জুলাই সনদ : আইনি ভিত্তি প্রশ্নে গড়িমসি কেন?

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ২৩

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গণমানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া-পাওয়ার অভিব্যক্তি রূপে জুলাই সনদ নামের যে দলিলটি প্রণীত হলো, সেটা কি শেষমেষ নিতান্তই একটি কাগুজে দলিল হয়ে থাকবে? এটাকে যদি আইনি ভিত্তিই না দেওয়া যায়, তাহলে তো আখেরে এটার স্ট্যাটাস তা-ই দাঁড়াবে! তাহলে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে এভাবে একটি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজনই বা করার কী প্রয়োজন ছিল? এনসিপি কি তাহলে সেদিন ওই অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক কাজটিই করেছিল? আহত জুলাইযোদ্ধারা সেদিন ওই অনুষ্ঠানে হট্টগোল পাকিয়ে যে আশঙ্কার জানান দিয়েছিল, সেটা কি তাহলে আসলেই অমূলক ছিল না?

বিজ্ঞাপন
এ প্রশ্নগুলো এবং এ রকম আরো অনেক প্রশ্ন আজ জনগণের মুখে মুখে ফিরছে। জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দানে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের প্রশ্নে সবাই একমত হওয়ার পর সেটা নিয়ে টালবাহানার কী অর্থ হতে পারে? কেন এই গণভোট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে অনুষ্ঠানের জন্য এভাবে গোঁ ধরা হচ্ছে? বলা হচ্ছে, অর্থ সাশ্রয় হবে। কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ—অর্থ নাকি এদেশের গণমানুষের রক্তের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত আশা-আকাঙ্ক্ষা? কত টাকা বাঁচবে? এদেশ থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে তার তুলনায় কতটুকু এই অর্থ?

কত রকম যে বাহানা! যদি পতিত রেজিমের সমর্থকরা বিপুল সংখ্যায় ‘না’ ভোট দেয়? যারা এখন গণভোট প্রশ্নে অসন্তুষ্ট তারাও যদি তাদের সঙ্গে হাত মেলায়? ‘না’ জয়যুক্ত হয়ে যাবে না তো? তাহলে সংস্কারের কী হবে? আহারে, সংস্কারের জন্য কত দুশ্চিন্তা! শুধু কি তাই? আরো কত কী প্রশ্ন! লোকজন এসব সংস্কারের কী এমন বোঝে? জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে হলে না হয় প্রার্থীদের ভোট দিতে এসে খেয়ালের বশে এখানেও একটা হ্যাঁ/না মেরে দিয়ে গেল! কিন্তু আলাদা দিনে হলে কে এমন ভোট দিতে আসবে? তখন যদি টার্ন-আউট কম হয়, তাহলে ফলাফল প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়াবে না ত? আরে ভাই! সোজাসাপ্টা বলেন না কেন, ‘আমরা আর এসবে নেই, গণভোট বাদ দিয়ে দেন।’ আপনার দলের প্রার্থীদের সংসদে পাঠানোর জন্য যদি লোকজনকে ভোটকেন্দ্রে আনতে জান দিয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন জুলাই সনদ পাসের জন্য অনুষ্ঠেয় গণভোটে লোকজনকে মোটিভেট করতে মাঠে থাকবেন না কেন?

একবার ভাবুন তো! যে পরিবর্তনগুলো এভাবে ঠেকানোর চেষ্টা হচ্ছে, সেগুলোর পক্ষে গণরায় আসার সম্ভাবনা কেমন? এগুলো যদি জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতই হবে, তাহলে এগুলো গণভোটে দিতে আপনাদের এত ভয় কেন? আপনারা সেই কবে থেকে জনগণের ম্যানডেটের জন্য তারস্বরে চিৎকার করছেন! আপনারা যখন এতই পপুলার, তখন জনতার প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না কেন? প্রফেসর ইউনূস যদি ক্ষমতা গ্রহণের পর এত লম্বা পথে না হেঁটে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হিসেবে এই প্রস্তাবগুলো সরাসরি গণভোটে দিয়ে দিতেন, তাহলে আপনারা কীভাবে ঠেকাতেন? তাহলে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপনাদের পার্টিসিপেশনের সুযোগ দেওয়াটাই তার দিক থেকে একটা বড় ভুল হয়ে গেছে?

বলুন তো! আসলে আপনাদের মতলবটা কী? আপনারা কি আইনি ভিত্তি দানের বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে আগামী নির্বাচনে তাকে আপনাদের পক্ষে ভূমিকা রাখতে বাধ্য করতে চান? আম্লিগ যে কায়দায় মইন ইউ আহমেদকে তাদের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করেছিল, সেরকম কিছু? প্রফেসর ইউনূস বা গণঅভ্যুত্থানের নেতারা কি বোঝেন, এই আইনি ভিত্তির ব্যাপারটা নাঙ্গা তলোয়ারের মতো সদা তাদের উপর ঝুলছে? কাল বা পরশু কেউ আপনাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনার সুযোগ পাবে না তো—‘লোক জড়ো করে একটি গদিনশিন সরকারকে হটিয়ে আপনারা বড় রকমের একটা বেআইনি কাজ করেছেন।’ গণভোট কি সেক্ষেত্রে আপনাদের আইনি সুরক্ষা দেবে না? কিন্তু গণভোট যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে হয়, তাহলে সে উদ্দেশ্য কতটা সাধিত হবে? জুলাই সনদকে যদি আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া না হয়, তাহলে কীসের ভিত্তিতে হবে জাতীয় নির্বাচন? বিদ্যমান সংবিধান কি যে সময়ে যেভাবে জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা হচ্ছে, সেটাকে অনুমোদন দেয়? পরবর্তী সময়ে তাহলে এই নির্বাচনের আয়োজক/পার্টিসিপেন্ট সবাই আইনি প্যাঁচে পড়বেন না?

ইন্টারিম এখন তাহলে কী করবে? রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে একমত হওয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে—ভালো কথা! কিন্তু ওরা কি ঐকমত্যে আসতে পারবে? একটি দল যখন প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়, তখন ওই দল কি এগুলোকে খুব সহজে গণভোটের ওপর ছেড়ে দিতে চাইবে? যদি না চায়, সরকার আর কতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর মুখপানে চেয়ে থাকবে? জনগণ যা চায়, প্রফেসর ইউনূস মেরুদণ্ড সোজা করে সেটার পক্ষে দাঁড়াতে পারবেন না কেন? এটাই কি হতে চলেছে তার গ্লোরিয়াস ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা?

সবাই ভালো থাকুন।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর পুলিশি হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গভীর উদ্বেগ

শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মানার আহ্বান গোলাম পরওয়ারের

মালয়েশিয়ায় পাচারকালে নৌকাডুবি, বাংলাদেশিসহ ৬ জন উদ্ধার

ইকবাল ও নজরুল ইসলামের ভূমিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সম্পাদক মাহমুদুর রহমান

পদ্মার বিস্তীর্ণ চরজুড়ে চলছে ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত