রাজু আলীম
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ আবারও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবিকে ঘিরে যে রাজনৈতিক তৎপরতা, বিদেশি প্রভাব এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা শুরু হয়েছে, তা দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বিগ্ন করেছে। একদিকে কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন “ডিমিলিটারাইজেশন” বা সেনা উপস্থিতি হ্রাসের দাবি তুলছে, অন্যদিকে বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে—সেনাবাহিনীই এখনো পাহাড়ের শান্তি ও স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় ভরসা।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি হয়েছিল অস্ত্রবিরতি ও আস্থার এক প্রতিশ্রুতি হিসেবে। কিন্তু এর প্রায় তিন দশক পরও পাহাড়ে পুরোপুরি শান্তি আসেনি। সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত, চাঁদাবাজি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বিদেশি গোষ্ঠীর প্রভাব এখনো শান্তি প্রক্রিয়ার বড় বাধা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেনা উপস্থিতি না থাকলে পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে এই ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেখানে বেশিরভাগ সদস্যের অভিমত ছিল, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বজায় রেখে প্রশাসনিক কার্যক্রম আরো জোরদার করাই এখন জরুরি।
দীর্ঘ সময় ধরে পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনী কেবল নিরাপত্তা রক্ষাই নয়, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল, হাসপাতাল, সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ, চিকিৎসাসেবা, দূরবর্তী গ্রামে খাদ্য সহায়তা—এসব কাজের বেশিরভাগই করেছে সেনাবাহিনী। এসব কারণে স্থানীয় জনগণের বড় অংশ তাদের ওপর আস্থা রাখে। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির দুর্গম অঞ্চলে যারা বসবাস করেন, তারা জানেন—সেনা টহল না থাকলে সেখানে রাতে শান্তিতে ঘুমানো কঠিন। পাহাড়ের সাধারণ মানুষের ভাষায়, সেনাবাহিনী এখন নিরাপত্তার প্রতীক, ভয় নয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে “বিদেশি ষড়যন্ত্র” এবং কিছু এনজিওর নেপথ্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ সম্প্রতি এক টেলিভিশন আলোচনায় বলেন, “পাহাড়ে সেনা প্রত্যাহারের দাবি মূলত বাহ্যিক চাপে তৈরি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। বাস্তবে এটি করলে পুরো অঞ্চল অনিশ্চয়তায় পড়বে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।” একই মত দিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর ভাষায়, “১৯৯৭ সালের চুক্তি কখনোই সেনা প্রত্যাহারের অঙ্গীকার দেয়নি, বরং প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল। এখন যারা সেনা সরানোর দাবি তুলছে, তারা চুক্তির মূল চেতনারই বিপরীতে অবস্থান করছে।”
অন্যদিকে, পার্বত্য এলাকায় সম্প্রতি পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে কয়েকটি ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠী। রাঙামাটি ও বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় গুলিবিনিময়, অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত অন্তত ১২টি সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত ও আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় বিদেশে পালিয়ে থাকা কিছু নেতার যোগাযোগ ও অর্থায়নের প্রমাণও পাওয়া গেছে। ফলে অনেকেই মনে করেন, সেনা প্রত্যাহারের দাবি মূলত এই গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমকে সহজতর করার কৌশল।
পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি চাইলে কেবল চুক্তির রাজনৈতিক দিক নয়, নিরাপত্তা বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হবে। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কমানো মানে শুধু পাহাড়ের মানুষকেই ঝুঁকিতে ফেলা নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলা। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি কৌশলগত অঞ্চল—দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যু, সীমান্ত অস্থিরতা ও আন্তঃদেশীয় মাদক চোরাচালানের মতো সমস্যা জটিলভাবে জড়িত। এমন অঞ্চলে সেনাবাহিনী ছাড়া স্থিতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা কল্পনাই করা যায় না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ইতোমধ্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, পাহাড়ের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার কোনো আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত নেবে না। সরকারের এক শীর্ষ নীতিনির্ধারক সম্প্রতি গণমাধ্যমে জানান, “চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন মানে কখনোই সেনা প্রত্যাহার নয়, বরং নিরাপত্তা ও উন্নয়নের সমন্বয় নিশ্চিত করা।” এই বক্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সরকার সেনাবাহিনীর ভূমিকা সীমিত করার কোনো পরিকল্পনায় নেই।
তবে এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিজস্ব ভূমিকা আরো সমন্বিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সমস্যা সমাধানের প্রবণতা বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনীর সিভিক অ্যাকশন প্রোগ্রামগুলো আরো সম্প্রসারিত করা দরকার, যাতে সাধারণ মানুষ শান্তির সুফল সরাসরি অনুভব করতে পারে। একইসঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তির অসম্পূর্ণ ধারাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে স্থানীয় জনগণের আস্থাও পুনরুদ্ধার করা জরুরি।
অবশ্য বিদেশি প্রভাবের প্রসঙ্গটি এখন সবচেয়ে আলোচিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা সম্প্রতি পাহাড়ে সেনা উপস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে সেনা কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তাদের মতে, সেনা উপস্থিতি না থাকলে পাহাড়ে অপরাধীরা প্রভাব বিস্তার করবে, যা কেবল পাহাড় নয়, সমতল জনপদেও প্রভাব ফেলবে।
এই বাস্তবতায় দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে একটি পরিষ্কার দায়িত্ব রয়েছে—পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে যেন কোনো বিদেশি স্বার্থ বা গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র সফল না হয়। সেনাবাহিনীকে পাহাড় থেকে সরানোর দাবি যতই মানবিক আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হোক না কেন, বাস্তবে এটি শান্তি নয়, অস্থিরতা বয়ে আনবে। তাই এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে স্থানীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
পাহাড়ের মানুষ যেমন উন্নয়ন ও শান্তি চায়, তেমনি বাংলাদেশ চায় তার সীমান্তে স্থিতিশীলতা। এই দুই লক্ষ্য একে অপরের পরিপূরক। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সেই ভারসাম্যের অন্যতম স্তম্ভ। পাহাড়ে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন একদিন নিশ্চয় সম্ভব হবে, কিন্তু সেই দিন আসবে তখনই, যখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরো গঠনমূলকভাবে মূল্যায়িত হবে, রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে থেকে। পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে, তবে সেই শান্তি টিকিয়ে রাখতে হলে সেনাবাহিনীর দায়িত্বকে দুর্বল নয়, বরং শক্তিশালী করাই এখন সময়ের দাবি।
একইসঙ্গে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, পাহাড়ে শান্তির প্রক্রিয়া কেবল নিরাপত্তা দিয়ে নয়, উন্নয়ন ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির মাধ্যমেই টেকসই হতে পারে। সেনাবাহিনী সেখানে একটি সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করছে—যেখানে উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সম্প্রীতি একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনী পরিচালিত “সেনা চিকিৎসা সেবা” বা মেডিকেল ক্যাম্প, দুর্গম গ্রামে শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ, কৃষি ও পানি প্রকল্পের মতো উদ্যোগ স্থানীয়দের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন এনেছে। এগুলো শুধু মানবিক কার্যক্রম নয়, বরং আস্থার ভিত্তি তৈরি করছে।
অন্যদিকে, পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও এখন দায়িত্ব রয়েছে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধ করে জনগণের কাছে জবাবদিহি তৈরি করা। যারা অস্ত্রধারণ করে শান্তিচুক্তিকে অস্বীকার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে রাষ্ট্রকেই নয়, স্থানীয় সমাজকেও। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব তখনই, যখন স্থানীয় জনগণ সেনাবাহিনীকে সহযোগী হিসেবে দেখবে, প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়। সেই মানসিকতা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু তা ভেঙে দিতে বিদেশি তহবিলনির্ভর কিছু গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী সবসময় জাতীয় সংকটে নিরপেক্ষ, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও রাষ্ট্রবাদী শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। পাহাড়েও সেই দায়িত্ব তারা পালন করছে নিষ্ঠার সঙ্গে। যেসব রাষ্ট্রে সীমান্ত দুর্বল, সেখানেই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তৈরি হয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি আসলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক।
এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য, যাতে কোনো দল বা গোষ্ঠী এই প্রশ্নে বিভাজন তৈরি না করতে পারে। সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, তা বাস্তব পরিস্থিতি নয়, বরং রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশের জনগণ এই বাস্তবতা বুঝতে পারছে—এ কারণেই পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে অধিকাংশ মানুষ শান্তির নিশ্চয়তা হিসেবে দেখছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু আন্দোলন ও সংঘাতের পর যে শান্তি এসেছে, তা ধরে রাখতে সময় লাগে। পার্বত্য চট্টগ্রামও সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। সেনাবাহিনীর ত্যাগ, তাদের উন্নয়নমূলক অবদান এবং জনগণের সঙ্গে আস্থা তৈরির প্রচেষ্টা আজ এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে। এই অধ্যায়কে রাজনৈতিক স্বার্থে বিঘ্নিত করা মানে শুধু পাহাড় নয়, গোটা জাতির নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলা। তাই পাহাড়ে শান্তির ভবিষ্যৎ এখনো সেনাবাহিনীর উপস্থিতির সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িয়ে আছে—এটাই আজকের বাস্তবতা, এবং এটিই বাংলাদেশের নিরাপত্তার শক্তিশালী ভিত্তি।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ আবারও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবিকে ঘিরে যে রাজনৈতিক তৎপরতা, বিদেশি প্রভাব এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা শুরু হয়েছে, তা দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বিগ্ন করেছে। একদিকে কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন “ডিমিলিটারাইজেশন” বা সেনা উপস্থিতি হ্রাসের দাবি তুলছে, অন্যদিকে বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে—সেনাবাহিনীই এখনো পাহাড়ের শান্তি ও স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় ভরসা।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি হয়েছিল অস্ত্রবিরতি ও আস্থার এক প্রতিশ্রুতি হিসেবে। কিন্তু এর প্রায় তিন দশক পরও পাহাড়ে পুরোপুরি শান্তি আসেনি। সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত, চাঁদাবাজি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং বিদেশি গোষ্ঠীর প্রভাব এখনো শান্তি প্রক্রিয়ার বড় বাধা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেনা উপস্থিতি না থাকলে পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে এই ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেখানে বেশিরভাগ সদস্যের অভিমত ছিল, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বজায় রেখে প্রশাসনিক কার্যক্রম আরো জোরদার করাই এখন জরুরি।
দীর্ঘ সময় ধরে পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনী কেবল নিরাপত্তা রক্ষাই নয়, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল, হাসপাতাল, সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ, চিকিৎসাসেবা, দূরবর্তী গ্রামে খাদ্য সহায়তা—এসব কাজের বেশিরভাগই করেছে সেনাবাহিনী। এসব কারণে স্থানীয় জনগণের বড় অংশ তাদের ওপর আস্থা রাখে। বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির দুর্গম অঞ্চলে যারা বসবাস করেন, তারা জানেন—সেনা টহল না থাকলে সেখানে রাতে শান্তিতে ঘুমানো কঠিন। পাহাড়ের সাধারণ মানুষের ভাষায়, সেনাবাহিনী এখন নিরাপত্তার প্রতীক, ভয় নয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে “বিদেশি ষড়যন্ত্র” এবং কিছু এনজিওর নেপথ্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ সম্প্রতি এক টেলিভিশন আলোচনায় বলেন, “পাহাড়ে সেনা প্রত্যাহারের দাবি মূলত বাহ্যিক চাপে তৈরি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। বাস্তবে এটি করলে পুরো অঞ্চল অনিশ্চয়তায় পড়বে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।” একই মত দিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর ভাষায়, “১৯৯৭ সালের চুক্তি কখনোই সেনা প্রত্যাহারের অঙ্গীকার দেয়নি, বরং প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল। এখন যারা সেনা সরানোর দাবি তুলছে, তারা চুক্তির মূল চেতনারই বিপরীতে অবস্থান করছে।”
অন্যদিকে, পার্বত্য এলাকায় সম্প্রতি পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে কয়েকটি ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠী। রাঙামাটি ও বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় গুলিবিনিময়, অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত অন্তত ১২টি সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত ও আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় বিদেশে পালিয়ে থাকা কিছু নেতার যোগাযোগ ও অর্থায়নের প্রমাণও পাওয়া গেছে। ফলে অনেকেই মনে করেন, সেনা প্রত্যাহারের দাবি মূলত এই গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমকে সহজতর করার কৌশল।
পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি চাইলে কেবল চুক্তির রাজনৈতিক দিক নয়, নিরাপত্তা বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হবে। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কমানো মানে শুধু পাহাড়ের মানুষকেই ঝুঁকিতে ফেলা নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলা। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি কৌশলগত অঞ্চল—দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যু, সীমান্ত অস্থিরতা ও আন্তঃদেশীয় মাদক চোরাচালানের মতো সমস্যা জটিলভাবে জড়িত। এমন অঞ্চলে সেনাবাহিনী ছাড়া স্থিতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা কল্পনাই করা যায় না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ইতোমধ্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, পাহাড়ের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার কোনো আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত নেবে না। সরকারের এক শীর্ষ নীতিনির্ধারক সম্প্রতি গণমাধ্যমে জানান, “চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন মানে কখনোই সেনা প্রত্যাহার নয়, বরং নিরাপত্তা ও উন্নয়নের সমন্বয় নিশ্চিত করা।” এই বক্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সরকার সেনাবাহিনীর ভূমিকা সীমিত করার কোনো পরিকল্পনায় নেই।
তবে এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিজস্ব ভূমিকা আরো সমন্বিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সমস্যা সমাধানের প্রবণতা বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনীর সিভিক অ্যাকশন প্রোগ্রামগুলো আরো সম্প্রসারিত করা দরকার, যাতে সাধারণ মানুষ শান্তির সুফল সরাসরি অনুভব করতে পারে। একইসঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তির অসম্পূর্ণ ধারাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে স্থানীয় জনগণের আস্থাও পুনরুদ্ধার করা জরুরি।
অবশ্য বিদেশি প্রভাবের প্রসঙ্গটি এখন সবচেয়ে আলোচিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা সম্প্রতি পাহাড়ে সেনা উপস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে সেনা কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তাদের মতে, সেনা উপস্থিতি না থাকলে পাহাড়ে অপরাধীরা প্রভাব বিস্তার করবে, যা কেবল পাহাড় নয়, সমতল জনপদেও প্রভাব ফেলবে।
এই বাস্তবতায় দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে একটি পরিষ্কার দায়িত্ব রয়েছে—পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে যেন কোনো বিদেশি স্বার্থ বা গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র সফল না হয়। সেনাবাহিনীকে পাহাড় থেকে সরানোর দাবি যতই মানবিক আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হোক না কেন, বাস্তবে এটি শান্তি নয়, অস্থিরতা বয়ে আনবে। তাই এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে স্থানীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
পাহাড়ের মানুষ যেমন উন্নয়ন ও শান্তি চায়, তেমনি বাংলাদেশ চায় তার সীমান্তে স্থিতিশীলতা। এই দুই লক্ষ্য একে অপরের পরিপূরক। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সেই ভারসাম্যের অন্যতম স্তম্ভ। পাহাড়ে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন একদিন নিশ্চয় সম্ভব হবে, কিন্তু সেই দিন আসবে তখনই, যখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরো গঠনমূলকভাবে মূল্যায়িত হবে, রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে থেকে। পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে, তবে সেই শান্তি টিকিয়ে রাখতে হলে সেনাবাহিনীর দায়িত্বকে দুর্বল নয়, বরং শক্তিশালী করাই এখন সময়ের দাবি।
একইসঙ্গে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, পাহাড়ে শান্তির প্রক্রিয়া কেবল নিরাপত্তা দিয়ে নয়, উন্নয়ন ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির মাধ্যমেই টেকসই হতে পারে। সেনাবাহিনী সেখানে একটি সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করছে—যেখানে উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সম্প্রীতি একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনী পরিচালিত “সেনা চিকিৎসা সেবা” বা মেডিকেল ক্যাম্প, দুর্গম গ্রামে শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ, কৃষি ও পানি প্রকল্পের মতো উদ্যোগ স্থানীয়দের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন এনেছে। এগুলো শুধু মানবিক কার্যক্রম নয়, বরং আস্থার ভিত্তি তৈরি করছে।
অন্যদিকে, পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও এখন দায়িত্ব রয়েছে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধ করে জনগণের কাছে জবাবদিহি তৈরি করা। যারা অস্ত্রধারণ করে শান্তিচুক্তিকে অস্বীকার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে রাষ্ট্রকেই নয়, স্থানীয় সমাজকেও। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব তখনই, যখন স্থানীয় জনগণ সেনাবাহিনীকে সহযোগী হিসেবে দেখবে, প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়। সেই মানসিকতা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে, কিন্তু তা ভেঙে দিতে বিদেশি তহবিলনির্ভর কিছু গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী সবসময় জাতীয় সংকটে নিরপেক্ষ, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও রাষ্ট্রবাদী শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। পাহাড়েও সেই দায়িত্ব তারা পালন করছে নিষ্ঠার সঙ্গে। যেসব রাষ্ট্রে সীমান্ত দুর্বল, সেখানেই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তৈরি হয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি আসলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক।
এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য, যাতে কোনো দল বা গোষ্ঠী এই প্রশ্নে বিভাজন তৈরি না করতে পারে। সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে, তা বাস্তব পরিস্থিতি নয়, বরং রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশের জনগণ এই বাস্তবতা বুঝতে পারছে—এ কারণেই পাহাড়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে অধিকাংশ মানুষ শান্তির নিশ্চয়তা হিসেবে দেখছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু আন্দোলন ও সংঘাতের পর যে শান্তি এসেছে, তা ধরে রাখতে সময় লাগে। পার্বত্য চট্টগ্রামও সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। সেনাবাহিনীর ত্যাগ, তাদের উন্নয়নমূলক অবদান এবং জনগণের সঙ্গে আস্থা তৈরির প্রচেষ্টা আজ এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে। এই অধ্যায়কে রাজনৈতিক স্বার্থে বিঘ্নিত করা মানে শুধু পাহাড় নয়, গোটা জাতির নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলা। তাই পাহাড়ে শান্তির ভবিষ্যৎ এখনো সেনাবাহিনীর উপস্থিতির সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িয়ে আছে—এটাই আজকের বাস্তবতা, এবং এটিই বাংলাদেশের নিরাপত্তার শক্তিশালী ভিত্তি।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে