আমার দেশ অনলাইন
হাসান রোবায়েত। কবি। ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে যার কবিতা বিশেষভাবে আলোচিত। গণঅভ্যুত্থানেও তার কবিতা ছিল প্রাসঙ্গিক। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তার ‘সিঁথি’ কবিতাটি সপ্তম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে গত ৩ জুলাই নতুন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সাংবাদিকতা নিয়ে তার সাথে কথা বলেছেন সাহিত্য সম্পাদক মুহিম মাহফুজ।
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত অংশ ৫ জুলাই শনিবারের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়েছিলো। এবার অনলাইনে প্রকাশিত হলো পুরো সাক্ষাৎকার।
মুহিম মাহফুজ : অনেকে মনে করেন, আপনি প্রচলিত চাকরি করতে চান না। এটা অনেকটা আপনার প্রতিজ্ঞার মতো মনে হচ্ছে। শোনা যায়, অভ্যুত্থানের পর আপনার কাছে চাকরিবাকরির অফার এসেছিল। আপনি তাতেও আগ্রহী হন নাই। কেন এমন সিদ্ধান্ত?
হাসান রোবায়েত : প্রথম কথা হইতেছে, এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আমি পাইনি। মানুষ দূর থেকে যা মনে করে সেইটা আসলে ঠিক না। বিষয়টা আমি বলি, আমারে একবার আসিফ নজরুল সাহেব ফোন করেছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি হওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তখনও জানতাম না, একজন ট্রাস্টীর কী কাজ এবং টাকা-পয়সার ব্যাপার সেখানে কেমন। আমার কাছে মনে হয়েছে, ট্রাস্টি হওয়া আসলে সেই অর্থে টাকা-পয়সা উপার্জনের কোন জায়গা না। এরা কোন একটা প্রতিষ্ঠানে মুরুব্বী টাইপের দায়িত্ব পালন করে। ধরেন, কোন একটা ডিসিশন নিতেছে প্রতিষ্ঠান, সেক্ষেত্রে তাদের সাথে আলাপ পরামর্শ করে। আর ট্রাস্টীরা তো মনে হয় নিয়মিত অফিসও করে না। মাঝে মাঝে মিটিং-টিটিং থাকে, সেখানে এটেন্ড করে। সুতরাং এটা বিশেষ কোনো চাকরি বা আয়-রোজগারের বিষয় মনে হয় নাই আমার কাছে। আমারে এ পর্যন্ত কেউ চাকরি-বাকরির কথা বলে নাই আসলে।
মুহিম মাহফুজ: আপনি এখন যে কাজ করছেন, সেটা নিয়েও তো আপনি বেশ অকপট। খোলামেলা কথাবার্তা বলেন।
হাসান রোবায়েত: যেটা হইছে আসলে, আমি যখন টিউশনি নিয়ে ফেসবুকে কথা বলি, সেটা যে আফসোস থেকে বলি, তা না। এটা কোন আক্ষেপের জায়গা না। বরং আমি যেহেতু এই জায়গাটা নিয়ে কাজ করি, ফলে কী ধরনের প্রবলেম এখানে ফেস করতে হয়, কী ধরনের সুবিধা আছে, সেটা নিয়েই আমি কথা বলি। ধরেন, যারা চাকরি-বাকরি করে, তারা বিভিন্ন সময়ে, ঈদে-চান্দে, বোনাস পায়। আমরা যারা এখানে কাজ করি, এটা তো আসলে একটা কাজই, এই কাজে তো বোনাস নাই। আমি যেহেতু এটা ফেস করি, সেজন্য বলি। এটার মানে এমন না যে, আমি আমারে চাকরি বাকরি দিতে লোকজনরে বলতেছি।
মুহিম মাহফুজ: তাহলে যা করতেছেন এটা নিয়েই কি সন্তুষ্ট? এভাবেই থাকতে চান?
হাসান রোবায়েত: ঠিক সন্তুষ্ট, ব্যাপারটা তা না। আমি আসলে এমন কিছু করতে চাই নাই, যাতে আমার সুপিরিয়র বা আমার উপরের কর্মকর্তারে মানায়া চলতে হয়। কাজ তো করতেই চাই কিন্তু এভাবে না। আরেকটা বিষয় আমি মনে করি, আমার আসলে স্কিল নাই অন্য কোন কাজ করার।
মুহিম মাহফুজ: একই ধরনের কথা সারা জীবন আল মাহমুদ বলেছেন যে, লেখা ছাড়া আর কোন কাজ আমি পারি না। ফলে তিনি লেখার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের অনেক লেখকও নিজের স্বাধীনতা বজায় রেখে সাংবাদিকতা করেছেন।
হাসান রোবায়েত: আমার সাংবাদিকতা না করার অন্যতম কারণ, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিক্সে পড়াশোনা করছি, তখন, মানে সেই সময়টায় প্রচুর টিউশনি পাইতাম। টিউশনি করে আমি সে সময় যে টাকা ইনকাম করতাম, আমি ভাবতাম, হয়তো সাংবাদিকতা করে এটা পাওয়া মুশকিল। এটার ফিউচার কী- সেটা নিয়ে কখনো টেনশন ছিল না। টিউশনির যেটা মূল সমস্যা, সেটা হল, কোন নিশ্চয়তা নাই, কোন ফিউচার নাই। আমি যদি একটা কোচিং সেন্টার খুলতাম তাহলে আমার অভিজ্ঞতার জায়গাটা দিন দিন আরো বেটার হইতো। কিন্তু সেটা যেহেতু আমি করি নাই, তাই একটু প্রবলেম। সাংবাদিকতার দিকে আমি যাই নাই মূলত এই কারণে। এটার সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। তবে আমার কাছে তখন এমনটাই মনে হইতো।
মুহিম মাহফুজ : আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, সেই আওয়ামী আমলে আমরা তো দেখেছি, সাংবাদিক-সম্পাদক বা মিডিয়া সংশ্লিষ্ট লোকজনের মধ্যে টাকা ইনকামের একটা ব্যাপক সুযোগ ছিল, চর্চা ছিল এবং সেটা দেখাও যাইতো- এতটাই রমরমা বা জৌলুস ছিল। আবার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও এমন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা ছিল। অনেকে সেই সুযোগে অনেক কিছু করছে- এমন অনেক নজির আছে। শুধু এক দুইটা না।
হাসান রোবায়েত: একজন সাংবাদিক যদি লিগেলি শুরু থেকে কাজ শুরু করে, তাহলে তার তো এত টাকা হওয়ার কথা না। লিগেল ওয়েতে সেই সময়ে আমার চেয়ে বেশি ইনকাম করা একজন উঠতি জার্নালিস্টের জন্য মুশকিলই ছিল মেবি। সাংবাদিকরা কেমন টাকা-পয়সা ইনকাম করে, সেটা আসলে আমি জানি না তখন। যেহেতু তখন আমরা দেখতাম, সাংবাদিকরা ঠিকমতো বেতন পায় না, স্বাভাবিকভাবে চলতে কষ্ট হয়- এমন ঘটনা।
মুহিম মাহফুজ: সে সময়ে সাংবাদিকদের বেতন না পাওয়ার ঘটনা যেমন আমরা দেখেছি, দেখেছি সাংবাদিকদের বেতনের জন্য রাস্তায় আন্দোলন করতে হয়েছে এবং বেতন না দিতে পাইরা কোন কোন সংবাদপত্র বন্ধও হয়ে গেছে। আবার এই ঢাকা শহরেই আমরা দেখছি, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক পরিচয়ে কিছু মানুষ ব্যাপক সুবিধা নিচ্ছে, ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক হয়ে গেছে। একই শহরের মধ্যে, একই সমাজের মধ্যে দুইটা শ্রেণীর দুই রকম চরিত্র এবং চর্চা আমরা তো দেখছি।
হাসান রোবায়েত: ওয়েলফেয়ার স্টেটগুলোতে যেমন ইনসাফপূর্ণ সমাজ থাকে, আমাদের সমাজ তো আসলে সেরকম না। আমাদের সমাজে সেই ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। আর এটা না হলে সমাজের মধ্যে এ ধরনের অনৈতিকতা হবে এটাই স্বাভাবিক।
মুহিম মাহফুজ: সেই জুলুম ও অনৈতিকতার চূড়ান্ত ধাপে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন যখন জাইগা উঠলো, তখন আমরা দেখলাম, সমাজের সোকল্ড বুদ্ধিজীবীদের, শিল্পী সাহিত্যিক-কবিদের বড় একটা অংশ এটাকে ধরতে পারল না বা নিজেদের যুক্ত করতে পারলে না। তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত বিরোধী পক্ষেই থাকলো। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ আসলে ফেইল করলো, এত বড় একটা অভ্যুত্থানকে ধারণ করতে পারলো না। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার জন্য তো এটা একটা ব্যর্থতার ঘটনা।
হাসান রোবায়েত: আমার কাছে এটা কোন বড় ঘটনাই না। আমি দেখি অন্যভাবে। একটা বড় অংশ যেমন ওন করেন নাই। আরেকটা বড় অংশ তো ওন করছে। আমি ওন করছি, আপনি ওন করছেন। না করলে এত বড় অভ্যুত্থান হইলো কেমনে? যারা অভ্যুত্থানে আসে নাই বা ওন করতে নাই তারা সামনেও পারবে না।
মুহিম মাহফুজ: কেনো পারলো না?
হাসান রোবায়েত: কারণ তারা তো আসলে স্টাবলিশমেন্টের লোক। হাসিনা রেজিমের যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে তো তারা সমস্যায় পড়ব। তাদের যে ইনকাম, তাদের যে ঈমান বা বিশ্বাস, সেটা তো হাসিনা রেজিমের ন্যারেটিভের উপরে। তাদের শিল্প সাহিত্যের যে চিন্তাভাবনা সেটা তো বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা মনেই করে যে, অভ্যুত্থান তাদের জন্য একটা পরাজয়। বেঙ্গলি রেনেসাঁ থেকে যে বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের জন্ম হইলো, তারা তো সেই বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের লোক। বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের মুরিদের কাছ থেকে আপনি কখনো ওয়েলফেয়ার স্টেটের ইনসাফ পাওয়ার আশা করতে পারেন না।
মুহিম মাহফুজ : বাংলাদেশের কবি হিসেবে বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম নিয়ে আপনার সমালোচনা কোন পয়েন্টে?
হাসান রোবায়েত: হাসান রোবায়েত: বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম তো একটা লিনিয়ার ধারণা। একটা একরৈখিক আদর্শ। এইটা বাংলাদেশের ডাইভারস সোসাইটি বা বহুমমতের সমাজরে ফাংশন করতে দেয় না। যেমন বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ মনেই করে যে মুসলমান একটা অন্য ঘটনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা আপনারে একটা বাইনারির মধ্যে ফালাইতে চায়। খুব কায়দা করে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি মুসলমান না বাঙালি? যেন আমি বাঙ্গালি হইলে মুসলমান হইতে পারবো না অথবা মুসলমান হইলে বাঙ্গালি হইতে পারবো না। কিন্তু বিষয় হইলো, বাঙালি কালচারটা তৈরিই করছে মূলত মুসলমানরা। কোট আনকোট এটা মুসলমানরাই তৈরি করছে। আপনি সুলতানি আমল থেকে শুরু করেন। সেনদের আমল শেষ হইল কেনো? কারণ এখানে মুসলমানদের আগমন ঘটল। আমি যদি ভাষার প্রশ্নে আসি, বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব নজির সেগুলোর অধিকাংশই তৈরি হয়েছে মুসলিম আমলে। আমি নাম ধরে বলতে পারি। রামপ্রসাদ হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণদের মধ্যে একজন। ভারতচন্দ্রের কথা বলা যায়। উনারা তাদের গ্রেট কাজগুলো করছেনই মুসলমান আমলে। মুর্শিদকুলি খাঁ থেইকা নবাব সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত টাইমলাইনে বহু কাজ হইছে। মুসলমান শাসকরাই মূলত বাঙ্গালি কালচাররে দিনে দিনে ডেভেলপ করছে। উনিশ শতকে যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা হলো, তখন হিন্দু পন্ডিতদের দিয়ে বাংলা ভাষাকে আরেকবার সাইজ করা হইলো। সেইটা আসলে আর বাংলা ভাষাই থাকল না। সেটা সংস্কৃতবহুল একটা বিশেষ বাংলা। যেটা আমার ভাষা হিসেবে আমার চিনতেই কষ্ট হয়। আপনি যদি বাংলা কবিতার সিলসিলা টাইমলি ধরে ধরে পড়েন, একেবারে চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগ হয়ে, চন্ডীদাস, রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র, এরপর মাইকেল মধুসূদনে এসে আপনি কিন্তু এই ভাষাটা চিনতেই পারবেন না। যে ভাষাটার বিকাশ হইতেছিল চর্যাপদ থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের আগ পর্যন্ত, সেটার বিকাশ হঠাৎ থামায়া দেওয়া হইলো। মুসলমানরা বাংলা সাহিত্যে যে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্জাম দিছেন এটা ভুলায়া দেওয়ার জন্যই মূলত এমনটা করা হইল। ফলে, আমি মনে করি বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম মূলত এটার বাই প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষার যে উন্নতি সেটা বাঙ্গালি ন্যাশনালিজম নষ্ট করছে। আমাদের এখানে বহুমুখী সোসাইটির তৈরি করার সম্ভাবনা তারা নষ্ট করছে। এবং এটা সম্ভব হইছে বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্তির কারণে। বাহাত্তরের সংবিধানের কারণে পাহাড়ের মানুষরে দূরে রাখা হয়েছে, ধীরে ধীরে মুসলমানদের আলাদা করা হইছে। এজন্য আমি এটাকে ক্রিটিকালি দেখি।
মুহিম মাহফুজ: ফোর্ট উইলিয়াম যে সংস্কৃতবহুল সাধু বাংলার প্রচলন করলো সেটা কিন্তু অল্প দিনে, কয়েকশো বছরে ফেল করলো। মানে এটা আর চলার উপযোগী থাকলো না। এর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা যে প্রমিত বাংলার প্রচলন করল, বাংলাদেশে আমরা কয়েক দশক ধরে দেখতেছি সেটার প্রভাব কমতেছে। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষা সাহিত্যে গুরুত্ব পাচ্ছে। মুসলমান আমলে গড়ে ওঠা যে বাংলা ভাষার কথা আপনি বললেন, আর বাংলাদেশের সাহিত্যে যে ভাষার চর্চা আমরা নতুন করে বাড়ছে বলে দেখতে পাচ্ছি, সেটা কি সুলতানি আমলের বাংলা ভাষার লিগেসি? মূলে ফিরে যাওয়া?
হাসান রোবায়েত : নতুন কইরা চর্চা শুরু হইছে আমি সেটা মনে করি না। আমি মনে করি এখানে চর্চা হইতেছিল। কিন্তু আমরা সেটা ফাইন্ড আউট করতে পারি নাই। ধরেন আমাদের বাংলাদেশের যে গান বা কবিতা, আপনি যদি শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমণ, হাসন রাজা বা লালনের কথা ধরেন, ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলায় উনারা কিন্তু লেখেন নাই। আমাদের এখানে এই চর্চাটা ছিল। এমনকি রিটেন লিটারেচারেও ছিল। কিন্তু সমস্যা যেটা, এই লিটারেচারগুলারে আমরা ফোক নাম দিয়ে দিছি। এগুলো মূলত বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম লিটারেচার। সেটা না বইলা আমরা বলছি ফোক মানে আলাদা। মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই লিটারেচারগুলোকে ফোক লিটারেচার বানাইছে। অর্থাৎ আমাদের এখানে এই চর্চা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আমরা আইডেন্টিফাই করি নাই। এখন হয়তো আইডেন্টিফাই করা হবে। কারণ অনেকেই এটা নিয়ে আগ্রহী হইতেছে।
মুহিম মাহফুজ: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যে আমরা আসলে বাংলাদেশ কনসেপ্ট বা বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং জিনিসটা মিস করতেছিলাম।
হাসান রোবায়েত: হ্যাঁ। বাংলাদেশের কবিরা মূলত এই ঝামেলা পাকাইছে। বাংলাদেশের সো কল্ড মেইনস্ট্রিম কবি, যারা মনে করতেছে তারা ফোক না, তারা কলকাতার কলোনিয়াল বাংলাটারে ধইরা রাখছে। যেহেতু তখন কলকাতার প্রভাব ছিল। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কুল-কলেজে যে বাংলা শেখানো হয় সেইটা তো কলোনিয়ান বাংলা। সেই কলোনিয়াল বাংলার চক্রের মধ্যে থাকার কারণে অধিকাংশই আসলে জানে না যে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা কোনটা! কলোনিয়াল ভাষা দ্বারা অধিকাংশ মানুষ এতটাই আক্রান্ত তারা যে, এটারেই তারা নিজের ভাষা মনে করত। আমাদের ভাষাটাকে একটা আনস্মার্ট ভাষা মনে করত। বই পুস্তকে বা স্কুল-কলেজে যে ভাষাটা শেখানো হতো সেটাকেই মনে করত স্মার্ট বাংলা। এখানে মূলত কবিরাই ফেইল করছে। তারা বাংলাদেশের ভাষা ধরতে পারে নাই। আমার ধারণা কিছু মানুষ বাদে এখনো কবিরা ফেল করতেছে। এটা নিয়ে খুব কম মানুষই ক্রিটিকালি চিন্তা করছে। তবুও এই ভাষাটাই ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে।
মুহিম মাহফুজ: কতটা প্রভাবশালী হতে পারে? একাডেমিয়াসহ সরকারি-বেসরকারি জায়গায় এটাকে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে বা একসেপটেবল জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে করেন?
হাসান রোবায়েত: গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা জানি না। দ্রুত এমন কিছু হওয়ার লক্ষণও আমি দেখতেছি না। কিন্তু নিজেদের লিটারেচারে কবিরা এবং অন্যরা এটার চর্চা করবেন। আমার ধারনা, কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই এই ভাষায় লিখতে আগ্রহী হবে। তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসবে। সরকারি জায়গার বিষয়ে আমি অতটা আশাবাদী না।
মুহিম মাহফুজ: অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নানারকম সংস্কার প্রকল্প চলছে। সংস্কারের, বিশেষভাবে রাজনৈতিক সংস্কারের নানারকম উদ্যোগ-ব্যবস্থা আমরা দেখছি। কিন্তু একটা রাষ্ট্র তো শুধু রাজনীতি দিয়ে চলে না, রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে সংস্কৃতি। তো রাজনৈতিক সংস্কারের আলাপ জোড়েশোরে চললেও সাংস্কৃতিক সংস্কার নিয়ে এ পর্যন্ত কোন আলোচনা বা উদ্যোগ আমরা দেখছি না। এটা একটা শূন্যতা কিনা? আর সংস্কৃতির সংস্কার না করে রাষ্ট্র সংস্কারের সাফল্য কতটা পেতে পারি আমরা?
হাসান রোবায়েত: কালচারাল সংস্কার তো চাপায়া দিয়া আসলে করা যাবে না। কালচারের সংস্কারের জায়গায় কেউ কারো কাছে বাধ্য না বা কেউ কারো চাকরি করে না। ব্যক্তি নিজের জায়গা থেকে এটা করে, গান লেখে কবিতা করে সিনেমা বানায়। তবে এখানে অবশ্যই ফাইন্ড আউট করা যাইত যে, কোথায় আমরা ফেল করতেছিলাম? কোনটা হওয়া উচিত? তবে কোন কিছু চাপিয়ে দেওয়া আসলে মুশকিল যে, এটা করতে হবে অথবা এটা করা যাবে না।
মুহিম মাহফুজ: নিশ্চয়ই। তবে প্রমিত বাংলা, আপনি যেটাকে কলোনিয়াল বাংলা বলছেন, সেই বাংলা তো রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো চাপায়া দিচ্ছে।
হাসান রোবায়েত: হ্যাঁ। এটা চাপায়া দিছে। এটা এমনভাবে চাপায়া দেওয়া হইছে যে এটারে আর চেঞ্জ করার দিকে আগানো যাইতেছে না এখনো। এটা নিয়ে কারো কোন অবজারভেশনই দেখতে পাইতেছি না।
মুহিম মাহফুজ: চিন্তার জায়গা সেটাই। আমরা এসব বিষয়ে মিনিমাম কোন অবজারভেশন পাচ্ছি না। ফলে প্রশ্ন উঠছে, মৌলিক সাংস্কৃতিক সংস্কার ছাড়া টেকসই সংস্কার কতটা পসিবল হবে?
হাসান রোবায়েত: ওই যে বলে না, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই গভমেন্টের সময় হয়তো হয়নি। তার মানে আগামী গভমেন্টের সময় যে হবে না, তা তো আমি মনে করি না। সামনের সরকারের আমলে হইতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা এবং সভা-সেমিনার হওয়া উচিত। গবেষণা প্রবন্ধ লেখা উচিত। না হলে যারা সংস্কার করবে তারা এটা ফিল করতে পারবে না। কারণ যারা পলিটিশিয়ান, তারা যে কালচারের সব বিষয়ে জানেন এমন তো না। তাদেরকে তো জানাইতে হবে।
আমি মনে করি যে জায়গাটা আমরা সবচেয়ে বেশি মিস করছি, সেটা হল শিক্ষার সংস্কার। এডুকেশন নিয়ে আমি কাউকে তেমন কোনো কথাই বলতে দেখলাম না। বরং শিক্ষা নিয়ে আমরা বড় রকমের সংস্কার করতে পারতাম। আগামী পাঁচ সাত বছরের মধ্যে আমাদের এডুকেশন সেক্টর কে কোথায় দেখতে চাই, কিভাবে সাজাতে চাই, কি কি পড়ানো উচিত, এগুলো নিয়ে কোন আলাপই হইতেছে না। কিন্তু আমি শ্চর্যজনকভাবে সেই ডিবেটে কারো কোন আগ্রহই দেখলাম না।
মুহিম মাহফুজ: শিক্ষা এবং সংস্কৃতি দুইটা জায়গা আমরা চিহ্নিত করতে পারলাম। এই জায়গাগুলোতে সংস্কারের দায় ও দায়িত্ব কাদের আসলে?
হাসান রোবায়েত: সরকারের, নিশ্চয়ই সরকারের।
মুহিম মাহফুজ: সরকারের সংস্কার প্রকল্পে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সমর্থন ছাড়া হয় না। আবার কোনো কোনো সংস্কার কাজে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো সমর্থন দিতেও চায় না।
হাসান রোবায়েত: আমার মনে হয়, এডুকেশন সেক্টর রিফর্মেশনের কাজে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর খুব একটা বাগড়া দেওয়ার জায়গা থাকবে না। ব্যাপারটা এরকম না যে, এডুকেশন রিফর্ম হইলে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো বড় ধরা খেয়ে যাবে। বরং সরকার যে এটাকে একটা সমস্যা বা সমাধানযোগ্য বিষয় হিসেবে প্রেজেন্ট করতেই পারল না, এটা বরং এই সরকারের একটা ব্যর্থতা।
মুহিম মাহফুজ: কালচারের প্রশ্নটা আমরা অন্যভাবে আবার করি। গত দেড় দশক আওয়ামী রেজিম টিকে ছিল এক তো প্রশাসনের সহযোগিতায়। আরেক দিকে তার যে মিডিয়া ও কালচারাল স্টাবলিশমেন্ট ছিল, তার প্রত্যক্ষ মদদে। ফলে অভ্যুত্থান পরবর্তী কোন রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করে বা রাষ্ট্র পরিচালনার স্বপ্ন দেখে, তার তো এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা এবং চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত, পুরনো কালচারাল এবং মিডিয় স্টাবলিশমেন্ট ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত করতে হবে। এই জায়গায় পার্টিগুলোকে কতটা উদ্যোগী বা আগ্রহী দেখতে পাচ্ছেন?
হাসান রোবায়েত: আমি তো সেভাবে দেখতে পাইতেছি না। প্রথম কথা হইতেছে , আমার চোখে পড়েনি, মানে যে তারা ভাবতেছেন না সেটা নাও হতে পারে। তবে আমার চোখে পড়েনি। আর আমি আগে বলছি যে এডুকেশন এর মত মৌলিক বিষয় নিয়ে আমি খুব আপসেট। কালচার নিয়ে আর কি বলব।
মুহিম মাহফুজ: অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সমন্বয়ে যে পার্টি হল, এনসিপি, এ বিষয়ে তাদের এক্টিভিটি বা ইনটেনশন কেমন দেখছেন?
হাসান রোবায়েত: তাদের কোনো ভাবনাও তো দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো তারা কনস্টিটিউশন নিয়ে অনেক ভাবতেছেন, ইলেকশন সিস্টেম নিয়ে অনেক ভাবতেছেন, কিন্তু তারা এখনো আমাদের বুঝাইতে পারেন নাই, এডুকেশন নিয়ে তারা কী করতে চান, মানে আমার নজরে পড়ে নাই। তাদের চিন্তায় হয়তো এডুকেশন জিনিসটাই নাই। অথচ আপনি দেখবেন, তারা প্রত্যেকেই ছাত্রনেতা, প্রত্যেকেই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে আসছে। তাদের তো এটা নিয়ে আরও বেশি কথা বলা উচিত ছিল। অথচ তারা কিছুই বলতেছে না। এ অবস্থায় কালচারের বিষয়টা তো অনেক পরের। কারণ কালচারের চর্চার জায়গাটা তো ব্যক্তিগত। কিন্তু শিক্ষার জায়গাটা মোটেই ব্যক্তিগত না। একটা জাতীয় উদ্যোগ এবং জাতীয়ভাবে সেটা সম্পাদিত হয়।
মুহিম মাহফুজ: কালচার নিয়ে কী ধরনের রিফর্ম হতে পারতো বা হওয়া উচিত?
হাসান রোবায়েত: আমাদের দেশে কালচারের নামে এতদিন কী কী হইছে কিভাবে হইছে তার একটা ক্রিটিক্যাল রিডিং শুরু হতে পারতো। কিন্তু আমি আসলে দেখতেছি না। হয়তো সামনে হবে। বড় বড় পলিটিক্যাল পার্টিগুলো ভাববে এসব নিয়ে। আমি বিশ্বাস করি এটা হবে, আজ অথবা আগামীকাল।
মুহিম মাহফুজ: ২৪-এর অভ্যুত্থানে আমাদের ইয়ং ইন্টারেলেকচুয়াল এবং শিল্পী-সাহিত্যিকদের যথেষ্ট সাহসী এবং অগ্রসর পদক্ষেপ রাখতে দেখেছি। অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রায় এক বছর আমরা অতিক্রম করলাম। এই এক বছরে সেই বিপ্লবী গোষ্ঠী এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে উল্লেখযোগ্য- এমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা বা ভূমিকা রাখতে পারার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারছে কিনা?
হাসান রোবায়েত: আমার চোখে অন্তত পড়ে নাই, এটা প্রথম কথা। আমি আবারো বলি, যা আমার চোখে পড়ে নাই তা যে ঘটতেছে না, তা না। হয়তো ঘটতেছে কিন্তু আমার চোখে পড়ে নাই।
মুহিম মাহফুজ: আপনার চোখে কী ধরা পড়তেছে?
হাসান রোবায়েত: আমার চোখে যেটা ধরা পড়তেছে সেটা হইল, ধরেন কোন একজনের ভালো সিনেমা বানানোর কথা ছিল। কিন্তু সে এখন মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করে ফেলছে। অনেকেই এমন আছে যারা তাদের ড্রিমের জায়গা থেকে সইরা আসছে। একটা জাতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করলে এটা একটা ক্ষতির ব্যাপার, আমি মনে করি। এ কারণে আপনি যত পলিটিক্যাল এনালিটিক পাবেন, যত কমেন্টেটর পাবেন, তত ভালো কবি পাবেন না, উপন্যাসিক পাবেন না। আরেকটা ব্যাপার হইলো, এ ধরনের বড় রকমের কোন ঘটনার পরে সম্ভবত এমনটা হয়, হয় হয়ত। তবে ১০ বছর পরে যারা আসবে কাজ করতে, তারা হয়তো নিজেদের মতো করে আবার শুরু করবে। নিজেদের জায়গাটা খোঁজার চেষ্টা করবে।
মুহিম মাহফুজ: আপনি আগে যেটা বলে আসলেন যে, বাংলাদেশের আর্ট-কালচারের আইডেন্টিফিকেশন হয় নাই। এটা একটা শূন্যতার জায়গা। ২৪-এর পরে যখন আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের কথা বলছি, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা কর, তখন সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের বিষয়টা তো নজরে নিতে পারি।
হাসান রোবায়েত: কালচারাল সভরেন্টি ধারণাটার সঙ্গে আমি এই মুহূর্তে একমত হইতে পারতেছি না। কারণ এটা নিয়ে আমি আসলে আগে ভাবি নাই। আমি আসলে একটু অন্যভাবে ভাবছি। সেটা হল, আমার কালচার আমার চর্চা করতে হবে এটা যেমন সত্য, আবার কাউকে আমি যদি বলে দেই যে, তোমার এটা করতে হবে বা এটা করতে পারবা না, তখন তো কালচারাল সভরেন্টি টিকে থাকবে না। আমি মনে করি আর্ট ইটসেলফ একটা দুনিয়া। আমি আসলে সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে একটু ডিফার করি। কারণ এর মধ্য দিয়ে একঘেয়ে শিল্প-সাহিত্য তৈরি হওয়ার বিষয় থাকতে পারে। তখন দেখা যাবে, সবাই একই রকম লিখতেছে। সবাই অনেক দেশপ্রেম করতেছে। তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারায়া যাবে। তবে একটা কমন জায়গায় তো একমত হওয়ার বিষয় অবশ্যই আছে।
মুহিম মাহফুজ: কমন জায়গায় একমত হওয়ার বিষয়েই আমরা আসতে চাচ্ছি। কারণ ফ্যাসিবাদী আমলে আমরা দেখছি, সংস্কৃতির ভিন্নমতের কারণে বিভিন্ন পক্ষকে অপরায়ন করা হয়েছে, সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হইছে- দেশের ভেতরে এরকম একটা অবস্থা ছিল। আবার আপনি বাইরে থেকে দেখলে দেখবেন, বাংলাদেশের উপরে ভারতের কালচারাল হেজিমনি সবসময় ছিলো, এখনো আছে, সেটাও আমাদের মোকাবেলা করে আসতে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশি কালচারের জায়গাটা তো আমাদের আইডেন্টিফাই করা প্রয়োজন আসলে। একটা কমন জায়গা থেকে তো আমাদের বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারার ব্যাপার থাকে।
হাসান রোবায়েত: হ্যাঁ, এইটা তো ঠিক। আমেরিকা এবং বৃটেনের ভাষা ইংরেজি। কিন্তু তাদের লিটারেচারের স্টাইল আলাদা। সেটা তো আমাদের এখানেও হইতে পারে। তবে আমি যেটা বলছি, এটা রাষ্ট্র যেন ঠিক না করে দেয় যে, এটা করতে পারবা না। তাহলে সেটা উত্তর কোরিয়ার মডেল হয়ে যাবে। তবে সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব না বলে আমি বলতে চাই, কালচারের ব্যাপারে একটা সামগ্রিক ধারণা জাতিগতভাবে সবার থাকা জরুরি। যেকোনো আর্টিস্টের জন্যই এটা জরুরি। এর মধ্য দিয়া সে বাংলাদেশি হয়ে উঠবে। তার মধ্যে বাংলাদেশ পাওয়া যাবে। এবং সাথে সাথে সারা দুনিয়াও সেটা নিতে পারবে। এতদিন পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের ভাষাটারে নিতে পারি নাই। মনে করছি, এটা একটা খ্যাত ভাষা। এই ঘটনা আর যেন না ঘটে।
মুহিম মাহফুজ: বিশ্বের যেসব দেশে দীর্ঘসময় ফ্যাসিবাদ ছিল, প্রতিরোধ সাহিত্যের একটা ধারা এসব দেশে গড়ে উঠতে দেখা গেছে । যেমন, আমরা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সাহিত্যের কথা বলতে পারি। বাংলাদেশে এত লম্বা সময় ফ্যাসিবাদ টিকে ছিল। এই সময়ে আমরা কি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিরোধ সাহিত্য তৈরি করতে পারছি বা এই ধারার যথেষ্ট সংখ্যক রচনা কি আমরা পাই?
হাসান রোবায়েত: না, তা পাই না। ধরেন, অনেক বেশি রাইটার আমরা পাইনি সত্য, কিন্তু কিছু রাইটার তো পাইছি। এখন আমি যেটা বলি, আমরা যাদের পাইছি, ভিন্ন ঘরানার লিটারেচার হিসেবে আমরা তাদের সেলিব্রেট করি তাহলে এটা সুন্দর হবে। কারণ, বেশি পাইনি তো কী হইছে, কিছু মানুষ তো কাজটা করছে! এটা করলে হবে কি, ধরেন কোন রেজিম আবার ফ্যাসিস্ট হয়া উঠতে চাইবে, এই লেখাপত্রগুলা তার জন্য একটা হুশিয়ারির কারণ হয়ে উঠবে। সে জানবে, বাংলাদেশে কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে চাইলে এদেশের লেখকরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়া যায়। আমরা সে পথে হাঁটলে আমাদেরকেও তারা প্রতিরোধ করবে। শুধু এইটুকু পরিচয়ের জন্য হলেও যারা কাজ করছে, যারা গণতান্ত্রিক চিন্তার, তাদের লেখাপত্র নিয়ে কাজ করা দরকার, মানুষকে জানানোও উচিৎ আসলে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব যে, আমাদের রাইটাররা, শিল্পীরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, ইনসাফের পক্ষের রাইটারদের মানুষ হয়তো তেমন একটা চেনে না, কিন্তু এমন রাইটার বাঁ তাদের রাটিংস নিয়া পাবলিকরে জানানো উচিৎ, তাদের টেকস্ট নিয়ে কাজ করা উচিৎ।
মুহিম মাহফুজ : সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কথা বলতে পারি। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এসব প্রতিষ্টানে তো মোটামুটি কিছু রদবদল হতে দেখেছি। পূনর্গঠন এবং কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার জন্যই তো এসব রদবদল। তাদের কর্মকাণ্ডে ইফেক্টিভ উদ্যোগগুলো কতটুকু আছে? গোটা বাংলাদেশ তো তাদের নতুন পদক্ষেপের প্রত্যাশা করে বসে আছে!
হাসান রোবায়েত: এটার উত্তরটা আসলে একটু মুশকিল। মানে সংশ্লিষ্ট একাডেমির যারা, শিল্পকলা বলেন, বাংলা একাডেমি বলেন, তাদের কর্তাব্যক্তিরা বলতে পারবেন তারা আসলে কী চিন্তা করতেছেন। শিল্পকলা একাডেমি কিন্তু কাজ করছে আসলে। আর বাংলা একাডেমিতে যেটা আমি জানি, সেটা হলো, এই যে জুলাই সংক্রান্ত, মানে আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম অভ্যুত্থান বিপ্লব যেটাই বলি না কেন, এই সংক্রান্ত তারা প্রবন্ধের বই করতেছে একটা, আমি যেটা জানি, সাতশো পৃষ্টার মতো। একটা গল্পের বই করতেছে, ছড়ার বই করতেছে, কবিতার বই করতেছে । কবিতার বইটায় আমি এবং কবি রওশন আরা মুক্তা, আমরা দুইজনে কাজ করতেছি সেখানে। এই কাজগুলা আমার নজরে পড়ছে- এক। দুই হচ্ছে, আমি বাংলা একাডেমিতে যেটা দেখি যে, নিয়মিত তারা সভা-সেমিনার করতেছে বিভিন্ন বাংলাদেশি মেইনষ্ট্রিম কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে। আসলে যেটা করাও উচিৎ সেসব কাজ তারা করতেছে। হয়তো ঢাক-ঢোল পিটায়া করতেছেন না, কিন্তু করতেছেন। এগুলো আমরা আরো পরে বুঝতে পারবো। কিন্তু আমাদের যেই সমস্ত রাইটারকে এতকাল ফোক ফোক বইলা সেকেন্ড ক্লাস রাইটার বানায়া রাখা হইছে তাদেরকে নিয়া কাজের পরিমাণ বাড়াইতে হবে। খালি শুদ্ধ ভাষার আর্টই যে আর্ট না এইটা মানুষরে জানানোর দায়ীত্বও একাডেমিগুলার।
মুহিম মাহফুজ : যারা জুলাইয়ের বিরোধিতা করছে, লম্বা সময় ধরে আওয়ামী পক্ষে যুক্ত ছিলো, অনেকে মনে করেছিলো অভ্যুত্থানের পর হয়তো তাদের মধ্যে অনুশোচনা আসবে, ভুলটা বুঝতে পারবে, কম্প্রোমাইজ করবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। এখনো তারা প্রতিক্রিয়াশীলতাই চর্চা করছে, প্রপাগান্ডা ও ঘৃণাই ছড়াচ্ছে। সহাবস্থানের মতো সুন্দর অবস্থা বা কম্প্রোমাইজিং পজিশন দেখতে পাচ্ছি না! শিগগির কি একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি হইতে পারে? নাকি এই বিদ্বেষ চলতেই থাকবে, কী মনে হয় আপনার?
হাসান রোবায়েত : বর্তমানে জীবিত যে সমস্ত রাইটার, যারা এই অভুত্থানের বিপক্ষে গেছে এবং আওয়ামী রেজিমরে যারা সার্ভ করছে, তাদের গুন্ডামি স্বভাবটা যাবে না। আমি মনে করি তাদের মধ্য এইটা থাইকা যাবে। তাদের সাথে আসলে এইগুলো নিয়ে আমি আলাপ-আলোচনাতেও আগ্রহী না যে, ভাই আপনি হেদায়েতের পথে আসেন বা আপনাদের হেদায়েত হোক। তারা এটা করবে না। আমি এটাতে তাদের সাথে ইয়ে না আরকি। যেটা হইতে পারে, আগামীতে যে প্রজন্মটা লেখালেখিতে আসবে, শিল্পসাহিত্যে আসবে, আামি বরং তাদের সাথে আলাপ করতে চাই বেশি বেশি, এইগুলা নিয়ে। সেটা আসলে কাজে দিবে। কিন্তু যারা আসলে বেনিফিশিয়ারী ছিলো, তারা তো একটা আইডিওলজিকে ঈমান হিসেবে ধারণ করে, তারা তো ধরেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকেও তারা ওইভাবেই দেখে, মানে বাঙালি জাতিয়তাবাদের প্র্যাক্টিক্যাল হিসেবে একটা সামগ্রিক দেশ তাদের চিন্তাতেই নাই। তো এইটা আসলে একটা ঝামেলার জায়গা। এটাকেও তারা মুক্তিযুদ্ধের মতোই ডিফাইন করে। মুক্তিযুদ্ধের যে প্রক্লেমেশন, সেই প্রক্লেমেশনে যেই আলাপগুলো ছিলো, ইনসাফের আলাপ ছিলো, এইগুলো নিয়ে দেখবেন যে, এদের মধ্যে কোনো আলাপই নাই। এরা আসলে মুক্তিযুদ্ধের যে স্পিরিট, যে স্পিরিট নিয়া মুক্তিযুদ্ধটা হইলো, ওখান থেকে বাইর হইয়া আইসা, এটাকে একটা আওয়ামী প্রোপাগান্ডায় তারা নিয়ে গেলেন। তখন যেটা হইলো, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যে মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেলো আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের সাধারন মানুষ যেই প্রক্লেমেইশনের উপর বেইস করে মুক্তিযুদ্ধে গেছিলেন অথবা যারা কোনো প্রক্লেমেশন বোঝেন না, তারা শুধু জুলুমটা বোঝেন যে, পাকিস্তান সেই সময় আমাদের উপরে জুলুম করতেছিলেন, তো সেই জুলুমের বিরুদ্ধে দাড়ালেন, তারা কিন্তু আসলে এই আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে যাননি। তারা আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধকে ডিফাইন করে চলছে। তারা তো এই ডেফিনেশন থেকে বের হবে না। যার কারনে আমি মনেও করি না যে, তাদের আসলে কোনো পরিবর্তন হইতে পারে। মানে ১০০ পার্সেন্টই আসলে পরিবর্তন হবে না বলেই আমি বিলিভ করি। তাদের সাথে আমি আসলে এটা নিয়ে তর্কও করতে যাইতে চাই না।
মুহিম মাহফুজ : আপনি কাদের কাছে যাইতে চান আসলে?
হাসান রোবায়েত : আমি যাইতে চাই আসলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝবেন, একই সঙ্গে সাতচল্লিশকে যারা বুঝবেন। অর্থাৎ এই বাংলাদেশ পর্যন্ত আসতে যতোগুলো বড় বড়, মানে ইতিহাসের বাক নেয়া ঘটনা ঘটছিলো, সেগুলো আমি মনে করি আমাদের সিলেবাস, মানে তরুণদের বা পরবর্তি প্রজন্মের সিলেবাস যেনো ঐখান থেকে শুরু হয়। সুলতানি আমলও যেনো তারা জানে এবং তাদের পূর্বপুরুষদের প্রত্যেকটা কুরবানি তারা যেনো রেসপেক্ট করতে পারে। তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধ থেকেই শুরু করবে বা চব্বিশ থেকেই শুরু করবে- আমি আসলে এমনটা ভবি না। আমি মনে করি, ইতিহাস নিয়া হুশিয়ার থাকা খুবই জরুরি জিনিস। এইটা আসলেই যেনো তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়। আমি এ সময়ের তরুণদের কাছে বা নতুন প্রজন্মের কাছে বেশি বেশি যাইতে আগ্রহী। আর যাদের কথা বললেন, অনুশোচনা নাই, কোনো ইয়ে নাই, এইটা হবেও না আসলে। আমি মনে করি, তারা যেনো বাংলাদেশে ঝঞ্ঝাটহীন জীবনযাপন করতে পারে। আমি এটারও গেরান্টি চাই। আমরা যেনো তাদেরকে ডিসটার্ব না করি। কিন্তু তারা যদি কখনো আমাদের জন্য ডিস্টার্ব হইয়া ওঠে তখন কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম বা আমরা খালি বইসা বইসা দেখবো না।
মুহিম মাহফুজ : শেষে বিশেষভাবে কী বলতে চান?
হাসান রোবায়েত : আমি আসলে বিশেষভাবে যেটা শেষে বললাম, আমার মনে হয় সেটাই আসলে বলা উচিৎ। আমি খুব ফিল করি যে, এদেশের সাধারন মানুষ আসলে প্রপার এডুকেশনটা পাক। মানে শিক্ষার জায়গাটা খুবই, খুবই, খুবই ইম্পোর্টেন্ট। এটাকে যেন সরকার গুরুত্ব দেয়, আমি চাই। দ্বিতীয়ত এই বেসিক শিক্ষার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মানুষের, মানে এই পুরা সাবকন্টিনেন্টের যে হিস্ট্রি, সেই হিস্ট্রির মেইন মেইন পার্টগুলো, সবকিছুই হয়তো দেখা-পড়া সম্ভব না আবার জানাও সম্ভব না আসলে, ফলে সেই মেইন পার্টগুলো যেন আসলেই পড়াশোনায় থাকে, সিলেবাসে আসে। আমার মনে হয় তাতেই ইনসাফওয়ালা একটা দেশ আমরা ইজিলি গড়তে পারবো অথবা ইজিলি ইনসাফের দিকে যাইতে পারবো। আর আমরা যেন গোঁ ধইরা পইড়া না থাকি কোনো একটা নির্দিষ্ট হিষ্ট্রিক্যাল মোমেন্ট, যদি আমি কেবলমাত্র পড়ে থাকি চব্বিশ নিয়ে বাঁ ধরেন শুধু ৭১ নিয়ে, তাইলে আমি খুব একটা আগাইতে পারবো না। বরং আমার এডুকেশনের মধ্যে যেন পুরো সাবকন্টিনেন্ট, যার সাথে বাংলাদেশের নানানভাবে ভাগ্য জড়িত ছিলো, পুরো সিস্টেমটা যেন আমাদের নতুন প্রজন্ম সিলসিলা ধরে ধরে, টাইম ধরে ধরে, জানতে পারে। এবং সে সিলসিলায় সে যেনো সামনের দিকে যায়। এইটা আমি খুব আশা করবো।
মুহিম মাহফুজ : আশা করি এমনটাই যেনো হয়। এমনটাই তো হতে হবে। ব্যতিক্রম হওয়ার তো কোনো রাস্তা নাই।
হাসান রোবায়েত। কবি। ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে যার কবিতা বিশেষভাবে আলোচিত। গণঅভ্যুত্থানেও তার কবিতা ছিল প্রাসঙ্গিক। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তার ‘সিঁথি’ কবিতাটি সপ্তম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে গত ৩ জুলাই নতুন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সাংবাদিকতা নিয়ে তার সাথে কথা বলেছেন সাহিত্য সম্পাদক মুহিম মাহফুজ।
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত অংশ ৫ জুলাই শনিবারের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়েছিলো। এবার অনলাইনে প্রকাশিত হলো পুরো সাক্ষাৎকার।
মুহিম মাহফুজ : অনেকে মনে করেন, আপনি প্রচলিত চাকরি করতে চান না। এটা অনেকটা আপনার প্রতিজ্ঞার মতো মনে হচ্ছে। শোনা যায়, অভ্যুত্থানের পর আপনার কাছে চাকরিবাকরির অফার এসেছিল। আপনি তাতেও আগ্রহী হন নাই। কেন এমন সিদ্ধান্ত?
হাসান রোবায়েত : প্রথম কথা হইতেছে, এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আমি পাইনি। মানুষ দূর থেকে যা মনে করে সেইটা আসলে ঠিক না। বিষয়টা আমি বলি, আমারে একবার আসিফ নজরুল সাহেব ফোন করেছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি হওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তখনও জানতাম না, একজন ট্রাস্টীর কী কাজ এবং টাকা-পয়সার ব্যাপার সেখানে কেমন। আমার কাছে মনে হয়েছে, ট্রাস্টি হওয়া আসলে সেই অর্থে টাকা-পয়সা উপার্জনের কোন জায়গা না। এরা কোন একটা প্রতিষ্ঠানে মুরুব্বী টাইপের দায়িত্ব পালন করে। ধরেন, কোন একটা ডিসিশন নিতেছে প্রতিষ্ঠান, সেক্ষেত্রে তাদের সাথে আলাপ পরামর্শ করে। আর ট্রাস্টীরা তো মনে হয় নিয়মিত অফিসও করে না। মাঝে মাঝে মিটিং-টিটিং থাকে, সেখানে এটেন্ড করে। সুতরাং এটা বিশেষ কোনো চাকরি বা আয়-রোজগারের বিষয় মনে হয় নাই আমার কাছে। আমারে এ পর্যন্ত কেউ চাকরি-বাকরির কথা বলে নাই আসলে।
মুহিম মাহফুজ: আপনি এখন যে কাজ করছেন, সেটা নিয়েও তো আপনি বেশ অকপট। খোলামেলা কথাবার্তা বলেন।
হাসান রোবায়েত: যেটা হইছে আসলে, আমি যখন টিউশনি নিয়ে ফেসবুকে কথা বলি, সেটা যে আফসোস থেকে বলি, তা না। এটা কোন আক্ষেপের জায়গা না। বরং আমি যেহেতু এই জায়গাটা নিয়ে কাজ করি, ফলে কী ধরনের প্রবলেম এখানে ফেস করতে হয়, কী ধরনের সুবিধা আছে, সেটা নিয়েই আমি কথা বলি। ধরেন, যারা চাকরি-বাকরি করে, তারা বিভিন্ন সময়ে, ঈদে-চান্দে, বোনাস পায়। আমরা যারা এখানে কাজ করি, এটা তো আসলে একটা কাজই, এই কাজে তো বোনাস নাই। আমি যেহেতু এটা ফেস করি, সেজন্য বলি। এটার মানে এমন না যে, আমি আমারে চাকরি বাকরি দিতে লোকজনরে বলতেছি।
মুহিম মাহফুজ: তাহলে যা করতেছেন এটা নিয়েই কি সন্তুষ্ট? এভাবেই থাকতে চান?
হাসান রোবায়েত: ঠিক সন্তুষ্ট, ব্যাপারটা তা না। আমি আসলে এমন কিছু করতে চাই নাই, যাতে আমার সুপিরিয়র বা আমার উপরের কর্মকর্তারে মানায়া চলতে হয়। কাজ তো করতেই চাই কিন্তু এভাবে না। আরেকটা বিষয় আমি মনে করি, আমার আসলে স্কিল নাই অন্য কোন কাজ করার।
মুহিম মাহফুজ: একই ধরনের কথা সারা জীবন আল মাহমুদ বলেছেন যে, লেখা ছাড়া আর কোন কাজ আমি পারি না। ফলে তিনি লেখার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের অনেক লেখকও নিজের স্বাধীনতা বজায় রেখে সাংবাদিকতা করেছেন।
হাসান রোবায়েত: আমার সাংবাদিকতা না করার অন্যতম কারণ, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিক্সে পড়াশোনা করছি, তখন, মানে সেই সময়টায় প্রচুর টিউশনি পাইতাম। টিউশনি করে আমি সে সময় যে টাকা ইনকাম করতাম, আমি ভাবতাম, হয়তো সাংবাদিকতা করে এটা পাওয়া মুশকিল। এটার ফিউচার কী- সেটা নিয়ে কখনো টেনশন ছিল না। টিউশনির যেটা মূল সমস্যা, সেটা হল, কোন নিশ্চয়তা নাই, কোন ফিউচার নাই। আমি যদি একটা কোচিং সেন্টার খুলতাম তাহলে আমার অভিজ্ঞতার জায়গাটা দিন দিন আরো বেটার হইতো। কিন্তু সেটা যেহেতু আমি করি নাই, তাই একটু প্রবলেম। সাংবাদিকতার দিকে আমি যাই নাই মূলত এই কারণে। এটার সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। তবে আমার কাছে তখন এমনটাই মনে হইতো।
মুহিম মাহফুজ : আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, সেই আওয়ামী আমলে আমরা তো দেখেছি, সাংবাদিক-সম্পাদক বা মিডিয়া সংশ্লিষ্ট লোকজনের মধ্যে টাকা ইনকামের একটা ব্যাপক সুযোগ ছিল, চর্চা ছিল এবং সেটা দেখাও যাইতো- এতটাই রমরমা বা জৌলুস ছিল। আবার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও এমন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা ছিল। অনেকে সেই সুযোগে অনেক কিছু করছে- এমন অনেক নজির আছে। শুধু এক দুইটা না।
হাসান রোবায়েত: একজন সাংবাদিক যদি লিগেলি শুরু থেকে কাজ শুরু করে, তাহলে তার তো এত টাকা হওয়ার কথা না। লিগেল ওয়েতে সেই সময়ে আমার চেয়ে বেশি ইনকাম করা একজন উঠতি জার্নালিস্টের জন্য মুশকিলই ছিল মেবি। সাংবাদিকরা কেমন টাকা-পয়সা ইনকাম করে, সেটা আসলে আমি জানি না তখন। যেহেতু তখন আমরা দেখতাম, সাংবাদিকরা ঠিকমতো বেতন পায় না, স্বাভাবিকভাবে চলতে কষ্ট হয়- এমন ঘটনা।
মুহিম মাহফুজ: সে সময়ে সাংবাদিকদের বেতন না পাওয়ার ঘটনা যেমন আমরা দেখেছি, দেখেছি সাংবাদিকদের বেতনের জন্য রাস্তায় আন্দোলন করতে হয়েছে এবং বেতন না দিতে পাইরা কোন কোন সংবাদপত্র বন্ধও হয়ে গেছে। আবার এই ঢাকা শহরেই আমরা দেখছি, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক পরিচয়ে কিছু মানুষ ব্যাপক সুবিধা নিচ্ছে, ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক হয়ে গেছে। একই শহরের মধ্যে, একই সমাজের মধ্যে দুইটা শ্রেণীর দুই রকম চরিত্র এবং চর্চা আমরা তো দেখছি।
হাসান রোবায়েত: ওয়েলফেয়ার স্টেটগুলোতে যেমন ইনসাফপূর্ণ সমাজ থাকে, আমাদের সমাজ তো আসলে সেরকম না। আমাদের সমাজে সেই ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। আর এটা না হলে সমাজের মধ্যে এ ধরনের অনৈতিকতা হবে এটাই স্বাভাবিক।
মুহিম মাহফুজ: সেই জুলুম ও অনৈতিকতার চূড়ান্ত ধাপে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন যখন জাইগা উঠলো, তখন আমরা দেখলাম, সমাজের সোকল্ড বুদ্ধিজীবীদের, শিল্পী সাহিত্যিক-কবিদের বড় একটা অংশ এটাকে ধরতে পারল না বা নিজেদের যুক্ত করতে পারলে না। তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত বিরোধী পক্ষেই থাকলো। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ আসলে ফেইল করলো, এত বড় একটা অভ্যুত্থানকে ধারণ করতে পারলো না। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিতার জন্য তো এটা একটা ব্যর্থতার ঘটনা।
হাসান রোবায়েত: আমার কাছে এটা কোন বড় ঘটনাই না। আমি দেখি অন্যভাবে। একটা বড় অংশ যেমন ওন করেন নাই। আরেকটা বড় অংশ তো ওন করছে। আমি ওন করছি, আপনি ওন করছেন। না করলে এত বড় অভ্যুত্থান হইলো কেমনে? যারা অভ্যুত্থানে আসে নাই বা ওন করতে নাই তারা সামনেও পারবে না।
মুহিম মাহফুজ: কেনো পারলো না?
হাসান রোবায়েত: কারণ তারা তো আসলে স্টাবলিশমেন্টের লোক। হাসিনা রেজিমের যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে তো তারা সমস্যায় পড়ব। তাদের যে ইনকাম, তাদের যে ঈমান বা বিশ্বাস, সেটা তো হাসিনা রেজিমের ন্যারেটিভের উপরে। তাদের শিল্প সাহিত্যের যে চিন্তাভাবনা সেটা তো বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা মনেই করে যে, অভ্যুত্থান তাদের জন্য একটা পরাজয়। বেঙ্গলি রেনেসাঁ থেকে যে বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের জন্ম হইলো, তারা তো সেই বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের লোক। বেঙ্গলি ন্যাশনালিজমের মুরিদের কাছ থেকে আপনি কখনো ওয়েলফেয়ার স্টেটের ইনসাফ পাওয়ার আশা করতে পারেন না।
মুহিম মাহফুজ : বাংলাদেশের কবি হিসেবে বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম নিয়ে আপনার সমালোচনা কোন পয়েন্টে?
হাসান রোবায়েত: হাসান রোবায়েত: বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম তো একটা লিনিয়ার ধারণা। একটা একরৈখিক আদর্শ। এইটা বাংলাদেশের ডাইভারস সোসাইটি বা বহুমমতের সমাজরে ফাংশন করতে দেয় না। যেমন বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ মনেই করে যে মুসলমান একটা অন্য ঘটনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা আপনারে একটা বাইনারির মধ্যে ফালাইতে চায়। খুব কায়দা করে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি মুসলমান না বাঙালি? যেন আমি বাঙ্গালি হইলে মুসলমান হইতে পারবো না অথবা মুসলমান হইলে বাঙ্গালি হইতে পারবো না। কিন্তু বিষয় হইলো, বাঙালি কালচারটা তৈরিই করছে মূলত মুসলমানরা। কোট আনকোট এটা মুসলমানরাই তৈরি করছে। আপনি সুলতানি আমল থেকে শুরু করেন। সেনদের আমল শেষ হইল কেনো? কারণ এখানে মুসলমানদের আগমন ঘটল। আমি যদি ভাষার প্রশ্নে আসি, বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব নজির সেগুলোর অধিকাংশই তৈরি হয়েছে মুসলিম আমলে। আমি নাম ধরে বলতে পারি। রামপ্রসাদ হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণদের মধ্যে একজন। ভারতচন্দ্রের কথা বলা যায়। উনারা তাদের গ্রেট কাজগুলো করছেনই মুসলমান আমলে। মুর্শিদকুলি খাঁ থেইকা নবাব সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত টাইমলাইনে বহু কাজ হইছে। মুসলমান শাসকরাই মূলত বাঙ্গালি কালচাররে দিনে দিনে ডেভেলপ করছে। উনিশ শতকে যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা হলো, তখন হিন্দু পন্ডিতদের দিয়ে বাংলা ভাষাকে আরেকবার সাইজ করা হইলো। সেইটা আসলে আর বাংলা ভাষাই থাকল না। সেটা সংস্কৃতবহুল একটা বিশেষ বাংলা। যেটা আমার ভাষা হিসেবে আমার চিনতেই কষ্ট হয়। আপনি যদি বাংলা কবিতার সিলসিলা টাইমলি ধরে ধরে পড়েন, একেবারে চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগ হয়ে, চন্ডীদাস, রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র, এরপর মাইকেল মধুসূদনে এসে আপনি কিন্তু এই ভাষাটা চিনতেই পারবেন না। যে ভাষাটার বিকাশ হইতেছিল চর্যাপদ থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের আগ পর্যন্ত, সেটার বিকাশ হঠাৎ থামায়া দেওয়া হইলো। মুসলমানরা বাংলা সাহিত্যে যে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্জাম দিছেন এটা ভুলায়া দেওয়ার জন্যই মূলত এমনটা করা হইল। ফলে, আমি মনে করি বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম মূলত এটার বাই প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষার যে উন্নতি সেটা বাঙ্গালি ন্যাশনালিজম নষ্ট করছে। আমাদের এখানে বহুমুখী সোসাইটির তৈরি করার সম্ভাবনা তারা নষ্ট করছে। এবং এটা সম্ভব হইছে বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্তির কারণে। বাহাত্তরের সংবিধানের কারণে পাহাড়ের মানুষরে দূরে রাখা হয়েছে, ধীরে ধীরে মুসলমানদের আলাদা করা হইছে। এজন্য আমি এটাকে ক্রিটিকালি দেখি।
মুহিম মাহফুজ: ফোর্ট উইলিয়াম যে সংস্কৃতবহুল সাধু বাংলার প্রচলন করলো সেটা কিন্তু অল্প দিনে, কয়েকশো বছরে ফেল করলো। মানে এটা আর চলার উপযোগী থাকলো না। এর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা যে প্রমিত বাংলার প্রচলন করল, বাংলাদেশে আমরা কয়েক দশক ধরে দেখতেছি সেটার প্রভাব কমতেছে। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষা সাহিত্যে গুরুত্ব পাচ্ছে। মুসলমান আমলে গড়ে ওঠা যে বাংলা ভাষার কথা আপনি বললেন, আর বাংলাদেশের সাহিত্যে যে ভাষার চর্চা আমরা নতুন করে বাড়ছে বলে দেখতে পাচ্ছি, সেটা কি সুলতানি আমলের বাংলা ভাষার লিগেসি? মূলে ফিরে যাওয়া?
হাসান রোবায়েত : নতুন কইরা চর্চা শুরু হইছে আমি সেটা মনে করি না। আমি মনে করি এখানে চর্চা হইতেছিল। কিন্তু আমরা সেটা ফাইন্ড আউট করতে পারি নাই। ধরেন আমাদের বাংলাদেশের যে গান বা কবিতা, আপনি যদি শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমণ, হাসন রাজা বা লালনের কথা ধরেন, ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলায় উনারা কিন্তু লেখেন নাই। আমাদের এখানে এই চর্চাটা ছিল। এমনকি রিটেন লিটারেচারেও ছিল। কিন্তু সমস্যা যেটা, এই লিটারেচারগুলারে আমরা ফোক নাম দিয়ে দিছি। এগুলো মূলত বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম লিটারেচার। সেটা না বইলা আমরা বলছি ফোক মানে আলাদা। মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই লিটারেচারগুলোকে ফোক লিটারেচার বানাইছে। অর্থাৎ আমাদের এখানে এই চর্চা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু আমরা আইডেন্টিফাই করি নাই। এখন হয়তো আইডেন্টিফাই করা হবে। কারণ অনেকেই এটা নিয়ে আগ্রহী হইতেছে।
মুহিম মাহফুজ: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যে আমরা আসলে বাংলাদেশ কনসেপ্ট বা বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং জিনিসটা মিস করতেছিলাম।
হাসান রোবায়েত: হ্যাঁ। বাংলাদেশের কবিরা মূলত এই ঝামেলা পাকাইছে। বাংলাদেশের সো কল্ড মেইনস্ট্রিম কবি, যারা মনে করতেছে তারা ফোক না, তারা কলকাতার কলোনিয়াল বাংলাটারে ধইরা রাখছে। যেহেতু তখন কলকাতার প্রভাব ছিল। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কুল-কলেজে যে বাংলা শেখানো হয় সেইটা তো কলোনিয়ান বাংলা। সেই কলোনিয়াল বাংলার চক্রের মধ্যে থাকার কারণে অধিকাংশই আসলে জানে না যে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা কোনটা! কলোনিয়াল ভাষা দ্বারা অধিকাংশ মানুষ এতটাই আক্রান্ত তারা যে, এটারেই তারা নিজের ভাষা মনে করত। আমাদের ভাষাটাকে একটা আনস্মার্ট ভাষা মনে করত। বই পুস্তকে বা স্কুল-কলেজে যে ভাষাটা শেখানো হতো সেটাকেই মনে করত স্মার্ট বাংলা। এখানে মূলত কবিরাই ফেইল করছে। তারা বাংলাদেশের ভাষা ধরতে পারে নাই। আমার ধারণা কিছু মানুষ বাদে এখনো কবিরা ফেল করতেছে। এটা নিয়ে খুব কম মানুষই ক্রিটিকালি চিন্তা করছে। তবুও এই ভাষাটাই ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে।
মুহিম মাহফুজ: কতটা প্রভাবশালী হতে পারে? একাডেমিয়াসহ সরকারি-বেসরকারি জায়গায় এটাকে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে বা একসেপটেবল জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে করেন?
হাসান রোবায়েত: গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা জানি না। দ্রুত এমন কিছু হওয়ার লক্ষণও আমি দেখতেছি না। কিন্তু নিজেদের লিটারেচারে কবিরা এবং অন্যরা এটার চর্চা করবেন। আমার ধারনা, কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই এই ভাষায় লিখতে আগ্রহী হবে। তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসবে। সরকারি জায়গার বিষয়ে আমি অতটা আশাবাদী না।
মুহিম মাহফুজ: অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নানারকম সংস্কার প্রকল্প চলছে। সংস্কারের, বিশেষভাবে রাজনৈতিক সংস্কারের নানারকম উদ্যোগ-ব্যবস্থা আমরা দেখছি। কিন্তু একটা রাষ্ট্র তো শুধু রাজনীতি দিয়ে চলে না, রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে সংস্কৃতি। তো রাজনৈতিক সংস্কারের আলাপ জোড়েশোরে চললেও সাংস্কৃতিক সংস্কার নিয়ে এ পর্যন্ত কোন আলোচনা বা উদ্যোগ আমরা দেখছি না। এটা একটা শূন্যতা কিনা? আর সংস্কৃতির সংস্কার না করে রাষ্ট্র সংস্কারের সাফল্য কতটা পেতে পারি আমরা?
হাসান রোবায়েত: কালচারাল সংস্কার তো চাপায়া দিয়া আসলে করা যাবে না। কালচারের সংস্কারের জায়গায় কেউ কারো কাছে বাধ্য না বা কেউ কারো চাকরি করে না। ব্যক্তি নিজের জায়গা থেকে এটা করে, গান লেখে কবিতা করে সিনেমা বানায়। তবে এখানে অবশ্যই ফাইন্ড আউট করা যাইত যে, কোথায় আমরা ফেল করতেছিলাম? কোনটা হওয়া উচিত? তবে কোন কিছু চাপিয়ে দেওয়া আসলে মুশকিল যে, এটা করতে হবে অথবা এটা করা যাবে না।
মুহিম মাহফুজ: নিশ্চয়ই। তবে প্রমিত বাংলা, আপনি যেটাকে কলোনিয়াল বাংলা বলছেন, সেই বাংলা তো রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো চাপায়া দিচ্ছে।
হাসান রোবায়েত: হ্যাঁ। এটা চাপায়া দিছে। এটা এমনভাবে চাপায়া দেওয়া হইছে যে এটারে আর চেঞ্জ করার দিকে আগানো যাইতেছে না এখনো। এটা নিয়ে কারো কোন অবজারভেশনই দেখতে পাইতেছি না।
মুহিম মাহফুজ: চিন্তার জায়গা সেটাই। আমরা এসব বিষয়ে মিনিমাম কোন অবজারভেশন পাচ্ছি না। ফলে প্রশ্ন উঠছে, মৌলিক সাংস্কৃতিক সংস্কার ছাড়া টেকসই সংস্কার কতটা পসিবল হবে?
হাসান রোবায়েত: ওই যে বলে না, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই গভমেন্টের সময় হয়তো হয়নি। তার মানে আগামী গভমেন্টের সময় যে হবে না, তা তো আমি মনে করি না। সামনের সরকারের আমলে হইতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা এবং সভা-সেমিনার হওয়া উচিত। গবেষণা প্রবন্ধ লেখা উচিত। না হলে যারা সংস্কার করবে তারা এটা ফিল করতে পারবে না। কারণ যারা পলিটিশিয়ান, তারা যে কালচারের সব বিষয়ে জানেন এমন তো না। তাদেরকে তো জানাইতে হবে।
আমি মনে করি যে জায়গাটা আমরা সবচেয়ে বেশি মিস করছি, সেটা হল শিক্ষার সংস্কার। এডুকেশন নিয়ে আমি কাউকে তেমন কোনো কথাই বলতে দেখলাম না। বরং শিক্ষা নিয়ে আমরা বড় রকমের সংস্কার করতে পারতাম। আগামী পাঁচ সাত বছরের মধ্যে আমাদের এডুকেশন সেক্টর কে কোথায় দেখতে চাই, কিভাবে সাজাতে চাই, কি কি পড়ানো উচিত, এগুলো নিয়ে কোন আলাপই হইতেছে না। কিন্তু আমি শ্চর্যজনকভাবে সেই ডিবেটে কারো কোন আগ্রহই দেখলাম না।
মুহিম মাহফুজ: শিক্ষা এবং সংস্কৃতি দুইটা জায়গা আমরা চিহ্নিত করতে পারলাম। এই জায়গাগুলোতে সংস্কারের দায় ও দায়িত্ব কাদের আসলে?
হাসান রোবায়েত: সরকারের, নিশ্চয়ই সরকারের।
মুহিম মাহফুজ: সরকারের সংস্কার প্রকল্পে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সমর্থন ছাড়া হয় না। আবার কোনো কোনো সংস্কার কাজে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো সমর্থন দিতেও চায় না।
হাসান রোবায়েত: আমার মনে হয়, এডুকেশন সেক্টর রিফর্মেশনের কাজে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর খুব একটা বাগড়া দেওয়ার জায়গা থাকবে না। ব্যাপারটা এরকম না যে, এডুকেশন রিফর্ম হইলে পলিটিক্যাল পার্টিগুলো বড় ধরা খেয়ে যাবে। বরং সরকার যে এটাকে একটা সমস্যা বা সমাধানযোগ্য বিষয় হিসেবে প্রেজেন্ট করতেই পারল না, এটা বরং এই সরকারের একটা ব্যর্থতা।
মুহিম মাহফুজ: কালচারের প্রশ্নটা আমরা অন্যভাবে আবার করি। গত দেড় দশক আওয়ামী রেজিম টিকে ছিল এক তো প্রশাসনের সহযোগিতায়। আরেক দিকে তার যে মিডিয়া ও কালচারাল স্টাবলিশমেন্ট ছিল, তার প্রত্যক্ষ মদদে। ফলে অভ্যুত্থান পরবর্তী কোন রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করে বা রাষ্ট্র পরিচালনার স্বপ্ন দেখে, তার তো এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা এবং চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত, পুরনো কালচারাল এবং মিডিয় স্টাবলিশমেন্ট ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত করতে হবে। এই জায়গায় পার্টিগুলোকে কতটা উদ্যোগী বা আগ্রহী দেখতে পাচ্ছেন?
হাসান রোবায়েত: আমি তো সেভাবে দেখতে পাইতেছি না। প্রথম কথা হইতেছে , আমার চোখে পড়েনি, মানে যে তারা ভাবতেছেন না সেটা নাও হতে পারে। তবে আমার চোখে পড়েনি। আর আমি আগে বলছি যে এডুকেশন এর মত মৌলিক বিষয় নিয়ে আমি খুব আপসেট। কালচার নিয়ে আর কি বলব।
মুহিম মাহফুজ: অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সমন্বয়ে যে পার্টি হল, এনসিপি, এ বিষয়ে তাদের এক্টিভিটি বা ইনটেনশন কেমন দেখছেন?
হাসান রোবায়েত: তাদের কোনো ভাবনাও তো দেখতে পাচ্ছি না। হয়তো তারা কনস্টিটিউশন নিয়ে অনেক ভাবতেছেন, ইলেকশন সিস্টেম নিয়ে অনেক ভাবতেছেন, কিন্তু তারা এখনো আমাদের বুঝাইতে পারেন নাই, এডুকেশন নিয়ে তারা কী করতে চান, মানে আমার নজরে পড়ে নাই। তাদের চিন্তায় হয়তো এডুকেশন জিনিসটাই নাই। অথচ আপনি দেখবেন, তারা প্রত্যেকেই ছাত্রনেতা, প্রত্যেকেই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে আসছে। তাদের তো এটা নিয়ে আরও বেশি কথা বলা উচিত ছিল। অথচ তারা কিছুই বলতেছে না। এ অবস্থায় কালচারের বিষয়টা তো অনেক পরের। কারণ কালচারের চর্চার জায়গাটা তো ব্যক্তিগত। কিন্তু শিক্ষার জায়গাটা মোটেই ব্যক্তিগত না। একটা জাতীয় উদ্যোগ এবং জাতীয়ভাবে সেটা সম্পাদিত হয়।
মুহিম মাহফুজ: কালচার নিয়ে কী ধরনের রিফর্ম হতে পারতো বা হওয়া উচিত?
হাসান রোবায়েত: আমাদের দেশে কালচারের নামে এতদিন কী কী হইছে কিভাবে হইছে তার একটা ক্রিটিক্যাল রিডিং শুরু হতে পারতো। কিন্তু আমি আসলে দেখতেছি না। হয়তো সামনে হবে। বড় বড় পলিটিক্যাল পার্টিগুলো ভাববে এসব নিয়ে। আমি বিশ্বাস করি এটা হবে, আজ অথবা আগামীকাল।
মুহিম মাহফুজ: ২৪-এর অভ্যুত্থানে আমাদের ইয়ং ইন্টারেলেকচুয়াল এবং শিল্পী-সাহিত্যিকদের যথেষ্ট সাহসী এবং অগ্রসর পদক্ষেপ রাখতে দেখেছি। অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রায় এক বছর আমরা অতিক্রম করলাম। এই এক বছরে সেই বিপ্লবী গোষ্ঠী এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে উল্লেখযোগ্য- এমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা বা ভূমিকা রাখতে পারার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারছে কিনা?
হাসান রোবায়েত: আমার চোখে অন্তত পড়ে নাই, এটা প্রথম কথা। আমি আবারো বলি, যা আমার চোখে পড়ে নাই তা যে ঘটতেছে না, তা না। হয়তো ঘটতেছে কিন্তু আমার চোখে পড়ে নাই।
মুহিম মাহফুজ: আপনার চোখে কী ধরা পড়তেছে?
হাসান রোবায়েত: আমার চোখে যেটা ধরা পড়তেছে সেটা হইল, ধরেন কোন একজনের ভালো সিনেমা বানানোর কথা ছিল। কিন্তু সে এখন মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করে ফেলছে। অনেকেই এমন আছে যারা তাদের ড্রিমের জায়গা থেকে সইরা আসছে। একটা জাতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করলে এটা একটা ক্ষতির ব্যাপার, আমি মনে করি। এ কারণে আপনি যত পলিটিক্যাল এনালিটিক পাবেন, যত কমেন্টেটর পাবেন, তত ভালো কবি পাবেন না, উপন্যাসিক পাবেন না। আরেকটা ব্যাপার হইলো, এ ধরনের বড় রকমের কোন ঘটনার পরে সম্ভবত এমনটা হয়, হয় হয়ত। তবে ১০ বছর পরে যারা আসবে কাজ করতে, তারা হয়তো নিজেদের মতো করে আবার শুরু করবে। নিজেদের জায়গাটা খোঁজার চেষ্টা করবে।
মুহিম মাহফুজ: আপনি আগে যেটা বলে আসলেন যে, বাংলাদেশের আর্ট-কালচারের আইডেন্টিফিকেশন হয় নাই। এটা একটা শূন্যতার জায়গা। ২৪-এর পরে যখন আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের কথা বলছি, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা কর, তখন সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের বিষয়টা তো নজরে নিতে পারি।
হাসান রোবায়েত: কালচারাল সভরেন্টি ধারণাটার সঙ্গে আমি এই মুহূর্তে একমত হইতে পারতেছি না। কারণ এটা নিয়ে আমি আসলে আগে ভাবি নাই। আমি আসলে একটু অন্যভাবে ভাবছি। সেটা হল, আমার কালচার আমার চর্চা করতে হবে এটা যেমন সত্য, আবার কাউকে আমি যদি বলে দেই যে, তোমার এটা করতে হবে বা এটা করতে পারবা না, তখন তো কালচারাল সভরেন্টি টিকে থাকবে না। আমি মনে করি আর্ট ইটসেলফ একটা দুনিয়া। আমি আসলে সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের ধারণার সঙ্গে একটু ডিফার করি। কারণ এর মধ্য দিয়ে একঘেয়ে শিল্প-সাহিত্য তৈরি হওয়ার বিষয় থাকতে পারে। তখন দেখা যাবে, সবাই একই রকম লিখতেছে। সবাই অনেক দেশপ্রেম করতেছে। তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারায়া যাবে। তবে একটা কমন জায়গায় তো একমত হওয়ার বিষয় অবশ্যই আছে।
মুহিম মাহফুজ: কমন জায়গায় একমত হওয়ার বিষয়েই আমরা আসতে চাচ্ছি। কারণ ফ্যাসিবাদী আমলে আমরা দেখছি, সংস্কৃতির ভিন্নমতের কারণে বিভিন্ন পক্ষকে অপরায়ন করা হয়েছে, সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হইছে- দেশের ভেতরে এরকম একটা অবস্থা ছিল। আবার আপনি বাইরে থেকে দেখলে দেখবেন, বাংলাদেশের উপরে ভারতের কালচারাল হেজিমনি সবসময় ছিলো, এখনো আছে, সেটাও আমাদের মোকাবেলা করে আসতে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশি কালচারের জায়গাটা তো আমাদের আইডেন্টিফাই করা প্রয়োজন আসলে। একটা কমন জায়গা থেকে তো আমাদের বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারার ব্যাপার থাকে।
হাসান রোবায়েত: হ্যাঁ, এইটা তো ঠিক। আমেরিকা এবং বৃটেনের ভাষা ইংরেজি। কিন্তু তাদের লিটারেচারের স্টাইল আলাদা। সেটা তো আমাদের এখানেও হইতে পারে। তবে আমি যেটা বলছি, এটা রাষ্ট্র যেন ঠিক না করে দেয় যে, এটা করতে পারবা না। তাহলে সেটা উত্তর কোরিয়ার মডেল হয়ে যাবে। তবে সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব না বলে আমি বলতে চাই, কালচারের ব্যাপারে একটা সামগ্রিক ধারণা জাতিগতভাবে সবার থাকা জরুরি। যেকোনো আর্টিস্টের জন্যই এটা জরুরি। এর মধ্য দিয়া সে বাংলাদেশি হয়ে উঠবে। তার মধ্যে বাংলাদেশ পাওয়া যাবে। এবং সাথে সাথে সারা দুনিয়াও সেটা নিতে পারবে। এতদিন পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের ভাষাটারে নিতে পারি নাই। মনে করছি, এটা একটা খ্যাত ভাষা। এই ঘটনা আর যেন না ঘটে।
মুহিম মাহফুজ: বিশ্বের যেসব দেশে দীর্ঘসময় ফ্যাসিবাদ ছিল, প্রতিরোধ সাহিত্যের একটা ধারা এসব দেশে গড়ে উঠতে দেখা গেছে । যেমন, আমরা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সাহিত্যের কথা বলতে পারি। বাংলাদেশে এত লম্বা সময় ফ্যাসিবাদ টিকে ছিল। এই সময়ে আমরা কি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিরোধ সাহিত্য তৈরি করতে পারছি বা এই ধারার যথেষ্ট সংখ্যক রচনা কি আমরা পাই?
হাসান রোবায়েত: না, তা পাই না। ধরেন, অনেক বেশি রাইটার আমরা পাইনি সত্য, কিন্তু কিছু রাইটার তো পাইছি। এখন আমি যেটা বলি, আমরা যাদের পাইছি, ভিন্ন ঘরানার লিটারেচার হিসেবে আমরা তাদের সেলিব্রেট করি তাহলে এটা সুন্দর হবে। কারণ, বেশি পাইনি তো কী হইছে, কিছু মানুষ তো কাজটা করছে! এটা করলে হবে কি, ধরেন কোন রেজিম আবার ফ্যাসিস্ট হয়া উঠতে চাইবে, এই লেখাপত্রগুলা তার জন্য একটা হুশিয়ারির কারণ হয়ে উঠবে। সে জানবে, বাংলাদেশে কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে চাইলে এদেশের লেখকরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়া যায়। আমরা সে পথে হাঁটলে আমাদেরকেও তারা প্রতিরোধ করবে। শুধু এইটুকু পরিচয়ের জন্য হলেও যারা কাজ করছে, যারা গণতান্ত্রিক চিন্তার, তাদের লেখাপত্র নিয়ে কাজ করা দরকার, মানুষকে জানানোও উচিৎ আসলে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব যে, আমাদের রাইটাররা, শিল্পীরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, ইনসাফের পক্ষের রাইটারদের মানুষ হয়তো তেমন একটা চেনে না, কিন্তু এমন রাইটার বাঁ তাদের রাটিংস নিয়া পাবলিকরে জানানো উচিৎ, তাদের টেকস্ট নিয়ে কাজ করা উচিৎ।
মুহিম মাহফুজ : সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কথা বলতে পারি। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এসব প্রতিষ্টানে তো মোটামুটি কিছু রদবদল হতে দেখেছি। পূনর্গঠন এবং কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার জন্যই তো এসব রদবদল। তাদের কর্মকাণ্ডে ইফেক্টিভ উদ্যোগগুলো কতটুকু আছে? গোটা বাংলাদেশ তো তাদের নতুন পদক্ষেপের প্রত্যাশা করে বসে আছে!
হাসান রোবায়েত: এটার উত্তরটা আসলে একটু মুশকিল। মানে সংশ্লিষ্ট একাডেমির যারা, শিল্পকলা বলেন, বাংলা একাডেমি বলেন, তাদের কর্তাব্যক্তিরা বলতে পারবেন তারা আসলে কী চিন্তা করতেছেন। শিল্পকলা একাডেমি কিন্তু কাজ করছে আসলে। আর বাংলা একাডেমিতে যেটা আমি জানি, সেটা হলো, এই যে জুলাই সংক্রান্ত, মানে আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম অভ্যুত্থান বিপ্লব যেটাই বলি না কেন, এই সংক্রান্ত তারা প্রবন্ধের বই করতেছে একটা, আমি যেটা জানি, সাতশো পৃষ্টার মতো। একটা গল্পের বই করতেছে, ছড়ার বই করতেছে, কবিতার বই করতেছে । কবিতার বইটায় আমি এবং কবি রওশন আরা মুক্তা, আমরা দুইজনে কাজ করতেছি সেখানে। এই কাজগুলা আমার নজরে পড়ছে- এক। দুই হচ্ছে, আমি বাংলা একাডেমিতে যেটা দেখি যে, নিয়মিত তারা সভা-সেমিনার করতেছে বিভিন্ন বাংলাদেশি মেইনষ্ট্রিম কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে। আসলে যেটা করাও উচিৎ সেসব কাজ তারা করতেছে। হয়তো ঢাক-ঢোল পিটায়া করতেছেন না, কিন্তু করতেছেন। এগুলো আমরা আরো পরে বুঝতে পারবো। কিন্তু আমাদের যেই সমস্ত রাইটারকে এতকাল ফোক ফোক বইলা সেকেন্ড ক্লাস রাইটার বানায়া রাখা হইছে তাদেরকে নিয়া কাজের পরিমাণ বাড়াইতে হবে। খালি শুদ্ধ ভাষার আর্টই যে আর্ট না এইটা মানুষরে জানানোর দায়ীত্বও একাডেমিগুলার।
মুহিম মাহফুজ : যারা জুলাইয়ের বিরোধিতা করছে, লম্বা সময় ধরে আওয়ামী পক্ষে যুক্ত ছিলো, অনেকে মনে করেছিলো অভ্যুত্থানের পর হয়তো তাদের মধ্যে অনুশোচনা আসবে, ভুলটা বুঝতে পারবে, কম্প্রোমাইজ করবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। এখনো তারা প্রতিক্রিয়াশীলতাই চর্চা করছে, প্রপাগান্ডা ও ঘৃণাই ছড়াচ্ছে। সহাবস্থানের মতো সুন্দর অবস্থা বা কম্প্রোমাইজিং পজিশন দেখতে পাচ্ছি না! শিগগির কি একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি হইতে পারে? নাকি এই বিদ্বেষ চলতেই থাকবে, কী মনে হয় আপনার?
হাসান রোবায়েত : বর্তমানে জীবিত যে সমস্ত রাইটার, যারা এই অভুত্থানের বিপক্ষে গেছে এবং আওয়ামী রেজিমরে যারা সার্ভ করছে, তাদের গুন্ডামি স্বভাবটা যাবে না। আমি মনে করি তাদের মধ্য এইটা থাইকা যাবে। তাদের সাথে আসলে এইগুলো নিয়ে আমি আলাপ-আলোচনাতেও আগ্রহী না যে, ভাই আপনি হেদায়েতের পথে আসেন বা আপনাদের হেদায়েত হোক। তারা এটা করবে না। আমি এটাতে তাদের সাথে ইয়ে না আরকি। যেটা হইতে পারে, আগামীতে যে প্রজন্মটা লেখালেখিতে আসবে, শিল্পসাহিত্যে আসবে, আামি বরং তাদের সাথে আলাপ করতে চাই বেশি বেশি, এইগুলা নিয়ে। সেটা আসলে কাজে দিবে। কিন্তু যারা আসলে বেনিফিশিয়ারী ছিলো, তারা তো একটা আইডিওলজিকে ঈমান হিসেবে ধারণ করে, তারা তো ধরেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকেও তারা ওইভাবেই দেখে, মানে বাঙালি জাতিয়তাবাদের প্র্যাক্টিক্যাল হিসেবে একটা সামগ্রিক দেশ তাদের চিন্তাতেই নাই। তো এইটা আসলে একটা ঝামেলার জায়গা। এটাকেও তারা মুক্তিযুদ্ধের মতোই ডিফাইন করে। মুক্তিযুদ্ধের যে প্রক্লেমেশন, সেই প্রক্লেমেশনে যেই আলাপগুলো ছিলো, ইনসাফের আলাপ ছিলো, এইগুলো নিয়ে দেখবেন যে, এদের মধ্যে কোনো আলাপই নাই। এরা আসলে মুক্তিযুদ্ধের যে স্পিরিট, যে স্পিরিট নিয়া মুক্তিযুদ্ধটা হইলো, ওখান থেকে বাইর হইয়া আইসা, এটাকে একটা আওয়ামী প্রোপাগান্ডায় তারা নিয়ে গেলেন। তখন যেটা হইলো, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যে মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেলো আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের সাধারন মানুষ যেই প্রক্লেমেইশনের উপর বেইস করে মুক্তিযুদ্ধে গেছিলেন অথবা যারা কোনো প্রক্লেমেশন বোঝেন না, তারা শুধু জুলুমটা বোঝেন যে, পাকিস্তান সেই সময় আমাদের উপরে জুলুম করতেছিলেন, তো সেই জুলুমের বিরুদ্ধে দাড়ালেন, তারা কিন্তু আসলে এই আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে যাননি। তারা আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধকে ডিফাইন করে চলছে। তারা তো এই ডেফিনেশন থেকে বের হবে না। যার কারনে আমি মনেও করি না যে, তাদের আসলে কোনো পরিবর্তন হইতে পারে। মানে ১০০ পার্সেন্টই আসলে পরিবর্তন হবে না বলেই আমি বিলিভ করি। তাদের সাথে আমি আসলে এটা নিয়ে তর্কও করতে যাইতে চাই না।
মুহিম মাহফুজ : আপনি কাদের কাছে যাইতে চান আসলে?
হাসান রোবায়েত : আমি যাইতে চাই আসলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝবেন, একই সঙ্গে সাতচল্লিশকে যারা বুঝবেন। অর্থাৎ এই বাংলাদেশ পর্যন্ত আসতে যতোগুলো বড় বড়, মানে ইতিহাসের বাক নেয়া ঘটনা ঘটছিলো, সেগুলো আমি মনে করি আমাদের সিলেবাস, মানে তরুণদের বা পরবর্তি প্রজন্মের সিলেবাস যেনো ঐখান থেকে শুরু হয়। সুলতানি আমলও যেনো তারা জানে এবং তাদের পূর্বপুরুষদের প্রত্যেকটা কুরবানি তারা যেনো রেসপেক্ট করতে পারে। তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধ থেকেই শুরু করবে বা চব্বিশ থেকেই শুরু করবে- আমি আসলে এমনটা ভবি না। আমি মনে করি, ইতিহাস নিয়া হুশিয়ার থাকা খুবই জরুরি জিনিস। এইটা আসলেই যেনো তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়। আমি এ সময়ের তরুণদের কাছে বা নতুন প্রজন্মের কাছে বেশি বেশি যাইতে আগ্রহী। আর যাদের কথা বললেন, অনুশোচনা নাই, কোনো ইয়ে নাই, এইটা হবেও না আসলে। আমি মনে করি, তারা যেনো বাংলাদেশে ঝঞ্ঝাটহীন জীবনযাপন করতে পারে। আমি এটারও গেরান্টি চাই। আমরা যেনো তাদেরকে ডিসটার্ব না করি। কিন্তু তারা যদি কখনো আমাদের জন্য ডিস্টার্ব হইয়া ওঠে তখন কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম বা আমরা খালি বইসা বইসা দেখবো না।
মুহিম মাহফুজ : শেষে বিশেষভাবে কী বলতে চান?
হাসান রোবায়েত : আমি আসলে বিশেষভাবে যেটা শেষে বললাম, আমার মনে হয় সেটাই আসলে বলা উচিৎ। আমি খুব ফিল করি যে, এদেশের সাধারন মানুষ আসলে প্রপার এডুকেশনটা পাক। মানে শিক্ষার জায়গাটা খুবই, খুবই, খুবই ইম্পোর্টেন্ট। এটাকে যেন সরকার গুরুত্ব দেয়, আমি চাই। দ্বিতীয়ত এই বেসিক শিক্ষার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মানুষের, মানে এই পুরা সাবকন্টিনেন্টের যে হিস্ট্রি, সেই হিস্ট্রির মেইন মেইন পার্টগুলো, সবকিছুই হয়তো দেখা-পড়া সম্ভব না আবার জানাও সম্ভব না আসলে, ফলে সেই মেইন পার্টগুলো যেন আসলেই পড়াশোনায় থাকে, সিলেবাসে আসে। আমার মনে হয় তাতেই ইনসাফওয়ালা একটা দেশ আমরা ইজিলি গড়তে পারবো অথবা ইজিলি ইনসাফের দিকে যাইতে পারবো। আর আমরা যেন গোঁ ধইরা পইড়া না থাকি কোনো একটা নির্দিষ্ট হিষ্ট্রিক্যাল মোমেন্ট, যদি আমি কেবলমাত্র পড়ে থাকি চব্বিশ নিয়ে বাঁ ধরেন শুধু ৭১ নিয়ে, তাইলে আমি খুব একটা আগাইতে পারবো না। বরং আমার এডুকেশনের মধ্যে যেন পুরো সাবকন্টিনেন্ট, যার সাথে বাংলাদেশের নানানভাবে ভাগ্য জড়িত ছিলো, পুরো সিস্টেমটা যেন আমাদের নতুন প্রজন্ম সিলসিলা ধরে ধরে, টাইম ধরে ধরে, জানতে পারে। এবং সে সিলসিলায় সে যেনো সামনের দিকে যায়। এইটা আমি খুব আশা করবো।
মুহিম মাহফুজ : আশা করি এমনটাই যেনো হয়। এমনটাই তো হতে হবে। ব্যতিক্রম হওয়ার তো কোনো রাস্তা নাই।
গাজা পুনরুদ্ধারের এই সময়ে ‘ফিলিস্তিন সাংস্কৃতিক পুরস্কার’ ঘোষণা করেছে ‘ফিলিস্তিন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট’। ১৩তম আসরের মূল থিম নির্ধারণ করা হয়েছে—‘জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা, গোটা ফিলিস্তিন ও জায়নবাদের বিরোধিতা’।
৩ দিন আগেএকশ বছর আগের কথা। ১৮৮৯ সাল। তুরিনে আজকের মতোই এক দিনে ফ্রিডরিখ নিৎশে কার্লো আলবার্তো পথের ৬ নম্বর বাড়ির ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন। কখনো হাঁটতে বের হতেন, আবার কখনো পোস্ট অফিসে চিঠিপত্র তুলতে যেতেন।
৪ দিন আগেবাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী আয়োজিত ইসলামি বইমেলায় প্রতিদিনই জড়ো হন হাজারো মানুষ। বিশেষত সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে বইপ্রেমীদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। আর এই জনস্রোতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একদল স্বপ্নবাজ তরুণের হাতে গড়া ‘লিটলম্যাগ কর্নার’।
৪ দিন আগেইসলাম-পূর্ব সময়ে এক ভয়ংকর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল যেন আরবরা। সমগ্র আরবে চলছিল ভয়াবহ অরাজকতা। গোত্রে গোত্রে শত্রুতা। সারাক্ষণ একে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টায় রত। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি ও মারামারি থেকে শুরু করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া; বছরের পর বছর ধরে সেই যুদ্ধ চলা।
৪ দিন আগে