বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে

আলামত সত্ত্বেও নিম্নচাপ রূপ নেয়নি ঘূর্ণিঝড় শক্তিতে

সরদার আনিছ
প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৫, ০২: ০১

আবহাওয়াবিদদের ভাষায় প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় কয়েকটি ধাপে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে সাধারণত সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। এর পর সুষ্পষ্ট লঘুচাপ, পরে নিম্নচাপ থেকে গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। আরো ঘনীভূত হলে শেষে তা ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আছড়ে পড়ে। এবার সব লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও নিম্নচাপটি আর ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে।

বিশ্ব জলবায়ু মডেলগুলোর তথ্য বলছে, বাংলাদেশের উপকূলে বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক গবেষকরাও তা-ই বলছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) আর্থ, অ্যাটমোসফিয়ারিক এবং প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস বিভাগের গবেষকরাও সম্প্রতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু নিয়ে নতুন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী অতীতের যে ঘূর্ণিঝড়গুলো শত বছরে একবার হতো, এখন তা ১০ বছরেই হতে পারে। অর্থাৎ কম সময়ের ব্যবধানে বড় বিপদের ঝুঁকি বাড়ছে।

বিগত কয়েক যুগের ঘটনা বিশ্লেষণেও দেখা যায়, নিকট অতীতে যে কয়েকটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হয়েছে সেগুলোর সময়ের ব্যবধান কম। এ ছাড়া অতীতে বড় বড় যত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, তার বেশিরভাগ এপ্রিল-মে মাস বা এর কাছাকাছি সময়েই হয়েছে। তাই বছরের মে মাস হলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মাস।

এত ঝুঁকি আর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সিস্টেম লঘুচাপ, সুস্পষ্ট লঘুচাপ পরে নিম্নচাপ এবং শেষপর্যায়ে এবার গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার প্রাথমিক ও মধ্যম পর্যায়ের সব আলামত সত্ত্বেও এবার কেন শ্রীলঙ্কার নাম দেওয়া সম্ভাব্য ‘শক্তি’ ঘূর্ণিঝড়টি তৈরি হওয়ার আগেই দুর্বল ও বিলীন হয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করলÑএ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে।

অবশ্য আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা মে মাসের প্রথম দিকে বঙ্গোপসাগরে একটি সিস্টেম সৃষ্ট হওয়ার কথা বললেও তারা ঘূর্ণিঝড় তৈরির বিষয়টি প্রথম থেকেই নাকচ করে আসছিলেন। অর্থাৎ তারা বলেছিলেন ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অনেক আবহাওয়াবিদ প্রথম থেকেই ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়ে আসছিলেন।

আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন নেসা বলেন, দুটি কারণে সিস্টেমটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারেনি। প্রথমত, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা। মৌসুমি বায়ু এবার সময়ের আগেই দেশে প্রবেশ এবং তা অনেকটাই সক্রিয় থাকায় ঘূর্ণিঝড় তৈরি হতে দেয়নি। এবার ২৪ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা টেকনাফ দিয়ে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে সাধারণত প্রবেশ করে ৩১ মে থেকে ১ জুনের মধ্যে। স্বাভাবিক সময় থেকে গত প্রায় দেড় দশকে মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করত। এবার ১৬ বছর পর এর ব্যতিক্রম হলো। অর্থাৎ এবার সপ্তাহখানেক আগেই মৌসুমি বায়ু দেশে প্রবেশ করে আগে থেকেই সক্রিয় থাকায় সিস্টেমটিকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগই দেয়নি।

দ্বিতীয়ত, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার পাশাপাশি লঘুচাপ তৈরি হওয়ার এলাকাটিও এবার ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। সাগরের যেখানে সিস্টেমটি তৈরি হয়, সেটা উপকূলের একেবারে কাছাকাছি। সেখান থেকে উপকূলমুখী হতে বা ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার জন্য যে সময় দরকার, সে সময়ই পায়নি সিস্টেমটি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত মঙ্গলবার বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ তৈরি হয়। বুধবার তা সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়। বৃহস্পতিবার ভোরে নিম্নচাপে পরিণত হয়। পরে নিম্নচাপটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে উপকূল অতিক্রম করে এটি স্থলভাগের দিকে উঠে আসে। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে টাঙ্গাইল ও এর আশপাশে অবস্থান করছিল। এটি আরো উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে সরে গিয়ে সারা দিন বৃষ্টি ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে সন্ধ্যার দিকে বাংলাদেশের উপরিভাগ থেকে ধীরে ধীরে ভারতের মেঘালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। রাত ৯টা কিংবা আরো কিছু পরে এটি পুরোপুরি বাংলাদেশের উপরিভাগ অতিক্রম করে।

কাজী জেবুন নেসা আরো বলেন, অতীতের ঘূর্ণিঝড়গুলো দেশের উপকূলে আঘাতের ফলে বিপুল প্রাণহানি এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এবার বিভিন্ন কারণেই শক্তি দাপট দেখানো তো দূরের কথা, রূপ নেওয়ার আগেই হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়। এতে সম্ভাব্য প্রাণহানি ও সম্পদের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি থেকেও রক্ষা পেল বাংলাদেশ। অনেক কারণ থাকার পরও বলা যায়, একমাত্র মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় বাংলাদেশ সম্ভাব্য অনেক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেল।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত