
এমরানা আহমেদ

পূবালী পাড়ার মা পঞ্চাশোর্ধ্ব আখতার বানু। সমাজের এতিম, বাবা-মায়ের যত্নবঞ্চিত, ঝুঁকিতে থাকা পরিবারহারা শিশুদের প্রতিপালন করেন তিনি। ২৬ বছর ধরে আদর-যত্ন, মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলছেন শিশুদের। তার সন্তানরা অনেকে আজ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত।
রাজধানী শ্যামলীতে এসওএস (সেভ আওয়ার সোল) শিশুপল্লীতে এই মমতাময়ী মায়ের বাস। মমতাপাড়া, সোনালিপাড়া ও দিশারিপাড়া নামের তিনটি পাড়া মিলে চলে শিশুপল্লীর কার্যক্রম। যেখানে কর্মরত আছেন ১৫ জন বেতনভুক্ত মা। এই মায়েদের আছে ১৫টি পরিবার। প্রতিদিন তাদের পরিবারে থাকা বিভিন্ন বয়সি ৭-৮ জন সন্তানের সবকিছু দেখাশোনা করেন।
স্কুলের টিফিনসহ তিন বেলা খাবার তৈরি, পড়াশোনা করানো, রাতে ঘুম পাড়ানো সবই একহাতে সামলান। প্রতিদিন এসব করতে করতে এ মায়েরা ভুলে যান এটা তাদের চাকরি। এসব শিশু লালনপালন করতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই মা হয়ে ওঠেন তারা। এক সময় সন্তানের সামনে মা মানেই ভেসে ওঠে এই কর্মজীবী মায়েদের চেহারা। এসওএস শিশুপল্লীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমাজের অবহেলিত শিশুদের জীবন গঠনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তারা। শিশু লালনপালনকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন এই মায়েরা।
শিশুপল্লীতে মুসলমান শিশুদের পাশাপাশি হিন্দু ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা দুটি পরিবারে দুজন মা আছেন। প্রতিটি পাড়ায় আছে পাঁচটি করে পরিবার। এই পরিবারে একেকজন মায়ের বর্তমান সন্তানসংখ্যা ৭-৮ জন। বর্তমানে এ পল্লিতে আছে ১২৬ জন ছেলেমেয়ে। তারা সবাই নিজেদের ভাইবোন বলে পরিচয় দেয়।
সমাজে এতিম অথবা কোনো কারণে বাবা-মায়ের যত্নবঞ্চিত, ঝুঁকিতে থাকা পরিবারহারা শিশুদের এখানে পারিবারিক পরিবেশে লালন করা হয়। মায়েদের সহায়তার জন্য আছেন বেতনভুক্ত খালাম্মা। পল্লির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এই শিশুরা ভাইয়া ডাকে। সব মিলে পল্লির ভেতরে বিশাল পরিবারে আন্তরিকপূর্ণ পরিবেশে তারা বসবাস করছে।
সরেজমিন শ্যামলীর শিশুপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় আড়াই একর জায়গায় লাল ইটের ছোট ছোট দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি। সবুজ ঘাসের মধ্যে পাকা সরু রাস্তা দিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়া যায়। বাড়িগুলোর চারপাশ আম, পেয়ারা, কামরাঙা, সুপারি, কাঁঠালসহ নানা গাছে ঘেরা। সবুজ ঘাসের বড় মাঠ। জবা, কামিনী, গোলাপসহ নানান ফুলের গাছ। প্রকৃতির এ বিশালতার মধ্যেই বড় হচ্ছে বিভিন্ন বয়সি শিশুরা।
মমতাপাড়ার ঝুমা কোরাইয়া, দিশারিপাড়ার লতিকা রানী মণ্ডল, শিরিনা বেগমসহ একাধিক মায়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা জানান, শুক্রবার বন্ধের দিন তাদের ব্যস্ততা একটু বেশি থাকে। ছেলেমেয়েদের স্কুলের ড্রেস ধোয়া, তাদের বায়না অনুযায়ী একটু ভালো খাবার রান্নাসহ দম ফেলার ফুরসত থাকে না তাদের।
দুপুরে খাবার টেবিলে দেখা গেল, একবার এক ছেলের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন তো আবার অন্য মেয়ের পাতের দিকে নজর দিচ্ছেন। এই মায়ের ঘরেই তার ছবির বদলে আরেক মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন ছেলেমেয়ের ছবি টাঙানো। শিরিনা বেগম জানালেন, তার আগে এই মা এই পরিবারে ২৪ বছর দায়িত্ব পালন করে মারা যান। তার ছেলেমেয়েরা যারা বিভিন্ন জায়গায় আছেন, তারা তো এই মাকেই দেখতে পল্লিতে আসেন। তাই ছবিটি আর নামানো হয়নি।
শ্যামলীর শিশুপল্লির তিনটি পাড়ায় মায়ের অধীনে যে বাড়িগুলো আছে, তার নাম হচ্ছেÑসোনালি, রুপালি, পূবালী, কাকলি, শ্যামলী, মমতা, সমতা, জনতা, একতা, সততা, দিশারি, রূপসী, মায়াবী, জোনাকি ও সন্ধানী। বাড়িগুলো টেলিভিশন, ফ্রিজ, আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। মা ঠিক করেন, কোন সন্তানের জামা কিনতে হবে বা কোন সন্তানের জুতা প্রয়োজন।
কর্মজীবী দুই সন্তানের মা নার্গিস বেগমের সঙ্গে দেখা হলো শিশুপল্লিতে। এক বছর বা দুই বছরের মাথায় তিনি পল্লিতে এসেছিলেন। এখান থেকেই তার বিয়ে হয়েছে। চাকরি বা ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সমস্যা হলে বা দুই মেয়ে নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে আসেন এখানে। তিনি তার নিজের জীবনের ইতিহাস জানতে পেরেছিলেন এসএসসি পরীক্ষার পর। বিয়ের সময় ছেলেপক্ষকে সব জানিয়েই বিয়ে হয়েছে।
এসওএস শিশুপল্লীর কর্তৃপক্ষের স্বপ্নÑপ্রত্যেক শিশু একটি পরিবারে ভালোবাসা, সম্মান ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বড় হবে। অনাথ শিশুদের যত্নশীল পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তোলা একজন মায়ের মূল দায়িত্ব। তাদের অর্থসহ সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা করে প্রতিষ্ঠানটি।
জানা যায়, ‘মা’ নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার সময় এ শিশুদের জীবন গঠনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন তারা। এ প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য এসওএস শিশুপল্লী তাদের প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এখানে আগত মায়েরা শিশুর লালনপালনকে জীবনের ব্রত হিসেবে দেখেন। সাধারণত বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা একজন শিক্ষিত নারী মা হিসেবে নিয়োগ পান।
এসএসসি পাসের পর এসব সন্তানের মধ্যে ছেলেদের যুব হোমে এবং মেয়েদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন হোস্টেলে রাখা হয়। পল্লিতে থেকে যেতে চাইলে তাদের জন্য বাসভবনের ব্যবস্থা রয়েছে।
সাধারণত ছয় বছরের নিচের অনাথ ছেলেমেয়েকে শিশুপল্লিতে ভর্তি নেওয়া হয়। শিশুর আত্মীয় অথবা পরিচিত বা অপরিচিত কেউ শিশুপল্লিতে আবেদন করে। এরপর তদন্তসাপেক্ষ ভর্তি নেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যতিক্রমও আছে।
মায়াবী পাড়ার মা আজিরন খাতুন আমার দেশকে বলেন, আমি পেশাদার মা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। কিন্তু কখন যে সত্যিকার মা হয়ে গেছি, তা নিজেও জানি না। এ সন্তানদের বায়না মেটাতে ভুলেই যাই বাড়িতে আমার নিজের একটি ছেলে আছে। এই ছেলেমেয়েরাও আমার দিকে খেয়াল রাখে। মন খারাপ হলে আদর করে।
এমনি এক মা রহিমা বিবি বলেন, আমি ১৯ বছর ধরে এসওএস শিশুপল্লীতে শিশু লালনপালনের কাজ করছি। আমার সন্তান না থাকায় এখন এরাই সন্তান। তিনি বলেন, আমি এ পেশাকে খুবই উপভোগ করছি। বর্তমানে আমার ৯ শিশু রয়েছে। কিছু শিশু চলে যায়, আবার নতুন করে কয়েকজন যুক্ত হয়। আমার লালনপালন করা শিশুরা অনেকে এখন প্রতিষ্ঠিত। তাদের কথা মনে পড়লে গর্বে বুকটা ভরে যায়।
আরেক মা ফাতেমা বেগম বলেন, আমারও ৮ শিশু। আমি তাদের লালনপালন করছি। আমার নিজের দুটি মেয়ে রয়েছে। তারা বড় হয়েছে। তারা আমার আত্মীয়র কাছে থাকে। তিনি বলেন, শিশু লালনপালন আমার কাছে ভালোই লাগে। এসব শিশুর সঙ্গে কীভাবে যে সময় কেটে যায়, তা টেরই পাই না।
এসওএস শিশুপল্লীর সহকারী পরিচালক (প্রোগ্রাম) মোঃ আনিসুর রহমান আমার দেশকে বলেন, আমি এখানে যোগদানের পর কাজটিকে খুব উপভোগ করছি। একজন অনাথ সন্তানকে লালন করতে পারাটা সত্যিই সৌভাগ্যের। তিনি বলেন, এখানকার মায়েরা পরিবার-পরিজন বিসর্জন দিয়ে এখানে সন্তানদের লালনপালন করছেন, যা সত্যিই গর্ব করার মতো একটা ব্যাপার। অসহায় শিশুরাগুলো আমাদের ভাইয়া বলে সম্বোধন করে। ওদের বুকে ভাইয়া ডাকটা শুনতে ভারী মিষ্টি লাগে। এটা চাকুরি মনে করি না, প্রতিনিয়তই কাজটা উপভোগ করি বলে জানালেন আনিসুর রহমান।
বেসরকারি সমাজ উন্নয়নমূলক সংস্থা এসওএস শিশুপল্লী (চিলড্রেনস ভিলেজেস) বাংলাদেশের নতুন কান্ট্রি প্রধান ডা. এনামুল হক জানান, এখানে সাধারণত বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারীরা মা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আসেন। নিয়োগের পর তিন মাস চলে প্রশিক্ষণ। এরপর যত দিন কর্মক্ষম থাকেন, তত দিন মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তিনি বলেন, মায়েরা প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং পেনশন বা অবসরভাতা পান। কোনো মায়ের যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকলে তিনি শিশুপল্লির ভেতরে ‘মাদারস রিটায়ার্ড হোম’-এ বিনামূল্যে থাকতে পারেন। এদের সন্তানদের কেউ অধ্যাপক, কেউ চিকিৎসক, কেউবা বিদেশে পিএইচডি করছেন।
ডা. এনামুল হক জানান, আবার কোনো সন্তানের বয়স হয়তো সাড়ে তিন মাস বা কয়েক বছর। ছয় বছরের কম বয়সি যে বয়সেই আসুক, সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে এবং চাকরি না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ২৬-২৭ বা তারও বেশি বয়স পর্যন্ত তাদের দেখভালের দায়িত্ব এ মায়েদের। এই দীর্ঘ সময়ে মা ও সন্তানের সম্পর্ক এতটাই গাঢ় হয় যে, তারপর আর চেষ্টা করলেও বন্ধন আলগা হয় না।
ঢাকা এসওএস শিশুপল্লীর প্রকল্প পরিচালক মো. ইউসূফ আলী জানান, আমাদের শিশু সদস্যরা বড় হলে মেধা অনুযায়ী যতদূর পড়তে চায়, যেখানে পড়তে চায়, সে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দেশ- বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তায় চলছে এখানকার কার্যক্রম। ছেলেশিশুরা শিশুপল্লীতে ১৪ বছর পর্যন্ত থাকার সুযোগ পায়। তারপর তাদের স্থান হয় মিরপুরের যুবপল্লীতে। আর মেয়ে শিশুরা ১৮ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। স্বনির্ভর হতে না পারলে অনেক সময় ২৬ বছর বয়স অবধি দেখভাল করে শিশুপল্লী।
তিনি জানান, দুঃসহ পরিবেশ থেকে যন্ত্রণা নিয়ে পল্লিতে শিশুরা আসে। ছয় মাস থেকে এক বছর যাওয়ার পর তাদের মুখে প্রশান্তির যে হাসি দেখতে পাওয়া যায়, সেটাই শিশুপল্লির সার্থকতা। তিনি শুধু প্রকল্প পরিচালকই নন, এখানকার সব অনাথ শিশুর বাবাসুলভ অভিভাবকও বটে। শিশুপল্লির সঙ্গে কাজ করতে পেরে গর্বিত বলেও জানালেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে অনেক শিশু মাতৃ-পিতৃহীন হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন অস্ট্রিয়ার নাগরিক অধ্যাপক হারম্যান মেইনার। সেই থেকেই ১৯৪৯ সালে তিনি অস্ট্রিয়ায় প্রথম এসওএস শিশুপল্লী প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশসহ ১৩৫টি দেশে কাজ করছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাটি। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হয়। শিশু ও যুবপল্লীর ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে ১৯৮৬ সালে মিরপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজ। ঢাকাসহ বর্তমানে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও সিলেটে শিশুপল্লির কার্যক্রম চলছে।

পূবালী পাড়ার মা পঞ্চাশোর্ধ্ব আখতার বানু। সমাজের এতিম, বাবা-মায়ের যত্নবঞ্চিত, ঝুঁকিতে থাকা পরিবারহারা শিশুদের প্রতিপালন করেন তিনি। ২৬ বছর ধরে আদর-যত্ন, মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলছেন শিশুদের। তার সন্তানরা অনেকে আজ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত।
রাজধানী শ্যামলীতে এসওএস (সেভ আওয়ার সোল) শিশুপল্লীতে এই মমতাময়ী মায়ের বাস। মমতাপাড়া, সোনালিপাড়া ও দিশারিপাড়া নামের তিনটি পাড়া মিলে চলে শিশুপল্লীর কার্যক্রম। যেখানে কর্মরত আছেন ১৫ জন বেতনভুক্ত মা। এই মায়েদের আছে ১৫টি পরিবার। প্রতিদিন তাদের পরিবারে থাকা বিভিন্ন বয়সি ৭-৮ জন সন্তানের সবকিছু দেখাশোনা করেন।
স্কুলের টিফিনসহ তিন বেলা খাবার তৈরি, পড়াশোনা করানো, রাতে ঘুম পাড়ানো সবই একহাতে সামলান। প্রতিদিন এসব করতে করতে এ মায়েরা ভুলে যান এটা তাদের চাকরি। এসব শিশু লালনপালন করতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই মা হয়ে ওঠেন তারা। এক সময় সন্তানের সামনে মা মানেই ভেসে ওঠে এই কর্মজীবী মায়েদের চেহারা। এসওএস শিশুপল্লীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমাজের অবহেলিত শিশুদের জীবন গঠনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তারা। শিশু লালনপালনকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন এই মায়েরা।
শিশুপল্লীতে মুসলমান শিশুদের পাশাপাশি হিন্দু ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা দুটি পরিবারে দুজন মা আছেন। প্রতিটি পাড়ায় আছে পাঁচটি করে পরিবার। এই পরিবারে একেকজন মায়ের বর্তমান সন্তানসংখ্যা ৭-৮ জন। বর্তমানে এ পল্লিতে আছে ১২৬ জন ছেলেমেয়ে। তারা সবাই নিজেদের ভাইবোন বলে পরিচয় দেয়।
সমাজে এতিম অথবা কোনো কারণে বাবা-মায়ের যত্নবঞ্চিত, ঝুঁকিতে থাকা পরিবারহারা শিশুদের এখানে পারিবারিক পরিবেশে লালন করা হয়। মায়েদের সহায়তার জন্য আছেন বেতনভুক্ত খালাম্মা। পল্লির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এই শিশুরা ভাইয়া ডাকে। সব মিলে পল্লির ভেতরে বিশাল পরিবারে আন্তরিকপূর্ণ পরিবেশে তারা বসবাস করছে।
সরেজমিন শ্যামলীর শিশুপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় আড়াই একর জায়গায় লাল ইটের ছোট ছোট দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি। সবুজ ঘাসের মধ্যে পাকা সরু রাস্তা দিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়া যায়। বাড়িগুলোর চারপাশ আম, পেয়ারা, কামরাঙা, সুপারি, কাঁঠালসহ নানা গাছে ঘেরা। সবুজ ঘাসের বড় মাঠ। জবা, কামিনী, গোলাপসহ নানান ফুলের গাছ। প্রকৃতির এ বিশালতার মধ্যেই বড় হচ্ছে বিভিন্ন বয়সি শিশুরা।
মমতাপাড়ার ঝুমা কোরাইয়া, দিশারিপাড়ার লতিকা রানী মণ্ডল, শিরিনা বেগমসহ একাধিক মায়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা জানান, শুক্রবার বন্ধের দিন তাদের ব্যস্ততা একটু বেশি থাকে। ছেলেমেয়েদের স্কুলের ড্রেস ধোয়া, তাদের বায়না অনুযায়ী একটু ভালো খাবার রান্নাসহ দম ফেলার ফুরসত থাকে না তাদের।
দুপুরে খাবার টেবিলে দেখা গেল, একবার এক ছেলের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন তো আবার অন্য মেয়ের পাতের দিকে নজর দিচ্ছেন। এই মায়ের ঘরেই তার ছবির বদলে আরেক মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন ছেলেমেয়ের ছবি টাঙানো। শিরিনা বেগম জানালেন, তার আগে এই মা এই পরিবারে ২৪ বছর দায়িত্ব পালন করে মারা যান। তার ছেলেমেয়েরা যারা বিভিন্ন জায়গায় আছেন, তারা তো এই মাকেই দেখতে পল্লিতে আসেন। তাই ছবিটি আর নামানো হয়নি।
শ্যামলীর শিশুপল্লির তিনটি পাড়ায় মায়ের অধীনে যে বাড়িগুলো আছে, তার নাম হচ্ছেÑসোনালি, রুপালি, পূবালী, কাকলি, শ্যামলী, মমতা, সমতা, জনতা, একতা, সততা, দিশারি, রূপসী, মায়াবী, জোনাকি ও সন্ধানী। বাড়িগুলো টেলিভিশন, ফ্রিজ, আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। মা ঠিক করেন, কোন সন্তানের জামা কিনতে হবে বা কোন সন্তানের জুতা প্রয়োজন।
কর্মজীবী দুই সন্তানের মা নার্গিস বেগমের সঙ্গে দেখা হলো শিশুপল্লিতে। এক বছর বা দুই বছরের মাথায় তিনি পল্লিতে এসেছিলেন। এখান থেকেই তার বিয়ে হয়েছে। চাকরি বা ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সমস্যা হলে বা দুই মেয়ে নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে আসেন এখানে। তিনি তার নিজের জীবনের ইতিহাস জানতে পেরেছিলেন এসএসসি পরীক্ষার পর। বিয়ের সময় ছেলেপক্ষকে সব জানিয়েই বিয়ে হয়েছে।
এসওএস শিশুপল্লীর কর্তৃপক্ষের স্বপ্নÑপ্রত্যেক শিশু একটি পরিবারে ভালোবাসা, সম্মান ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বড় হবে। অনাথ শিশুদের যত্নশীল পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তোলা একজন মায়ের মূল দায়িত্ব। তাদের অর্থসহ সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা করে প্রতিষ্ঠানটি।
জানা যায়, ‘মা’ নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার সময় এ শিশুদের জীবন গঠনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন তারা। এ প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য এসওএস শিশুপল্লী তাদের প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এখানে আগত মায়েরা শিশুর লালনপালনকে জীবনের ব্রত হিসেবে দেখেন। সাধারণত বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা একজন শিক্ষিত নারী মা হিসেবে নিয়োগ পান।
এসএসসি পাসের পর এসব সন্তানের মধ্যে ছেলেদের যুব হোমে এবং মেয়েদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন হোস্টেলে রাখা হয়। পল্লিতে থেকে যেতে চাইলে তাদের জন্য বাসভবনের ব্যবস্থা রয়েছে।
সাধারণত ছয় বছরের নিচের অনাথ ছেলেমেয়েকে শিশুপল্লিতে ভর্তি নেওয়া হয়। শিশুর আত্মীয় অথবা পরিচিত বা অপরিচিত কেউ শিশুপল্লিতে আবেদন করে। এরপর তদন্তসাপেক্ষ ভর্তি নেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যতিক্রমও আছে।
মায়াবী পাড়ার মা আজিরন খাতুন আমার দেশকে বলেন, আমি পেশাদার মা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। কিন্তু কখন যে সত্যিকার মা হয়ে গেছি, তা নিজেও জানি না। এ সন্তানদের বায়না মেটাতে ভুলেই যাই বাড়িতে আমার নিজের একটি ছেলে আছে। এই ছেলেমেয়েরাও আমার দিকে খেয়াল রাখে। মন খারাপ হলে আদর করে।
এমনি এক মা রহিমা বিবি বলেন, আমি ১৯ বছর ধরে এসওএস শিশুপল্লীতে শিশু লালনপালনের কাজ করছি। আমার সন্তান না থাকায় এখন এরাই সন্তান। তিনি বলেন, আমি এ পেশাকে খুবই উপভোগ করছি। বর্তমানে আমার ৯ শিশু রয়েছে। কিছু শিশু চলে যায়, আবার নতুন করে কয়েকজন যুক্ত হয়। আমার লালনপালন করা শিশুরা অনেকে এখন প্রতিষ্ঠিত। তাদের কথা মনে পড়লে গর্বে বুকটা ভরে যায়।
আরেক মা ফাতেমা বেগম বলেন, আমারও ৮ শিশু। আমি তাদের লালনপালন করছি। আমার নিজের দুটি মেয়ে রয়েছে। তারা বড় হয়েছে। তারা আমার আত্মীয়র কাছে থাকে। তিনি বলেন, শিশু লালনপালন আমার কাছে ভালোই লাগে। এসব শিশুর সঙ্গে কীভাবে যে সময় কেটে যায়, তা টেরই পাই না।
এসওএস শিশুপল্লীর সহকারী পরিচালক (প্রোগ্রাম) মোঃ আনিসুর রহমান আমার দেশকে বলেন, আমি এখানে যোগদানের পর কাজটিকে খুব উপভোগ করছি। একজন অনাথ সন্তানকে লালন করতে পারাটা সত্যিই সৌভাগ্যের। তিনি বলেন, এখানকার মায়েরা পরিবার-পরিজন বিসর্জন দিয়ে এখানে সন্তানদের লালনপালন করছেন, যা সত্যিই গর্ব করার মতো একটা ব্যাপার। অসহায় শিশুরাগুলো আমাদের ভাইয়া বলে সম্বোধন করে। ওদের বুকে ভাইয়া ডাকটা শুনতে ভারী মিষ্টি লাগে। এটা চাকুরি মনে করি না, প্রতিনিয়তই কাজটা উপভোগ করি বলে জানালেন আনিসুর রহমান।
বেসরকারি সমাজ উন্নয়নমূলক সংস্থা এসওএস শিশুপল্লী (চিলড্রেনস ভিলেজেস) বাংলাদেশের নতুন কান্ট্রি প্রধান ডা. এনামুল হক জানান, এখানে সাধারণত বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারীরা মা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আসেন। নিয়োগের পর তিন মাস চলে প্রশিক্ষণ। এরপর যত দিন কর্মক্ষম থাকেন, তত দিন মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তিনি বলেন, মায়েরা প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং পেনশন বা অবসরভাতা পান। কোনো মায়ের যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকলে তিনি শিশুপল্লির ভেতরে ‘মাদারস রিটায়ার্ড হোম’-এ বিনামূল্যে থাকতে পারেন। এদের সন্তানদের কেউ অধ্যাপক, কেউ চিকিৎসক, কেউবা বিদেশে পিএইচডি করছেন।
ডা. এনামুল হক জানান, আবার কোনো সন্তানের বয়স হয়তো সাড়ে তিন মাস বা কয়েক বছর। ছয় বছরের কম বয়সি যে বয়সেই আসুক, সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে এবং চাকরি না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ২৬-২৭ বা তারও বেশি বয়স পর্যন্ত তাদের দেখভালের দায়িত্ব এ মায়েদের। এই দীর্ঘ সময়ে মা ও সন্তানের সম্পর্ক এতটাই গাঢ় হয় যে, তারপর আর চেষ্টা করলেও বন্ধন আলগা হয় না।
ঢাকা এসওএস শিশুপল্লীর প্রকল্প পরিচালক মো. ইউসূফ আলী জানান, আমাদের শিশু সদস্যরা বড় হলে মেধা অনুযায়ী যতদূর পড়তে চায়, যেখানে পড়তে চায়, সে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দেশ- বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সহায়তায় চলছে এখানকার কার্যক্রম। ছেলেশিশুরা শিশুপল্লীতে ১৪ বছর পর্যন্ত থাকার সুযোগ পায়। তারপর তাদের স্থান হয় মিরপুরের যুবপল্লীতে। আর মেয়ে শিশুরা ১৮ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। স্বনির্ভর হতে না পারলে অনেক সময় ২৬ বছর বয়স অবধি দেখভাল করে শিশুপল্লী।
তিনি জানান, দুঃসহ পরিবেশ থেকে যন্ত্রণা নিয়ে পল্লিতে শিশুরা আসে। ছয় মাস থেকে এক বছর যাওয়ার পর তাদের মুখে প্রশান্তির যে হাসি দেখতে পাওয়া যায়, সেটাই শিশুপল্লির সার্থকতা। তিনি শুধু প্রকল্প পরিচালকই নন, এখানকার সব অনাথ শিশুর বাবাসুলভ অভিভাবকও বটে। শিশুপল্লির সঙ্গে কাজ করতে পেরে গর্বিত বলেও জানালেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে অনেক শিশু মাতৃ-পিতৃহীন হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন অস্ট্রিয়ার নাগরিক অধ্যাপক হারম্যান মেইনার। সেই থেকেই ১৯৪৯ সালে তিনি অস্ট্রিয়ায় প্রথম এসওএস শিশুপল্লী প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশসহ ১৩৫টি দেশে কাজ করছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাটি। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হয়। শিশু ও যুবপল্লীর ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে ১৯৮৬ সালে মিরপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এসওএস হারম্যান মেইনার কলেজ। ঢাকাসহ বর্তমানে রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও সিলেটে শিশুপল্লির কার্যক্রম চলছে।

দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে টার্গেট করে ম্যাসাকার করার পরিকল্পনা করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। ১৩ নভেম্বর ঢাকায় ঘোষিত তথাকথিত লকডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা ও মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
৪৩ মিনিট আগে
চাকরির জন্য নিজ এলাকার বাইরে থাকা ভোটারদের বড় একটি অংশ আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না। ইসির ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা এ সুযোগ বঞ্চিত হবেন।
৬ ঘণ্টা আগে
পরীক্ষার আগে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করে শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন নিয়ে তাই সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ মুহূর্তে এমন আন্দোলন করে সরকারকে চাপে ফেলে দাবি আদায়ের সুযোগ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
১১ ঘণ্টা আগে
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে মাইলফলক। রোববার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এক ভিডিও বার্তায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
১৩ ঘণ্টা আগে