সাক্ষাৎকার /বাসযোগ্য নির্মল পরিবেশ পাবে দেশের মানুষ: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

স্পোর্টস রিপোর্টার
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ৫৭
আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ১৪

দেশের মানুষের জন্য একটি বাসযোগ্য নির্মল পরিবেশ উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পরিবেশ, মরে যাওয়া বন, জলবায়ু ও পানিসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি দেশের আটটি বিভাগে আটটি নদী ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করেছেন। ঢাকার নদীগুলো দূষণমুক্ত করার জন্য চলছে নিরলস কাজ। বায়ুদূষণ, ইটভাটার দূষণ, জলাশয় ভরাট, যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে মোবাইল কোর্ট অভিযান চালাবে বলে জানান।

উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দৈনিক আমার দেশকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পরিবেশ, বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, শব্দদূষণ ও জলবায়ু পরির্বতনে বাংলাদেশের প্রভাব-বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি কবিতা

বিজ্ঞাপন

২০২৫ বছরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সবার জন্য কী খুশির খবর দেবেন?

উত্তর: দেশের মানুষের জন্য একটি বাসযোগ্য নির্মল পরিবেশ উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের মন্ত্রণালয় একাধিক নতুন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এগুলো দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।

বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, জলাশয় রক্ষা, পাহাড় কাটা রোধ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। ঢাকা শহরের ২১টি খাল পুনরুদ্ধারে আমরা ব্লু নেটওয়ার্ক স্থাপনে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছি। দেশের ৬৪ জন জেলা প্রশাসক নিজ নিজ জেলার একটি করে নদীদূষণ ও দখলমুক্ত করতে কর্মপরিকল্পনা দিয়েছেন। আমরা যাচাই-বাছাই করে তা চূড়ান্ত করছি। হয়তো আট বিভাগে আটটি নদী ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে দিয়ে যেতে পারব। তাছাড়া ঢাকার নদীগুলো দূষণমুক্ত করতে চলছে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন।

শিল্পদূষণ নিয়ন্ত্রণে অধিকতর যাচাই-বাছাই করে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বায়ুদূষণ, ইটভাটার দূষণ, জলাশয় ভরাট, যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে মোবাইল কোর্টের অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আপনারা কী উদ্যোগ নিয়েছেন?

উত্তর: জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন শপিং ব্যাগের বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপ ২০২৫ সালে দৃশ্যমান হবে এবং জনগণ উপকৃত হবে বলে আমি আশা করছি। আমরা দেশের উপকূলীয় ও পর্যটন এলাকায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিরুৎসাহিত করতে চাই। এরই মধ্যে সরকারি দপ্তরে এটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রম সফল হলে দেশের জলপথ ও মাটির দূষণ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা যাবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কী কাজ করছেন?

উত্তর: আমরা এরই মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া প্রায় ১০০ একর বনভূমি ফিরিয়ে এনেছি, যা বন রক্ষায় একটি মাইলফলক। বিপন্ন হাতি রক্ষায় আমরা বিস্তারিত কাজ হাতে নিয়েছি। মধুপুর শালবন ফেরাতে করা হচ্ছে বিস্তারিত পরিকল্পনা। এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত আছে বননির্ভর গারো সম্প্রদায়। গাজীপুরে বন উদ্ধারের জন্য কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করছি, ৫ আগস্টের পরে দখলকৃত বনভূমি আমরা উদ্ধার করতে পারব। আমরা সোনাদিয়াদ্বীপের ধ্বংসপ্রাপ্ত উপকূলীয় বনে অর্থনৈতিক জোন স্থাপনে আপত্তি দিয়েছি এবং বনভূমি ফেরত চেয়েছি। সুন্দরবনসহ অন্যান্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০২৫ সালে বিশেষ কর্মসূচি চালু করা হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন ড্রোন মনিটরিং ও স্মার্ট প্যাট্রোলিংয়ের মাধ্যমে বনভূমির অবৈধ দখল ও বৃক্ষনিধন প্রতিরোধ জোরদার করা হবে। অবৈধ বনভূমি উদ্ধারে কাঙ্ক্ষিত সফলতা লাভ করা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আমরা বন ও বৃক্ষ সংরক্ষণ আইন চূড়ান্ত করেছি। বছরের শেষ দিনে আমরা গাছ থেকে পেরেক সরানোর কার্যক্রম শুরু করেছি, যা অব্যাহত থাকবে। নতুন আইনের অধীনে প্রাকৃতিক বন রক্ষায় বন বিভাগের দায়িত্ব নির্ধারণ করেছি, গাছে পেরেক ঠোকার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাবনা করেছি, আর কিছু গাছ কাটার বিষয়ে বন বিভাগের অনুমতির বিধান রেখেছি। সামাজিক বনায়নের নামে গাছ কাটা নিষিদ্ধ করতে আর ইউক্যালিপ্টাসের মতো গাছ না লাগাতেও বিধান আনা হচ্ছে। এসব আইন পর্যালোচনায় আর প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করেছি।

শব্দদূষণ রোধে সরকারের পরিকল্পনা কী?

উত্তর: শব্দদূষণ কমাতে আমরা নতুন বিধিমালা চূড়ান্ত করেছি। এরই মধ্যে আমরা বিমানবন্দর এলাকায় সচেতনতা কার্যক্রম এবং অভিযান করেছি। আগামীতে হর্নের অত্যাচার থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে আমরা বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি, যা শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে। এসব কাজে আমরা শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করেছি।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম কী?

উত্তর: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে মন্ত্রণালয় জাতীয় বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে বায়ুদূষণের প্রকোপ কমাতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণ রোধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্স বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। ধূলিদূষণ কমাতে রাস্তায় প্রতিদিন চারবার পানি ছিটানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কোন রাস্তায় ও কখন পানি ছিটানো হবে, তা কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ থাকবে।

পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের রাস্তার ধুলা ও ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উন্মুক্ত স্থানে ঝরাপাতা বা বর্জ্য পোড়ানো বন্ধে সিটি করপোরেশন ও সরকারি সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশ অমান্য করলে জরিমানা করা হবে।

নির্মাণসামগ্রী পরিবহন ও সংরক্ষণে ঢেকে রাখার বাধ্যবাধকতা কার্যকর করতে ঢাকার প্রবেশপথে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা নির্মাণসামগ্রী অপসারণ এবং ভাঙা রাস্তা মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

রাস্তার ডিভাইডার ও মিডিয়ানের খালি জায়গায় ঘাস বা গাছ লাগানো হবে। বন অধিদপ্তরের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই কার্যক্রম শুরু হবে।

ফিটনেসবিহীন পুরোনো গাড়ি থেকে দূষণ রোধে বিআরটিএ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। বায়ুদূষণকারী শিল্প ও ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর বিপজ্জনক দূষণ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করবে। অভিযানে অংশগ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের চুক্তিতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের শর্ত অন্তর্ভুক্ত করে তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে বায়ুদূষণ রোধে অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অপনারা কী কাজ করছেন?

উত্তর : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় ২০২৫ সালে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরও জোর দেওয়া হবে। এ পরিকল্পনায় নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকির শিকার অঞ্চলের জনগণের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। এতে অবকাঠামো উন্নয়ন, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার এবং সোলার প্যানেল বিতরণের মতো কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভূমিকা কী?

উত্তর: বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে ২০২৫ সালে আমরা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে আরও জোরালো কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করব। বিশেষ করে, জলবায়ু অর্থায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য আমরা সক্রিয় ভূমিকা রাখব।

সবার জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যতের লক্ষ্যে সরকার কী কাজ করছে?

উত্তর: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য হলো এমন একটি বাংলাদেশ তৈরি করা, যেখানে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। আমাদের ২০২৫ সালের প্রতিটি উদ্যোগ এ লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে বলেই আমি মনে করি।

যখনই নদীভাঙন, বাঁধ ভেঙে গেছে বা জলাবদ্ধতার খবর, বনভূমি দখল বা এজাতীয় যেকোনো অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাৎক্ষণিকভাবে তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলোর সমাধান সময়সাপেক্ষ হলেও সরকার এ বিষয়গুলোয় যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে।

পরিশেষে বলতে চাই, ২০২৫ সালকে আমরা একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বাংলাদেশের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার বছর হিসেবে দেখতে চাই। আমরা এ কাজে সবার সহযোগিতাই কামনা করছি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত