
ব্রি. জে. (অব.) রোকন উদ্দিন

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি আজ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। আফগানিস্তান, দীর্ঘ যুদ্ধ ও বিদেশি হস্তক্ষেপের পর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক সংবেদনশীল পর্যায়ে রয়েছে। এই অবস্থায় ভারত তার কূটনৈতিক ও উন্নয়ন-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে যেন এক উদার বন্ধুর মতো। কিন্তু ইতিহাস, ভূগোল ও ভারতের কৌশলগত আচরণ বলছে, এই বন্ধুত্ব নিছক মানবিক নয়—এটি এক গভীর পরিকল্পনার অংশ, যার মূল লক্ষ্য পাকিস্তানকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য
২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের পর ভারত দ্রুত আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। তারা অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে প্রভাব বাড়ায়। আফগান সংসদ ভবন, সালমা বাঁধ (যা ‘আফগান-ভারত বন্ধুত্ব বাঁধ’ নামে পরিচিত) এবং জারাঞ্জ-দেলারাম মহাসড়ক ভারতের এই ‘সফট পাওয়ার’ কৌশলের স্পষ্ট নিদর্শন। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর অন্তরালে ছিল অন্য উদ্দেশ্য, যা কেবল উন্নয়ন বা সহযোগিতার ভাষায় বোঝা যায় না। ভারতের আসল লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানকে এমন এক কৌশলগত ঘাঁটিতে পরিণত করা, যেখান থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সামরিক তৎপরতা ও সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই উপস্থিতি ভারতের কাছে শুধু কূটনৈতিক সাফল্য নয়, বরং একপ্রকার গোয়েন্দা সুবিধা। আফগানিস্তানের পাহাড়ি সীমান্ত অঞ্চল এবং এর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো ভারতের জন্য এমন এক ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যেখানে তারা নানাভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক খেলা চালাতে পারে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে সক্রিয়। তারা কাবুল, কান্দাহার, জালালাবাদ ও মাজার শরিফে তথাকথিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, এনজিও এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ের আড়ালে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বলে বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেছেন। র’-এর কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা দেওয়া এবং সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের
এছাড়া আফগানিস্তান ভারতের জন্য একটি ভূ-অর্থনৈতিক সুযোগও এনে দিয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে মধ্য এশিয়ার গ্যাস, তেল ও খনিজ সম্পদে প্রবেশের পথ খুঁজছে। কিন্তু পাকিস্তান-অবরুদ্ধ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সে পথ সবসময় বন্ধ ছিল। আফগানিস্তানের মাধ্যমে এই রুট খুলে দেওয়ার প্রয়াস ভারতকে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদে সরাসরি পৌঁছানোর সুযোগ দিতে পারে, যা তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সহায়ক। তাই আফগানিস্তানে ভারতের আগ্রহ কেবল বন্ধুত্বের মুখোশে লুকানো মানবিক সহযোগিতা নয়—এটি মূলত একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিনিয়োগ, যার লক্ষ্য পাকিস্তানকে চাপে রাখা, মধ্য এশিয়ার দিকে প্রভাব বিস্তার করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
ইসরাইল-ভারত আঁতাত এবং মুসলিম বিশ্বের প্রশ্ন
ভারতের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সবসময় দ্বিচারিতার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। একদিকে তারা ইসলামি ঐক্যের কথা বলে, অন্যদিকে ইসরাইলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা গড়ে তুলেছে। আজ ইসরাইল ভারতের অন্যতম প্রতিরক্ষা অংশীদার। নজরদারি প্রযুক্তি, ড্রোন, মিসাইল প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান—সবখানেই ইসরাইলের প্রভাব প্রবল। এই বাস্তবতা আফগানিস্তানের মতো মুসলিম দেশের জন্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ভারত মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্ব বজায় রাখতে পারে না। তাই আফগানিস্তানের জন্য জরুরি হলো এই সম্পর্কের ভেতরের কৌশলগত উদ্দেশ্য বুঝে নেওয়া। ভারতের বন্ধুত্বের আড়ালে আছে আঞ্চলিক আধিপত্য ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির নীতি।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তান : বিভাজনের ইতিহাস, ঐক্যের প্রয়োজন
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ইতিহাসে বহুবার টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে—বিশেষ করে দুরান্ড রেখা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে। কিন্তু এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও দুই দেশের জনগণ একই সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা ও গোত্রীয় ঐতিহ্যে আবদ্ধ। ধর্মীয়ভাবে তারা ভাই, ইতিহাসে তারা সহযোগী এবং বাস্তবে তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভারত এই বন্ধনটিকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে বহুবার। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে ভারত উপকৃত হয়, কারণ এতে পাকিস্তান দুই ফ্রন্টে চাপের মুখে পড়ে—একদিকে কাশ্মীর, অন্যদিকে আফগান সীমান্ত। তাই ভারতের ‘আফগান বন্ধুত্ব’ আসলে পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে ব্যস্ত রাখার একটি উপায়। অন্যদিকে পাকিস্তান বারবার আফগান জনগণকে আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছে। সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সংকট পর্যন্ত পাকিস্তান প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের খাদ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়েছে। এই মানবিক সহায়তা ভারতের কোনো প্রকল্পের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
আফগানিস্তানের জন্য সঠিক পথ
তালেবান সরকারের উত্থানের পর আফগানিস্তান এমন এক যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কৌশলগত সতর্কতা অপরিহার্য। ভারতের সঙ্গে সীমিত বাণিজ্য বা অবকাঠামোগত সহযোগিতা আফগানিস্তানের অর্থনীতির জন্য উপকারী হতে পারে, তবে সামরিক সহযোগিতা বা গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে অংশ নেওয়া দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ভারত কখনো কোনো মুসলিম দেশের প্রকৃত বন্ধু ছিল না, বরং তার নীতি সবসময় স্বার্থনির্ভর এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। আফগানিস্তানের উচিত এমন একটি বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা, যা একদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখবে, অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে। পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আফগানিস্তানের জন্য শুধু ধর্মীয় ঐক্যের প্রতীক নয়, বরং বাস্তব নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা। এসব দেশের অভিজ্ঞতা, বাজার ও রাজনৈতিক সমর্থন আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান নিতে সহায়তা করবে। ভারতের মতো অমুসলিম শক্তির সঙ্গে অতিরিক্ত নির্ভরতা আফগানিস্তানকে একদিকে মুসলিম বিশ্বের আস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ ও সন্দেহ সৃষ্টি করবে। তাই কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও আত্মসম্মান বজায় রেখে আফগানিস্তানের উচিত এমন এক পথ বেছে নেওয়া, যা তাদের স্বাধীনতা, ইসলামি মূল্যবোধ ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।
পাকিস্তানের দায়িত্ব ও কূটনৈতিক পরিণতিবোধ
পাকিস্তানেরও উচিত আফগানিস্তানের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল ও সংযমী আচরণ করা। আফগান সরকারে অনেকেই নতুন, রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ নয়—তাদের প্রতি ধৈর্য ও দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পাকিস্তান যদি নেতৃত্বদানের ভূমিকা নেয়, তবে তা শুধু কৌশলগত লাভ নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দায়িত্বও পালন হবে। দুই দেশের মধ্যে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও সংস্কৃতি বিনিময়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অপরের জন্য প্রতিপক্ষ নয়, বরং একে অপরের শক্তি হতে পারে।
উপসংহার
মুসলিম ঐক্যই প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের বন্ধুত্বের আড়ালে যে রাজনৈতিক হিসাব লুকিয়ে আছে, তা বুঝে ওঠা সময়ের দাবি। আফগানিস্তানকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা কি ভারতের কৌশলগত খেলায় পুতুল হতে চায়, নাকি মুসলিম বিশ্বের অংশ হয়ে সম্মানজনক স্বাধীনতা বজায় রাখতে চায়। একইসঙ্গে পাকিস্তানেরও উপলব্ধি করতে হবে—একটি দুর্বল আফগানিস্তান তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি; কিন্তু একটি শক্তিশালী ও বন্ধুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান তার সুরক্ষার প্রথম স্তম্ভ। দীর্ঘ মেয়াদে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য, পারস্পরিক আস্থা ও কৌশলগত সহযোগিতাই হবে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার একমাত্র ভিত্তি। ভারতের প্ররোচনা ও প্রভাবের রাজনীতি কখনোই স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়তে পারে না, বরং বিভাজন ও অবিশ্বাসের আগুন জ্বালায়। আজ সময় এসেছে—আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিজেদের অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকাক, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আবার জোরদার করুক এবং মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের নতুন উদাহরণ স্থাপন করুক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি আজ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। আফগানিস্তান, দীর্ঘ যুদ্ধ ও বিদেশি হস্তক্ষেপের পর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক সংবেদনশীল পর্যায়ে রয়েছে। এই অবস্থায় ভারত তার কূটনৈতিক ও উন্নয়ন-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে যেন এক উদার বন্ধুর মতো। কিন্তু ইতিহাস, ভূগোল ও ভারতের কৌশলগত আচরণ বলছে, এই বন্ধুত্ব নিছক মানবিক নয়—এটি এক গভীর পরিকল্পনার অংশ, যার মূল লক্ষ্য পাকিস্তানকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য
২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের পর ভারত দ্রুত আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। তারা অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে প্রভাব বাড়ায়। আফগান সংসদ ভবন, সালমা বাঁধ (যা ‘আফগান-ভারত বন্ধুত্ব বাঁধ’ নামে পরিচিত) এবং জারাঞ্জ-দেলারাম মহাসড়ক ভারতের এই ‘সফট পাওয়ার’ কৌশলের স্পষ্ট নিদর্শন। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর অন্তরালে ছিল অন্য উদ্দেশ্য, যা কেবল উন্নয়ন বা সহযোগিতার ভাষায় বোঝা যায় না। ভারতের আসল লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানকে এমন এক কৌশলগত ঘাঁটিতে পরিণত করা, যেখান থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সামরিক তৎপরতা ও সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই উপস্থিতি ভারতের কাছে শুধু কূটনৈতিক সাফল্য নয়, বরং একপ্রকার গোয়েন্দা সুবিধা। আফগানিস্তানের পাহাড়ি সীমান্ত অঞ্চল এবং এর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো ভারতের জন্য এমন এক ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যেখানে তারা নানাভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক খেলা চালাতে পারে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে সক্রিয়। তারা কাবুল, কান্দাহার, জালালাবাদ ও মাজার শরিফে তথাকথিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, এনজিও এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ের আড়ালে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বলে বহু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেছেন। র’-এর কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা দেওয়া এবং সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের
এছাড়া আফগানিস্তান ভারতের জন্য একটি ভূ-অর্থনৈতিক সুযোগও এনে দিয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে মধ্য এশিয়ার গ্যাস, তেল ও খনিজ সম্পদে প্রবেশের পথ খুঁজছে। কিন্তু পাকিস্তান-অবরুদ্ধ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সে পথ সবসময় বন্ধ ছিল। আফগানিস্তানের মাধ্যমে এই রুট খুলে দেওয়ার প্রয়াস ভারতকে মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদে সরাসরি পৌঁছানোর সুযোগ দিতে পারে, যা তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সহায়ক। তাই আফগানিস্তানে ভারতের আগ্রহ কেবল বন্ধুত্বের মুখোশে লুকানো মানবিক সহযোগিতা নয়—এটি মূলত একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিনিয়োগ, যার লক্ষ্য পাকিস্তানকে চাপে রাখা, মধ্য এশিয়ার দিকে প্রভাব বিস্তার করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
ইসরাইল-ভারত আঁতাত এবং মুসলিম বিশ্বের প্রশ্ন
ভারতের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সবসময় দ্বিচারিতার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। একদিকে তারা ইসলামি ঐক্যের কথা বলে, অন্যদিকে ইসরাইলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা গড়ে তুলেছে। আজ ইসরাইল ভারতের অন্যতম প্রতিরক্ষা অংশীদার। নজরদারি প্রযুক্তি, ড্রোন, মিসাইল প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান—সবখানেই ইসরাইলের প্রভাব প্রবল। এই বাস্তবতা আফগানিস্তানের মতো মুসলিম দেশের জন্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ভারত মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্ব বজায় রাখতে পারে না। তাই আফগানিস্তানের জন্য জরুরি হলো এই সম্পর্কের ভেতরের কৌশলগত উদ্দেশ্য বুঝে নেওয়া। ভারতের বন্ধুত্বের আড়ালে আছে আঞ্চলিক আধিপত্য ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির নীতি।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তান : বিভাজনের ইতিহাস, ঐক্যের প্রয়োজন
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ইতিহাসে বহুবার টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে—বিশেষ করে দুরান্ড রেখা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে। কিন্তু এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও দুই দেশের জনগণ একই সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা ও গোত্রীয় ঐতিহ্যে আবদ্ধ। ধর্মীয়ভাবে তারা ভাই, ইতিহাসে তারা সহযোগী এবং বাস্তবে তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভারত এই বন্ধনটিকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে বহুবার। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে ভারত উপকৃত হয়, কারণ এতে পাকিস্তান দুই ফ্রন্টে চাপের মুখে পড়ে—একদিকে কাশ্মীর, অন্যদিকে আফগান সীমান্ত। তাই ভারতের ‘আফগান বন্ধুত্ব’ আসলে পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে ব্যস্ত রাখার একটি উপায়। অন্যদিকে পাকিস্তান বারবার আফগান জনগণকে আশ্রয় ও সহায়তা দিয়েছে। সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সংকট পর্যন্ত পাকিস্তান প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের খাদ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়েছে। এই মানবিক সহায়তা ভারতের কোনো প্রকল্পের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
আফগানিস্তানের জন্য সঠিক পথ
তালেবান সরকারের উত্থানের পর আফগানিস্তান এমন এক যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কৌশলগত সতর্কতা অপরিহার্য। ভারতের সঙ্গে সীমিত বাণিজ্য বা অবকাঠামোগত সহযোগিতা আফগানিস্তানের অর্থনীতির জন্য উপকারী হতে পারে, তবে সামরিক সহযোগিতা বা গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে অংশ নেওয়া দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ভারত কখনো কোনো মুসলিম দেশের প্রকৃত বন্ধু ছিল না, বরং তার নীতি সবসময় স্বার্থনির্ভর এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। আফগানিস্তানের উচিত এমন একটি বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা, যা একদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখবে, অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে। পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আফগানিস্তানের জন্য শুধু ধর্মীয় ঐক্যের প্রতীক নয়, বরং বাস্তব নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা। এসব দেশের অভিজ্ঞতা, বাজার ও রাজনৈতিক সমর্থন আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান নিতে সহায়তা করবে। ভারতের মতো অমুসলিম শক্তির সঙ্গে অতিরিক্ত নির্ভরতা আফগানিস্তানকে একদিকে মুসলিম বিশ্বের আস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ ও সন্দেহ সৃষ্টি করবে। তাই কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও আত্মসম্মান বজায় রেখে আফগানিস্তানের উচিত এমন এক পথ বেছে নেওয়া, যা তাদের স্বাধীনতা, ইসলামি মূল্যবোধ ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।
পাকিস্তানের দায়িত্ব ও কূটনৈতিক পরিণতিবোধ
পাকিস্তানেরও উচিত আফগানিস্তানের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল ও সংযমী আচরণ করা। আফগান সরকারে অনেকেই নতুন, রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ নয়—তাদের প্রতি ধৈর্য ও দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পাকিস্তান যদি নেতৃত্বদানের ভূমিকা নেয়, তবে তা শুধু কৌশলগত লাভ নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দায়িত্বও পালন হবে। দুই দেশের মধ্যে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও সংস্কৃতি বিনিময়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অপরের জন্য প্রতিপক্ষ নয়, বরং একে অপরের শক্তি হতে পারে।
উপসংহার
মুসলিম ঐক্যই প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের বন্ধুত্বের আড়ালে যে রাজনৈতিক হিসাব লুকিয়ে আছে, তা বুঝে ওঠা সময়ের দাবি। আফগানিস্তানকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা কি ভারতের কৌশলগত খেলায় পুতুল হতে চায়, নাকি মুসলিম বিশ্বের অংশ হয়ে সম্মানজনক স্বাধীনতা বজায় রাখতে চায়। একইসঙ্গে পাকিস্তানেরও উপলব্ধি করতে হবে—একটি দুর্বল আফগানিস্তান তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি; কিন্তু একটি শক্তিশালী ও বন্ধুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান তার সুরক্ষার প্রথম স্তম্ভ। দীর্ঘ মেয়াদে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য, পারস্পরিক আস্থা ও কৌশলগত সহযোগিতাই হবে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার একমাত্র ভিত্তি। ভারতের প্ররোচনা ও প্রভাবের রাজনীতি কখনোই স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়তে পারে না, বরং বিভাজন ও অবিশ্বাসের আগুন জ্বালায়। আজ সময় এসেছে—আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিজেদের অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকাক, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আবার জোরদার করুক এবং মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের নতুন উদাহরণ স্থাপন করুক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

মেঘে ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিয়ে যেমনি তার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিয়ে ধরণিকে দীপ্তিময় করে তোলে, তেমনি সব অজুহাত ও বাধা অতিক্রম করে অবশেষে গুম-খুনের মতো অপরাধে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে এক বলিষ্ঠ ও আশাপ্রদ পদক্ষেপ।
৫ ঘণ্টা আগে
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৬ বছরের মাফিয়াতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বর্ষাবিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সমগ্র দেশবাসী আশা করেছিল নতুন বন্দোবস্তের ভিত্তিতে নতুন এক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মিত হবে। নতুন ধারার সরকারব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হবে। সংগঠন ও কাঠামোয় গুণগত পরিবর্তন আসবে। রাষ্ট্রসংস্কারের মৌলিক ভাবনা বাস্তবায়িত
৫ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস নামে পরিচিত এই দিনটি আমাদের স্বাধীনতার পরবর্তী রাজনৈতিক বিবর্তনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনাকে কেউ বিপ্লব বলেন, কেউ বিদ্রোহ, কেউ আবার ক্ষমতার পালাবদল বলে থাকেন।
৬ ঘণ্টা আগে
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন পে স্কেল গঠনের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেয় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর সেই কমিটি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পে স্কেলে মনোনিবেশ না করে প্রস্তাবনা দিয়ে বসেছে, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আলাদা ব্যাংক গঠন করা হোক।’
৬ ঘণ্টা আগে