নির্বাচনি ট্রেনে উঠছে দেশ

মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৫, ১০: ০২

লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বহুল আলোচিত বৈঠকটির পর দেশের রাজনীতিতে যে স্বস্তির সুবাতাস বইছে, এই আবহ যেন দেশ-বিদেশের কোনো চক্রান্ত নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবপক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করে দেশকে নির্বাচনের ট্রেনে তুলে দিতে হবে, যাতে রোজার আগেই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের প্রায় দেড় ঘণ্টার এই বৈঠক নিয়ে দেশ-বিদেশে সর্বমহলে কৌতূহলের কোনো কমতি ছিল না। বৈঠকে কিছু সময় দুই পক্ষের প্রতিনিধিদল অংশ নিলেও এক ঘণ্টারও বেশি সময় দুই নেতা একান্তে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন সরকারি এবং বিএনপির প্রতিনিধিরা। তাদের পক্ষ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত যৌথ বিবৃতিও পড়ে শোনানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই বিবৃতি নিয়ে দুই পক্ষই তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। দেশে এখন অনেকেই লন্ডন বৈঠকের বিবৃতির পোস্টমর্টেম করেছেন। বৈঠকের ওপর গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার এক সপ্তাহ আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লন্ডন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনো কোনো সংবাদপত্র আগবাড়িয়ে দিন-তারিখও দিয়ে দিয়েছে।

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সংস্কার ও বিচারকাজে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়, তাহলে নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হতে পারে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে, এ কথা স্পষ্ট সিদ্ধান্তের মতো করেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডন বৈঠকে তারেক রহমান ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিলে তাতে সম্মতি জানান প্রধান উপদেষ্টা। তবে, সঙ্গে তিনি ফ্যাসিস্টের বিচার ও সংস্কারের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। যৌথ বিবৃতিতেও তাই বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে রোজার এক সপ্তাহ আগে নির্বাচন হতে পারে।

দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক, বিশেষ করে যৌথ বিবৃতি নিয়ে জামায়াত, এনসিপিসহ আরো দু-একটি দল নাখোশ হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করে বিদেশে বসে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলো কেন, তা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন হলোÑনির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ বা সুনির্দিষ্ট তারিখ কি ঘোষণা করা হয়েছে? তা তো হয়নি। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানও কিছুদিন আগে মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন, রোজার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত সময়। ফলে এই ঘোষণার মাধ্যমে এক ধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। কিছুদিন ধরে এ বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি অসহিষ্ণু আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে তা দূর হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে জাতিকে আশ্বস্ত করার জন্য হয়তো তারা এই যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।

যৌথ বিবৃতি না দিয়ে তারা আলাদাভাবে বিবৃতি দিলে বা সংবাদ সম্মেলন করলে তাতে দুই পক্ষের কথায় কিছু তারতম্য হতে পারত। এতে করে সংকটের সুরাহা না হয়ে বরং পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতে পারত। কিন্তু যৌথ বিবৃতির ফলে সে ধরনের কিছু ঘটেনি। বরং রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে একটি স্বস্তির পরিবেশ বিরাজ করছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। এই ঘোষণা দেওয়ার আগে কি তিনি সব দলের সঙ্গে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? তা তো নেননি। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল প্রধান উপদেষ্টার এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু সে সময় জামায়াত, এনসিপিসহ দু-তিনটি দল প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সূচিকে স্বাগত জানিয়েছিল। তখন বিএনপি বা অন্য কোনো দল অভিযোগ করেনি, জামায়াত ও এনসিপির প্রতি সরকারের বিশেষ অনুরাগ আছে।

নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপিও হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে, লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কার যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। অথচ যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, বিচার এবং সংস্কারে যথেষ্ট অগ্রগতি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই শুধু ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। তাহলে এনসিপির মন খারাপ করার কোনো কারণ তো দেখছি না। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, এনসিপি দল গোছানোর জন্য সরকারের ভেতর ও বাইরে থেকে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল নিয়েছে। এই অভিযোগের জবাব তো এনসিপি নেতাদেরই দেওয়া উচিত।

দেশ এখন ক্রমেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সংগত কারণেই সব দলেরই উচিত দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া, যাতে আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে। এ জন্য প্রতিটি দলকেই তাদের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে হবে। কোনো দল এ ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করলে তাদের অবশ্যই জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

লন্ডন বৈঠকের ফলাফলে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত। এর যথেষ্ট কারণও আছে।

এই বৈঠকের মাধ্যমে রাজনীতিতে স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বৈঠকের শুরু এবং শেষটা যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে দেখব, খুবই আন্তরিক পরিবেশে বৈঠকটি শুরু ও শেষ হয়েছে। ধরেই নেওয়া যায়, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের নানা রাজনৈতিক ইস্যু, আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে নিবিড় আলোচনা হয়েছে। তারা হয়তো বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্যও পোষণ করেছেন। ফলে, বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মী ও সমর্থকরা উদ্বেলিত হবেনÑএটাই স্বাভাবিক।

লন্ডনে সরকারের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি তুলেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো তারিখ ঘোষণার সিগন্যাল পাননি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দুই নেতার একান্ত আলোচনায় বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছে, তার প্রতিফলন আমরা অচিরেই দেখতে পাব।

লেখক : বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সম্পাদক ও নব্বইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম শীর্ষ নেতা

বিষয়:

মতামত
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত