প্রতিবেশীদের সঙ্গে ক্রমাগত বিবাদে লিপ্ত যে দেশটি

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫, ১১: ০৭
আপডেট : ২১ মে ২০২৫, ১১: ১০

পৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ, যে দেশটির সঙ্গে তার সব প্রতিবেশীর সম্পর্ক তিক্ততায় ভরা। শুধু তা-ই নয়, ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার এমন একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে, যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হচ্ছে সংঘাতপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া। শুধু ইসলামবিদ্বেষ থেকে এই ন্যারেটিভের জন্ম হয়েছে—একদম ইসরাইলের জায়নবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ, যেমনটা জার্মানিতে এডলফ হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে করেছিলেন।

আজ এটা ভাবতে অবাক লাগে, যারা নাৎসিদের দ্বারা নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল, তারাই আজ জায়নবাদের ধ্বজা ধরে ফিলিস্তিনে মুসলমানদের হত্যা করছে নির্বিচারে। প্রচণ্ড মুসলিম ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকে জায়নবাদীরা এই হত্যার উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। ঠিক একইভাবে জায়নবাদীদের অনুসরণ করে চরম মুসলিমবিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে হিন্দুত্ববাদ তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদের উত্থানকাল প্রায় কাছাকাছি সময়ের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

তবে ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের উসকিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে সেই ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা, যারা ইউরোপ থেকে খ্রিষ্টান নয় এমন বাসিন্দাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার মাধ্যমে নির্মূল করেছিল। ইতিহাস বলছে, দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে অখ্রিষ্টানদের হাত থেকে ইউরোপ মুক্ত করতে যে রক্তাক্ত অভিযান চালানো হয়েছিল, তা ছিল ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম একটা অধ্যায়। এই অভিযানে নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল ধর্মীয় উল্লাসে। এর মধ্যে পেগান ধর্মাবলম্বী অথবা ব্যক্তিগত বিশ্বাস অনুযায়ী, ধর্মীয় জীবনযাপন করার অপরাধে কত হাজার হাজার ইউরোপীয় পেগান নর-নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। গোটা ইউরোপীয় মহাদেশ থেকে পেগান ধর্মাবলম্বীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

মোদ্দা কথা, ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার চলেছে তরবারির দ্বারা নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। সেই ইউরোপীয় ইংরেজ খ্রিষ্টানরা ভারতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে ভালো মানুষ সেজে মুসলমানদের অত্যাচারী, উৎপীড়ক, হত্যাকারী, হিন্দু নিধনকারী, জোরপূর্বক ইসলাম প্রচারকারী, মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণকারী প্রভৃতি অপবাদে ভূষিত করেছিল। আজ হিন্দুত্ববাদীরা ব্রিটিশদের সেসব বানোয়াট ও মিথ্যা ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে সাধারণ হিন্দুদের উত্তেজিত করছে।

পরে হিন্দুত্ববাদীরা জায়ানবাদের পথ অনুসরণ করা শুরু করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এই জায়ানবাদ আন্দোলন সূচিত হয়। এই আন্দোলনের মূল কথা ছিল ইহুদি ধর্ম একটি জাতি-সাংস্কৃতিক বা একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। খুব মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিটলারের যে উগ্র জাতীয়তাবাদ ইহুদি নিধনকে উৎসাহিত করেছিল, ঠিক সেই জার্মান জাতীয়তাবাদের মতোই জায়নবাদী জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করে। এক্ষেত্রে জায়নবাদীদের টার্গেট হচ্ছে মুসলিমরা।

অন্যদিকে ১৯২৩ সালের দিকে বিনায়ক দামোদর সাভারকার হিন্দুত্ববাদের যে ধারণা সামনে নিয়ে আসেন, তাকেও বলা হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ। সাভারকারের মতে, হিন্দু ধর্ম হচ্ছে একটি সংস্কৃতি, যার সঙ্গে বৌদ্ধ, জৈন, বৈষ্ণব ও শিখরা কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। তিনি এই ধর্মগুলোকে চিহ্নিত করেন হিন্দু ধর্ম হিসেবে। এগুলোর সঙ্গে হিন্দু ধর্মের যেটুকু পার্থক্য বা ভেদাভেদ আছে, তা দূর করা প্রয়োজন বলে তিনি ভেবেছেন। তিনি যে হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছেন, তা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ হিসেবে, যাকে অখণ্ড ভারত বলা হয়।

আর সেই অখণ্ড ভারত মানে গোটা উপমহাদেশ, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা। তাই ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোকে একীভূত করার স্বপ্ন দেখে আসছে বহুকাল ধরে। যদিও সাভারকারের তাত্ত্বিক ভিত্তিকে অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু যাকে ‘নেহেরু ডকট্রিন’ হিসেবে সবাই জানে। যদিও এদের সবার আসল গুরু হচ্ছে চাণক্য। ভারতের মেকিয়াভেলি হিসেবে পরিচিত এই চাণক্য বহু শত বছর আগে বলে গেছেন, ‘ক্ষমতা অর্জনের লোভ এবং অন্যদের বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা কখনো মন থেকে মুছে ফেলো না। সব সীমান্ত রাজাকে শত্রু বলে মনে করবে।’ ফলে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, প্রাচীন ভারতের এই রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদের চিন্তাধারা সাভারকার ও পণ্ডিত নেহেরুকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছিল।

আর নেহেরু ডক্ট্রিনে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের অভিলাষ ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত হবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে; কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে না। অর্থাৎ এ থেকে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে, চাণক্য, সাভারকার, নেহেরু ডক্ট্রিন, আরএসএস, বিজেপি প্রভৃতি সব হিন্দুত্ববাদী সংগঠন একই সুতায় গাঁথা। আর এ ধরনের এই সম্প্রসারণবাদী নীতি হিন্দুত্ববাদীদের এমন এক শক্তি হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে যে, শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো ক্ষমতা এই অঞ্চলে কারো থাকবে না। ঠিক এরকম ভাবনা থেকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বেই ভারত কখনো কৌশলে কখনো শক্তি প্রয়োগ করে হায়দরাবাদ, জুনাগড়, কাশ্মীর, মণিপুর ও সিকিম দখল করে নিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী চীন আক্রমণ করে, যদিও এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তারপর ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশে তার সামরিক বিজয় হিন্দুত্ববাদীদের অখণ্ড ভারত সৃষ্টির চেতনাকে আরো শানিত করে। সেই থেকে ভারত ক্রমাগতভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর খবরদারি করার চেষ্টা করে আসছে।

বর্তমানে ভারতের প্রতিবেশী দেশের সংখ্যা আটটি। যেমন চীন, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। আর এই আট প্রতিবেশী ও ভারতের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ৩৩০ কোটিরও বেশি। এ ছাড়া এই আট প্রতিবেশী দেশের তিনটি মুসলিম দেশ; অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ। অন্যদিকে ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশ। চীনে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান ও অন্যান্য কিছু ধর্মের মানুষ থাকলেও মূলত বেশিরভাগ চীনা মানুষ ধর্মহীন। সেই অর্থে নেপাল হচ্ছে পুরোপুরি একটা হিন্দু রাষ্ট্র।

এখন সার্ক জোটভুক্ত সাতটি দেশ ও চীনের মোট ৩৩০ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা জাতপাত নির্বিশেষে বড়জোর ৯০ কোটি হবে। চীনকে বাদ দিলে নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পক্ষান্তরে এই সাতটি দেশে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছাকাছি দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ধর্মাবলম্বীরা হচ্ছে মুসলমান। সুতরাং এই ৭০ কোটি মুসলমানকে নিশ্চিহ্ন করে উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় কতটা অলীক, তা কেবল হিন্দু পুরাণেই পাওয়া যেতে পারে।

এমবি

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত