল রায় নজরুলকে বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিমকে তিনি বিবেচনা করেছেন ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম’ হিসেবে। কাজী আবদুল ওদুদ ঠিকই বলেছেন, ‘যে বৃহৎ জীবনের অথবা জাতীয় জীবনের চেতনা দেশে অনুভূত হয়েছে, তাতে তারও প্রতিভার স্পর্শ লেগেছে। এই জনজাগরণের দিক থেকে দেখলে সহজেই চোখে পড়ে নজরুলের ঐতিহাসিক মর্যাদা কত বড়।’
জাতের নামে বজ্জাতিকে ঘৃণা করতেন বলেই তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সর্বজাতের, সর্বমানবের। একথা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন; বলেছেন, ‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, জাতিসত্তার সকল চেতনা সম্বল করেও তিনি অনন্যসাধারণ এক বিশ্ববোধে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ‘সংকল্প’ নামক কবিতায় ‘দেখব এবার জগৎটাকে’ এই ঘোষণা দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শিশু-কিশোরদের। কবি হিসেবে এই ঔদার্যের মধ্যেই লুক্কায়িত আছে তার ব্যক্তিত্বের দার্শনিক সত্তা। দার্শনিকের কাছে জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক যে-প্রত্যয় আমরা আশা করি, কবির কাছ থেকে সেই বাণীবদ্ধ প্রজ্ঞা হয়তো পাওয়া যাবে না; কিন্তু নজরুলের জীবনাদর্শের মধ্যে সর্বমানবের প্রতি যে অকুণ্ঠ মমত্ববোধ সক্রিয়, সেখানে একটা দার্শনিক ভাবাদর্শ প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে।
কবিতার আধুনিকতা মানে দেবতা নয়, মানুষকে বড় করে দেখানো। এক্ষেত্রে আধুনিক মননচর্চায় তিনি তিরিশের আধুনিক কবিদের চেয়েও বেশি অগ্রসর। ‘মানুষ’ কবিতায় বললেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ ‘নারী’ কবিতায় দেখালেন তার চোখে ‘পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’ এ সময়ের প্রখর নারীবাদী প্রবণতার আগেই তার এই আধুনিক বয়ান। ‘সাম্যবাদী’ কবিতাসহ অপরাপর বহু কবিতায় বৈষম্যবিহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা তিনি প্রকাশ করেছেন। কাজেই তিরিশি আধুনিক কবিরা ব্যক্তিসত্তা ও কবিসত্তার মধ্যে যে কৃত্রিম ভণিতার প্রশ্রয় দিতেন, নজরুলের মধ্যে তা ছিল না। কবিতায় তিনি যা প্রকাশ করেছেন ব্যক্তিগত জীবনে তা-ই বিশ্বাস করতেন। এই কাব্যিক তথা সাহিত্যিক সততা তাকে বিশিষ্ট করেছে।
বিনয় সরকার বলেছেন, ‘নজরুল-কাব্যের প্রথম মুদ্দা বিপ্লব, আর দ্বিতীয় মুদ্দা ভালোবাসা।’ কাজী আবদুল ওদুদ নজরুলের মধ্যে জন্মগত তাত্ত্বিকতা আবিষ্কার করেছেন। সেই তত্ত্বের নাম দিয়েছেন লীলাবাদ, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ করেছেন Pantheism, যেখানে সবকিছুই ঈশ্বরের লীলা হিসেবে স্বীকৃত। যদিও Pantheism-এর বাংলা সমার্থক হিসেবে আমরা জানি ‘সর্বেশ্বরবাদ’কে। যাই হোক, নজরুল-কাব্যে এই মরমি দার্শনিক প্রবণতা কতটা গভীরে প্রোথিত তা গবেষণার বিষয়। তবে দুর্জয় শক্তির প্রতি তার অভিনিবেশ অনেকটা উপাসনার মতো। তার উচ্চকিত কাব্যভাষার পেছনে এটিও কারণ হতে পারে। জীবনকে গতিশীল করতে এবং মানুষের কানে পৌঁছানোর তাগিদ থেকেই হয়তো দার্শনিক গভীরতা নয় বরং নান্দনিক ‘কলহ’কে তিনি কবিতায় উপজীব্য করেছেন। শিল্পতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যা-ই হোক, কবিতাকে প্রায়োগিক সত্যে প্রতিষ্ঠা দিতে এই সরবকণ্ঠ অসামান্য ভূমিকা রাখে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ হয়তো এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই কাব্যগ্রন্থের নামই দিয়েছেন ‘Howl’ বা ‘চিৎকার’। আর নজরুল নিজেই বলেছেন, ‘এ-কথা স্বীকার করতে আজ আমার লজ্জা নেই যে, আমি শক্তিসুন্দর রূপ-সুন্দরকে ছাড়িয়ে আজও উঠতে পারিনি।’ জরাগ্রস্ত, আলস্যপীড়িত ও দাসসুলভ পরাধীন জাতিকে ঝাঁকি দিয়ে চাঙ্গা করতে সেই শক্তিসুন্দরের বিকল্পও তো নেই। কাজেই যতদিন ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে’, ততদিন শক্তিসুন্দরের স্বরূপে শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে নজরুল আমাদের আপন সত্তায় জেগে থাকবেন। শুধু দ্রোহ নয়, প্রেমের সারথি হয়েও।
গাজা পুনরুদ্ধারের এই সময়ে ‘ফিলিস্তিন সাংস্কৃতিক পুরস্কার’ ঘোষণা করেছে ‘ফিলিস্তিন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট’। ১৩তম আসরের মূল থিম নির্ধারণ করা হয়েছে—‘জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা, গোটা ফিলিস্তিন ও জায়নবাদের বিরোধিতা’।
৩ দিন আগেএকশ বছর আগের কথা। ১৮৮৯ সাল। তুরিনে আজকের মতোই এক দিনে ফ্রিডরিখ নিৎশে কার্লো আলবার্তো পথের ৬ নম্বর বাড়ির ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন। কখনো হাঁটতে বের হতেন, আবার কখনো পোস্ট অফিসে চিঠিপত্র তুলতে যেতেন।
৪ দিন আগেবাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী আয়োজিত ইসলামি বইমেলায় প্রতিদিনই জড়ো হন হাজারো মানুষ। বিশেষত সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে বইপ্রেমীদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। আর এই জনস্রোতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একদল স্বপ্নবাজ তরুণের হাতে গড়া ‘লিটলম্যাগ কর্নার’।
৪ দিন আগেইসলাম-পূর্ব সময়ে এক ভয়ংকর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল যেন আরবরা। সমগ্র আরবে চলছিল ভয়াবহ অরাজকতা। গোত্রে গোত্রে শত্রুতা। সারাক্ষণ একে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টায় রত। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি ও মারামারি থেকে শুরু করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া; বছরের পর বছর ধরে সেই যুদ্ধ চলা।
৪ দিন আগে