হারুনের অপকর্মের সহযোগী ছিলেন পুলিশের ৫ কর্মকর্তা

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১১: ৩৯
আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১১: ৫৫
বাঁ থেকে ছবির ওপরের সারিতে সাইবার বিভাগের নাজমুল আলম, এডিসি আসমা আরা জাহান; নিচের সারিতে এডিসি রফিকুল ইসলাম ও শাহেন শাহ। মাঝে হারুন-অর-রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ভর করেছিলেন। বিশেষ করে পুলিশ ও র‌্যাব দিয়ে বিরোধী মতের ওপর অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ করে দমন-নিপীড়ন চালানো হয়েছিল। যে যত বেশি বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের দমন ও নিপীড়ন চালিয়েছে তাকে দ্রুত পদোন্নতি ও পদকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদ। তিনি ডিবিতে কথিত ভাতের হোটেল খোলেন। এই ভাতের হোটেলে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, সেলিব্রেটি পারসন, চলচ্চিত্র-নাটকের নায়ক-নায়িকা, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা পেশার লোকজনকে তার সঙ্গে বসে খেতে দেখা গেছে। তাদের খাইয়ে কৌশলে এসব ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি ছাড়তেন। তার ভাতের হোটেলের খপ্পরে পড়েন খোদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।

সেগুলো নিয়ে সমালোচনা হলেও তিনি কোনো পাত্তা দিতেন না বরং আরো বেশি বেশি করে তিনি ওই ভিডিও আপলোড করতেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সমন্বয়কদের ডিবিতে ধরে এনে জোর করে বিবৃতি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০১১ সালের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের সামনে তৎকালীন চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুককে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

বিজ্ঞাপন

খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশকারায়ই তিনি পুলিশের মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনের সময় তার বিষয়ে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বরং তার পদোন্নতি হয়েছে। বিরোধী মতের লোকজনকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে টাকা আদায়, চাঁদাবাজি, জিম্মি করা, আটকে রেখে নির্যাতন, জমি দখল, গুম ও মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ এমন কোনো অভিযোগ নেই যা তার বিরুদ্ধে ছিল না। সর্বশেষ তার কর্মস্থল ছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি)। তিনি অতিরিক্ত কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা এসপির পর হারুন ডিবিতে পোস্টিং পান। এই ডিবিতে তিনি নিজের একটি বলয় গড়ে তোলেন। বিষয়টি খোদ তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার জেনেও মুখ খুলতে পারেননি শুধু হারুনের প্রভাবের কারণে। ডিএমপি কমিশনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন বিষয়টি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালও হারুনকে কিছু বলেননি। এতে দিন দিন তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ডিবিতে তার বিরুদ্ধে কোনো কর্মকর্তা টুঁ-শব্দ করলে তাকে বিএনপি-জামায়াতের কর্মকর্তা ট্যাগ লাগিয়ে ডিবি থেকে অন্য কোনো স্থানে পোস্টিং করতেন। তার এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ডিবির ওয়ারী জোনের ডিসি আবদুল আহাদ।

আহাদকে ডিবি থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য তিনি তাকে বিএনপির কর্মকর্তা বলে প্রচারণা চালান। তাকে বিদায় না করতে পেরে তিনি এক ব্যবসায়ীকে দিয়ে ডিবিতে পরিকল্পিতভাবে তার নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ করান। পরে বিষয়টি প্রমাণ না হলেও হারুনের ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার কোনো উদ্যোগ নেননি।

সূত্র জানায়, ডিবিতে তার পঞ্চপাণ্ডব বলে ৫ জন কর্মকর্তা পরিচিত ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ডিবির মতিঝিল জোনের এডিসি রফিকুল ইসলাম। তিনি হারুনের ডান হাত বলে পরিচিত। তিনিও ৫ আগস্টের পরে পলাতক আছেন। হারুন ওই রফিকুলকে দিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করাতেন। জমি দখল ও টাকা উদ্ধারে পারদর্শী ছিলেন রফিকুল। বিএনপির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে ধরে নিয়ে নির্মম মারধর করেছিলেন রফিকুল। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরের বাসায় গিয়ে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন এই রফিকুল।

সূত্র জানায়, হারুনের পঞ্চপাণ্ডবের আরেকজন হলেন সাইবার বিভাগের নাজমুল আলম। কিছুদিন আগে তার নামে একটি প্রতারণার মামলা হয়েছে। তিনি মামলার পর পলাতক আছেন। তার নামে পরিকল্পিতভাবে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যেসব ইউটিউবারের ভিউ বেশি ছিল তাদের তিনি ডিবিতে ডেকে তার নামে ইউটিউব অ্যাকাউন্টটি নিজের নামে করাতেন। নওগাঁর এক ইউটিউবার ডিএমপি কমিশনার বরাবর এমন একটি অভিযোগ দিয়েছেন।

জানা গেছে, হারুনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন শাহেন শাহ। তিনি বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনকে বিভিন্ন অজুহাতে ধরে নিয়ে টাকা আদায় করতেন। ৫ আগস্টের পর তিনি জেল হাজতে গেছেন। তার নামে ডিএমপি কমিশনারের কাছে প্রায় ২০টিও বেশি অভিযোগ পড়েছে।

সূত্র জানায়, হারুনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন ৩০তম ব্যাচের এডিসি মনিরুল ইসলাম। হারুনের টাকা পাচারে তিনি বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এছাড়া মাফিয়া এস আলমের যোগাযোগ ছিল এই মনিরুলের সঙ্গে। সূত্র জানায়, হারুনের অন্যতম আরেক সহযোগী ছিলেন এডিসি আসমা আরা জাহান। তিনি ডিবি-মাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দেড় বছর আগে আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাদা মহিউদ্দিনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া ৩৪ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন হারুন ও আসমা। পরে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার এর সমাধান করেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত