বার্ষিক পরীক্ষার আগে শিক্ষকদের লাগাতার আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন

রকীবুল হক
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০১: ১০

দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের বার্ষিক পরীক্ষা চলতি মাসের শেষদিকে শুরু হতে যাচ্ছে। বছরের শেষদিকের এ সময়টাতে শিক্ষার্থীদের ওপর পড়াশোনার বাড়তি চাপ থাকে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে এসে শ্রেণি কার্যক্রম বাদ দিয়ে রাজপথে আন্দোলনরত অসংখ্য শিক্ষক। বিভিন্ন দাবিতে একের পর এক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার পর্যন্ত রাজধানীতে অন্তত পাঁচটি সংগঠনের ব্যানারে রাস্তায় ছিলেন শিক্ষকরা।

পরীক্ষার আগে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করে শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন নিয়ে তাই সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ মুহূর্তে এমন আন্দোলন করে সরকারকে চাপে ফেলে দাবি আদায়ের সুযোগ হিসেবে দেখছেন অনেকে। এছাড়া সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার তাদের বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি মেনে নেওয়ায় অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছেন বলেও অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

বিজ্ঞাপন

আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়েও পূরণ না হওয়ায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন তারা। পতিত আওয়ামী সরকারের সময় নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও তা পূরণ করা হয়নি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অনেক আশা নিয়ে তারা রাস্তায় নেমেছেন। আন্দোলন চললেও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল আছে বলে জানান শিক্ষক নেতারা। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার জন্য উল্টো সরকারকেই দায়ী করেন তারা।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করায় আন্দোলনকারীরা আরো উদ্দীপ্ত হচ্ছেন। সরেজমিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রধান সড়কগুলোতে এসব আন্দোলন ঘিরে চরম অস্থিরতা লক্ষ করা গেছে। যান চলাচল বিঘ্নের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের মতো অবস্থার সৃষ্টিও হচ্ছে।

বর্তমানে রাজধানীতে আন্দোলনরত শিক্ষক সংগঠনের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ, সম্মিলিত নন-এমপিও ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতি এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষক ঐক্যজোট। এসব সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলনকারী সবাই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের উদ্বেগ

চলমান শিক্ষক আন্দোলনের কারণে সারা দেশে শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হওয়ার শঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। সংগঠনটির সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু আমার দেশকে বলেন, বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান ব্যাহত হলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের ধারাবাহিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে; যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এভাবে দাবি আদায়ের চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষকরা ক্লাস চালু রেখে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নন-এমপিও শিক্ষকদের মিছিলে পুলিশের বাধা

এমপিওভুক্তির দাবিতে গত ২ নভেম্বর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। গতকাল অষ্টম দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচির এক পর্যায়ে বেলা ৩টার দিকে মিছিল নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করাসহ সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান থেকে পানি নিক্ষেপ করে পুলিশ। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান শিক্ষকরা।

এ বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক সংগঠনটির সভাপতি সেলিম মিয়া আমার দেশকে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশের হামলায় আমাদের শতাধিক শিক্ষক আহত হন।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের সক্ষমতার মধ্যেই বেতন চাচ্ছি। প্রায় দুই হাজার ২০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও হওয়ার যোগ্য। আমরা বলেছি, এখন এমপিওর টাকা না দিলেও কোডটা দেওয়া হোক। কিন্তু সরকার আমাদের কথা শুনছে না। দাবি মানা না হলে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণার বিষয়ে আজ সোমবার সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর কথা বলেন তিনি।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, এই দাবি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো তৎপরতা নেই।

লাগাতার কর্মবিরতিতে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকরা

দশম গ্রেডে বেতন-ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে গত শনিবার থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। আগামী ১৫ নভেম্বরের পর কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। কিন্তু প্রথম দিন শাহবাগে ‘কলম সমর্পণ’ কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ঘটনায় তা এগিয়ে এনে গতকাল রোববার থেকেই সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দেয় প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ। আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কাফনের কাপড় হাতে শপথ নেন শিক্ষকরা।

তাদের অন্য দুটি দাবি হলো শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি এবং চাকরির ১০ ও ১৬ বছরপূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড দেওয়া।

এদিকে, শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন ও দাবি যুক্তিসংগত নয় বলে মন্তব্য করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। গত শনিবার খুলনায় একটি অনুষ্ঠান শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সহকারী শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থান ১৩তম গ্রেড। প্রধান শিক্ষকদের আমরা সবেমাত্র দশম গ্রেডে উন্নীত করেছি, তাহলে সহকারী শিক্ষকদের হঠাৎ করে ১৩তম গ্রেড থেকে কীভাবে দশম গ্রেডে উন্নীত করব?

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দুই ধাপ বাড়িয়ে ১১তম করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

আজ অনশনে বসছেন ইবতেদায়ী শিক্ষকরা

প্রক্রিয়াধীন ১০৮৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাকে এমপিওভুক্তির গেজেট প্রকাশসহ বিভিন্ন দাবিতে টানা ২৮ দিন ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন শিক্ষকরা। গত সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট ফাইলে প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরসহ দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে শিক্ষকরা আন্দোলন আরো জোরদার করছেন।

এ বিষয়ে ইবতেদায়ী শিক্ষা উন্নয়নের মহাসচিব মো. রেজাউল হক আমার দেশকে জানান, আমাদের আশ্বাস দেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। দাবি আদায়ে সোমবার অর্ধদিবস এবং মঙ্গলবার থেকে পূর্ণদিবস অনশন কর্মসূচি পালন করা হবে।

প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় সমন্বয় পরিষদের অবস্থান

স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির দাবিতে ১৫ দিন ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গতকাল রোববার দুপুরে তারা মিছিল নিয়ে পল্টন মোড় ঘুরে এসে সচিবালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়।

পরে শিক্ষকদের ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে গিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় তাদের দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে জানানোর আশ্বাস দেওয়া হয়।

বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থান

দেশের প্রায় পাঁচ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরা।

আন্দোলনকারী শিক্ষকরা জানান, দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিনা পারিশ্রমিকে তারা দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমান সরকারের সময় তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ার আশা থাকলেও তা না হওয়ায় আন্দোলনে নেমেছেন। তবে তাদের স্কুলগুলোতে শিক্ষাকার্যক্রম চালু আছে বলে জানানো হয়।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত