গুম-খুনের বিচার : অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ

মোদাসসের হোসেন খান, বীরপ্রতীক
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ৪২

মেঘে ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যেমনি তার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিয়ে ধরণিকে দীপ্তিময় করে তোলে, তেমনি সব অজুহাত ও বাধা অতিক্রম করে অবশেষে গুম-খুনের মতো অপরাধে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে এক বলিষ্ঠ ও আশাপ্রদ পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সৌভাগ্যবান ও গর্বিত সদস্য হিসেবে এমন দৃশ্য দেখা বেদনার ও লজ্জার। ১৫ বছর ধরে শাসকদের হাতে স্বজাতীয় গণমানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত ইতিহাসের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ জাতির বুকে যে কলঙ্ক লেপন করে রেখেছে, এই প্রশংসনীয় আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে তা মুছে ফেলার এক অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ভাবতে কষ্ট হয়, যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে জাতি এক নজিরবিহীন ও সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনে স্বর্ণমুকুটের শিরস্ত্রাণ অর্জন করেছিল, সেই গৌরবোজ্জ্বল বাহিনীর গুটিকয়েক পথভ্রষ্ট সদস্যের অপকীর্তির কারণে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরীদের গৌরব ও সুখ্যাতি আজ ঈষৎ পরিমাণ হলেও খর্বিত। প্রাক্তন ও বর্তমান সদস্য হিসেবে এই বাহিনীর প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের কারণে আমরা ব্যথিত হতে পারি, হতে পারি বিচলিত ও সংক্ষুব্ধ। কিন্তু সভ্য, শিক্ষিত মানুষের মুখোশে দেশরক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ সেই মহৎ প্রতিষ্ঠানের কিছু মানুষ যখন প্রত‍্যাশিত মানবিক ও ন‍্যায়নিষ্ঠ হওয়ার পরিবর্তে দানবরূপে আবির্ভাব হয়ে রক্তপিপাসু বন‍্যপশুর চেয়ে অধিকতর হিংস্র এবং নৃশংসতার রূপ ধারণ করে, তখন তাদের প্রতি সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শন হয়ে পড়ে মানবধর্ম এবং মানবিক মূল্যবোধবিরোধী।

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা নিষ্ঠুরতম ও ঘৃণিত গুম এবং হত্যাযজ্ঞ ওপরের নির্দেশে বা শত্রুভাবাপন্ন ভিনদেশি রাষ্ট্রের প্ররোচনায় সম্পাদন করতে বাধ্য হয়েছে, এই যুক্তি শুধুই পাগলের প্রলাপ, ভিন্ন অর্থে মূর্খতার শামিল অথবা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা। তারা শপথ নিয়েছে দেশের সংবিধান সমুন্নত রেখে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মাধ্যমে জনমানুষের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য, কোনো ব্যক্তি এবং দলের ক্রীড়নক হয়ে, বিদেশি মদতে তাদের ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করে গুম, হত্যা চালিয়ে লুণ্ঠনের পথ প্রশস্ত করার জন্য নয়। দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার সর্বনাশা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো অবৈধ নির্দেশ পালনে তারা বাধ্য নয়।

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে গিয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে অনেককে যখন বলতে শুনি, চাকরি হারানো ও শাস্তি এড়ানোর উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আদেশ পালন করতেও তারা বাধ্য হন, তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য, শুধু মানবতার মাপকাঠিতে নয়, আইনের দৃষ্টিতেও এই খোঁড়া যুক্তি ও মিথ্যা অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা সেনা কর্মকর্তারা মূর্খ বা অশিক্ষিত নন। আমাদের স্মরণে রাখা উচিত, প্রতিটি সেনাসদস্য, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অসংখ্য কষ্টসাধ্য ও দুরূহ প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা কোর্সে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েই পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন স্তরে ভূরাজনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত বিষয় ছাড়াও দেশের সংবিধান, জনগণের মৌলিক অধিকার এবং সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। তাই এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বৈধ ও অবৈধ আদেশের মধ্যে পার্থক্য বিষয়ে তারা অনবহিত নন।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতের ইচ্ছায় ও আদেশক্রমে এবং কুখ্যাত হাসিনার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতিতে সব হত্যাযজ্ঞ এবং দেশকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে, কিন্তু তাই বলে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে স্বজাতির ওপর গুম ও খুনের মতো নিষ্ঠুরতম এবং পৈশাচিক কর্মটি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই ভাষ্য কোনো সমাজ ও দেশের বিদ্যমান আইনেই গ্রহণযোগ্য নয়। একই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা সেনাবাহিনী পরিচালনায় নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সরাসরি অধীন না হয়ে থাকলেও, বর্ণিত অপরাধ সংঘটন হতে তারা সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত হতে পারে না। এই অভিমতের পক্ষে নিম্নে বর্ণিত প্রশ্নগুলো সব কর্মরত ও প্রাক্তন সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সব সচেতন নাগরিকের সম্মুখে তুলে ধরা যায়Ñ

১. নিয়মিত সেনাবাহিনীর বাইরে, ডিজিএফআই, এনএসআই, র‍্যাবসহ প্রেষণে কর্মরত সেনা কর্মকর্তারা যখন হাসিনা ও তারেক সিদ্দিক দ্বারা আদেশকৃত হয়ে আয়নাঘরের গোপন কুঠরিতে আটক করা অবস্থায় মানব ইতিহাসের নৃশংসতম নির্যাতন চালিয়ে এদেশেরই নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষের প্রাণসংহারের কাজে লিপ্ত ছিল, তখন কি সেনা কর্তৃপক্ষ এই নারকীয় কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে তাদের সহকর্মীদের মূল বাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?

২. বিডিআরের বিভিন্ন পদের ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাদের ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং তাদের প্রাণরক্ষার্থে সেনাবাহিনীর অভিযান খুনি হাসিনা নাকচ করে দেওয়ায় সে সময়ের সেনাপ্রধান কি প্রতিবাদী কণ্ঠ তুলে ধরেছিলেন।

৩. স্বৈরাচারের গত ১৫ বছরের বর্বরোচিত শাসনকালে অনুষ্ঠিত সব প্রহসনমূলক নির্বাচনের ফল শাসক দলের পক্ষে রাখার উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীকে শাসক দলের পক্ষে ব্যবহার করার বিষয়ে কখনো কোনো সেনা কর্তৃপক্ষ কি আপত্তি করেছিল?

৪. স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোয় যখন তার নিজ দেশের সরকারের সহায়তায় নিজস্ব কর্মস্থলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, তখন কি সশস্ত্র বাহিনীর তরফ থেকে কোনো প্রতিবাদ উত্থাপন করা হয়েছিল?

আমি নিশ্চিত, এ প্রশ্নগুলোর কেনোটিরই হ্যাঁ-সূচক উত্তর পাওয়া অসম্ভাবনীয়। আর তাই সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনীর সব শাখাকে সংবিধান-নির্দেশিত দায়িত্ব সুনিপুণভাবে পালন ও বহিঃশত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ‍্যে জরুরি ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো অত‍্যাবশ‍্যক। এসব বাহিনীর সব সদস্যের প্রতিমুহূর্তে স্মরণে রাখতে হবে, তারা সব পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কোনো ব‍্যক্তি বা দলের প্রতি নয়। এই মহান দায়িত্ব পালনে তাদের প্রতিজ্ঞা অবিচল রাখা ও দেশরক্ষার কাজে সর্বোচ্চ সক্ষমতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ‍্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য সুপারিশ উল্লেখ করছি-

১. সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় এখনো বৈধ-অবৈধভাবে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিকদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা।

২. ডিজিএফআইয়ের সব কার্যক্রম একমাত্র সশস্ত্র বাহিনী ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ রেখে বেসামরিক প্রশাসন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে এবং করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় উল্লেখ করে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা।

৩. দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম নিয়মিতভাবে সমন্বয় করে দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতিমালা প্রণয়নে সরকারপ্রধান, তথা সরকারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশ‍্য সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের অন্তর্ভুক্ত করে একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও স্বনামধন্য ব্যক্তির নেতৃত্বে জাতীয় গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা।

৪. সশস্ত্র বাহিনীর সব পর্যায়ে পদোন্নতি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করে শুধু পেশাগত যোগ‍্যতা, চারিত্রিক গুণাবলি ও বয়োজ্যেষ্ঠতা মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া।

৫. সেনাবাহিনীর হৃতগৌরব ও মনোবল পুনঃস্থাপনের লক্ষ‍্যে বিডিআর হত‍্যাকাণ্ডে জড়িত সব সামরিক এবং বেসামরিক অপরাধীদের কালবিলম্ব না করে বিচারের সম্মুখীন করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করা।

৬. ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সব সামরিক ও বেসামরিক অসম চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করে তা অবিলম্বে হয় সংশোধন অথবা বাতিল করা।

৭. অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহার করে এবং প্রয়োজনবোধে বন্ধুত্বপূর্ণ বিদেশি রাষ্ট্রের সহযোগিতায় উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে আধুনিক সমরাস্ত্র কারখানা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গড়ে তোলা।

৮. দেশের সীমিত সম্পদের কারণে এবং দেশ শত্রুভাবাপন্ন বহির্দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ায়, কালবিলম্ব না করে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে দেশ রক্ষাকল্পে সদা প্রস্তুত রাখার কর্মসূচি হাতে নেওয়া।

সশস্ত্র বাহিনী দেশ ও দেশের মানুষের আস্থা এবং নির্ভরতার সর্বোত্তম ও সর্বশেষ আশ্রয়স্থল এবং দুর্গ। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট স্বৈরাচার উৎখাতের প্রাক্কালে নিষ্ঠুর ও রক্তপিপাসু হাসিনার জনতার ওপর গুলি চালানোর অবৈধ আদেশ অমান্য করে জনগণের পক্ষে সেনাবাহিনী অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

যে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী তাদের প্রাণের বিনিময়ে এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল, সেই বাহিনী দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে কখনো দাঁড়াতে পারে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমাদের ধারণা, সেনাবাহিনী এই বিশ্বাসভঙ্গের কখনো কারণ হবে না।

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত