ঘাসে জড়িয়ে থাকা কুয়াশার মতোই মাহবুব কাদির সম্প্রতি নীরব হয়ে থাকে। ম্লান, একেবারেই চুপচাপ। তার এই পরিবর্তনে সংসারের কারো কিছু যায়-আসে না, এটা সে জানে । এই বিশ্বাস স্থির হয়েছে ২০২২ সাল থেকে, যখন মাহবুব কাদির চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে।
যেদিন সে চাকরি থেকে অবসর নেয়, অফিসের বড় ট্রেনিং রুমে তাকে বিদায় জানানো হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন বক্তৃতা করেন মাহবুব কাদিরের দীর্ঘ জীবন নিয়ে, তখন সেও খুঁজে খুঁজে নিজের চাকরিজীবনের স্মৃতিগুলো খুঁটে খুঁটে দেখে। তার দু-একজন সহকর্মী যখন তার প্রশংসা করে একেবারে কেঁদে দিলেন, তখন মাহবুব কাদিরের চোখেও জল এলো।
সবচেয়ে বড় কর্তা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাহবুব সাহেব অসাধারণ একজন মানুষ; আমি যতদিন তাকে পেয়েছি, তার বদনামের কিছুই খুঁজে পাইনি। হাসিখুশি, সহজসরল ও উদ্যমী একজন কর্মকর্তাকে আমরা আজকে বিদায় জানাচ্ছি। তার জন্য একটি সারপ্রাইজ হলো, আমার পাওয়া তার কর্মকালীন জীবনের একটি ভিডিওচিত্র আমি ধারণ করে রেখেছি। এটি আপনাদের সামনে এখন দেখানো হবে।
মাহবুব কাদির তো অবাক! পাঁচ মিনিটের ভিডিওচিত্রটি দেখে সে সত্যিই হতবাক! চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি।
সে নাকি শেষ পর্যন্ত চিরতরুণ ছিল। সবার সঙ্গে সম্প্রীতি, কারো সঙ্গে কোনো মতবিরোধ নেই। কর্মে কখনোই ফাঁকি দিয়ে আসেনি জীবনে। তার ছিল অ্যাটেনডেন্সের সর্বোচ্চ রেকর্ড । পাংচুয়ালিটি ছিল তার জীবনে একটি ইবাদতের মতো।
অত প্রাণখোলা মানুষ যখন অবসরে গেল, তার ছয় মাসের মধ্যেই বুঝে ফেলল, এ সংসারে তার আর সরব থাকার সুযোগ নেই। মাহবুব কাদির তাই চুপ, একদম চুপ হয়ে গেল ।
এখন তার নির্ধারিত বেতন নেই, উপার্জনের পথ খোলা রেখে আসেনি সে। তাই সংসারে অপাঙ্ক্তেয় এবং বেকারত্বের গ্লানি নিয়ে টিকে আছে কেবল।
একদিন স্ত্রী বাজারের ফরমাশ ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘কোনো কিছু বাদ দিও না। সবগুলোই লাগবে।’
বাজার তালিকা দেখে মাহবুব কাদির হোঁচট খায়। মনে হয়, অনেক কিছুই অতিরিক্ত।
স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানোই তো আমার চাকরি নেই। এটির কিছু কিছু পরে আনলেও চলবে, আবার না আনলেও চলবে।’
শুরু হলো স্ত্রীর কুরুক্ষেত্রের বাগ্যুদ্ধ। মাহবুব কাদির কেঁপে ওঠে । চুপসে যায়, ঘরে যেন বাজ পড়েছে। বাগ্যুদ্ধের শব্দ পাশের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যায়।
মাহবুব কাদিরের মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার আগেই আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ টের পেয়ে দ্রুতই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের সামনে কোনো প্রতিবাদ করে না।
বাজারের দিকে যেতে যেতে ভাবে—‘আমার আর সরব হওয়া যাবে না। প্রাণচাঞ্চল্যমুখর হাসিখুশি জীবন আর নয়। আনন্দময় জীবন থেকেও অবসর নিতে হবে। অফুরন্ত শক্তি নিয়ে দুরন্ত উল্লাসে যে জীবন চালিয়েছি আমি, তা আর অব্যাহত থাকবে না।’
মাহবুব কাদির অবসর নিয়েছে স্ত্রীর ভালোবাসা থেকে বাঁচার জন্য। অবসর নিয়েছে ভার্সিটি পড়া মেয়ের আর কলেজ পড়া ছেলের কেয়ারিং থেকে। অবসর নিয়েছে সবকিছু থেকেই ।
এই যে অবসর নেওয়া, এর ভেতরের যে দহন—এ কথা কাকে বোঝাবে, কীভাবে বোঝাবে? এর মধ্যে যে অনন্ত শূন্যতায় ভরা এক জীবন । পরিবারের অবহেলা যে হাঙরের মতো ধেয়ে আসছে, তা কাকে বলা যায়?
চাকরিকালে মাঝেমধ্যে মনের খেয়ালেই দু-একটি গল্প-কবিতা লিখত; দু-একটি পত্রিকায় যে ছাপানো হয়নি তা নয় । এসব দেখে স্ত্রী-সন্তানরা খুব খুশি মনে গ্রহণ করত। কিন্তু এখন?
এখন এসব কথা কারোরই ভালো লাগে না । অবসরকালীন জীবনে সে যখন একটু লিখতে বসে, তখনো স্ত্রীর চোখমুখে রোদের ছটা দেখতে হয়। জীবনের এই যে পরিবর্তন, এই যে অবসরকালীন দুঃখ বেদনার প্রবহমান স্রোত—কীভাবে ঠেকাবে?
উপায় বের করে অনেক ভেবেচিন্তে; ভাবে, এভাবে তো জীবন বয়ে যেতে পারে না ।
কদিন পর আজাহার মল্লিক সাহেব কল দিলেন—‘মাহাবুব সাহেব, কেমন আছেন, কী করছেন? রিটায়ার্ড লাইফে নিশ্চয়ই ভাবিকে নিয়ে ঘুরছেন?’
মাহবুব সালামের জবাব দিয়ে বলে, ‘না রে ভাই, বুড়ো মানুষ বাইরে যাব কীভাবে? শরীর কি সাপোর্ট করে?’
মনের অজান্তেই মাহবুব কাদিরের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তা আজাহার সাহেবের অনুমান থেকে সরে যায়নি।
বললেন, একদিন বাসায় আসুন না । গল্প করা যাবে। আমিও চার মাস হলো অবসরে গিয়েছি । আপনার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে । কত কথা যে আপনি জানেন, আড্ডা জমিয়ে কথা বলেন । অফিসের সবাই আপনার প্রশংসা করে । আসুন।
একদিন সময় করে মাহবুব বেরিয়ে যায় আজাহারের বাসার উদ্দেশে। বেশি দূরে নয়; আজিমপুর থেকে পল্লবী। মাহবুব কাদির বাসে চড়তে পারেন না, তাই একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় উঠলেন । ধবধবে আকাশ, ঝাঁঝালো রোদও রয়েছে; কিন্তু কী একটা বিচ্ছিরি অবস্থা, হঠাৎ করেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। কিছুটা ভিজেও গেল। তারপরও মনে এক ধরনের প্রশান্তি।
আজাহার সাহেবের ফ্ল্যাট বেশ বড়, ১৬০০ স্কয়ার ফিট । সাজানো-গোছানো। ড্রয়িং রুমে দামি সোফা, বেশ বড় এলইডি টিভি।
মাহবুব সাহেবকে পেয়ে তার খুব আনন্দ । একেবারে কোলাকুলি করে সোফায় বসিয়ে দিলেন—‘বলেন কী খাবেন? চা না কফি?’
‘আরে ভাই, কিছুই খাব না। এসেছি শুধু একটু সময় কাটানোর জন্য । এখন তো অবসরে যাওয়া লোকদের কেউ পছন্দ করে না। বোঝা মনে করে ।’
কথার কথায় আজাহার জানায়, ‘মাহবুব সাহেব, আমি যে বুঝি না, তা নয় । গত ক’মাসে আমি টের পেয়েছি। আমিও এ সংসারে অপ্রয়োজনীয়। যে জীবন দিয়েছি স্ত্রী-সন্তানের জন্য, আজ সেই জীবনে কোনো সুখ নেই রে, ভাই। সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে, যার যার নেশায় । আমার স্ত্রী কখন কোথায় যায়, জানি না। মেয়েটি শুনেছি এক ছেলের সঙ্গে সন্ধ্যারাত পর্যন্ত বাইরে থাকে। আপনি শুনেছেন কি না আমার বড় ছেলেটি প্রতিবন্ধী । সে পাশের কক্ষে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা একা পড়ে থাকে । আর ছোট ছেলে তো মাত্র ক্লাস এইটে। তারও পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। বিকাল হতে না হতেই বন্ধুদের নিয়ে মহল্লার আড্ডা । কখন যে কী হয়—এই টেনশনে নিজেই চুপসে থাকি, ভাই। আপনার কি মতিন সাহেবের কথা মনে আছে? তার যে ছেলেটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিল, সে এখন জেলে। চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না, ভাই।’
আজাহারের কথা শুনে মাহবুব কাদির নিজেকে অনেকটা হালকা ভাবে—‘তাহলে কি অবসরপ্রাপ্ত সবার জীবনে হতাশা? সব সংসারী অবসরদের এই অবস্থা?’ আরো কিছু সময় কাটিয়ে নিজের ঘরের দিকে ফেরে।
কলিং বিল টিপে দিলে মেয়ে দরজা খোলে। কোনো কথা না বলেই ভেতরে চলে যায়। মাহবুব কাদির ক্লান্ত শরীরে নিজের বেডরুমে আসে। ফ্যান ছাড়ে। একটু দম নিয়ে স্ত্রীকে ডাকে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। এদিক-সেদিক উঁকি দিয়ে দেখে, ঘরে নেই । কোথায় গেল? তবে কি আজাহার সাহেবের স্ত্রীর মতোই? সেও বাইরের জগৎ চিনে গেল? নাকি আগেই চিনত, তার কাছে ধরা পড়ল মাত্র? মাহবুব কাদির এ বৈরী জীবনের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাত হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে।

