জুলফিকার হায়দার
মধ্যপ্রাচ্য একটা রাজনৈতিক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। চলতি শতাব্দীর শুরুর দশকের গোড়া থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু রাজধানীতে নিজেদের প্রভাব পাকাপোক্ত করেছিল ইরান। সেই প্রভাবে এখন ভাটা পড়েছে। আর সেই শূন্য জায়গাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে এই নতুন রাজনৈতিক রূপান্তর। গাজা, দামেস্ক ও বৈরুতের পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে উপসাগরীয় দেশগুলো।
তবে তাদের এই প্রচেষ্টা শুধু পুনর্গঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইরান ও তাদের প্রক্সি গ্রুপগুলোর শক্তি কমে যাওয়ায় এই অঞ্চলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, উপসাগরীয় দেশগুলো এখন সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছে। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার ৬১ বছরের দীর্ঘ বাথিস্ট সরকার এবং বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। দামেস্কের ওপর ইরানের যে প্রভাব ছিল, আসাদের পতনে সেটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। অন্যদিকে ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুথি ছাড়াও ইরাকে ইরান-সমর্থিত অন্য মিলিশিয়াদের ওপর হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে ইসরাইল। এই হামলা মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ইরানকেও বেশ খানিকটা দুর্বল করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলো নিজস্ব নিরাপত্তা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই আঞ্চলিক ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় নিতে বাধ্য হচ্ছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালেও উপসাগরীয় দেশগুলোয় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তবে এই দুই সময়ের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এবার তারা সুনির্দিষ্টি কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে আঞ্চলিক এই বহুমাত্রিক চাপকে নিজেদের সুবিধায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বলয়ে ইরানের প্রভাব-উত্তর সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার করা। এই দেশগুলো তেহরানের প্রভাব মোকাবিলা করছে, প্রভাব হ্রাসের শূন্যতা ইরান কী দিয়ে পূরণ করবে, সে বিষয়ে তাদের ধারণা অর্জন করতে হচ্ছে এবং সে অনুসারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে লেবানন ও সিরিয়ার মতো যে দেশগুলোয় ইরানের কর্তৃত্ব কমে এসেছে, সেই দেশগুলোর ব্যাপারে নতুন কৌশলও গ্রহণ করছে উপসাগরীয় দেশগুলো।
ইরানের প্রভাব হ্রাসের যে প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা সবচেয়ে বেশি বোঝা যাবে দামেস্কে। এরই মধ্যে সেটা স্পষ্ট হয়েছে। সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা প্রথম আনুষ্ঠানিক সফরে রিয়াদ আর আঙ্কারাকে বেছে নিয়েছেন। এই সফরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি বার্তা দিয়েছেন যে, দামেস্ক এখন আর তেহরানের বলয়ের মধ্যে নেই।
রিয়াদে আল-শারার সফরের মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে, সিরিয়ার নতুন সরকার উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। এমনকি রিয়াদ সফরের আগেও আল-শারা সৌদি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি রিয়াদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা, বিশেষ করে ‘ভিশন ২০৩০’-এর ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছেন। সিরিয়ার পুনর্গঠনে সৌদি আরব যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাও উল্লেখ করেছেন আল-শারা।
রিয়াদের সঙ্গে আল-শারার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাদ দিলেও সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য যে সহায়তা দরকার, সেটার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দামেস্ক-রিয়াদের শক্তিশালী সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু রিয়াদ নয়, বরং সিরিয়ার পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার ব্যাপারে দোহাও গভীর আগ্রহ জানিয়েছে।
আল-শারা নিজে যদিও প্রথম সফরে রিয়াদ গেছেন, কিন্তু বাইরের কোনো দেশের প্রধান হিসেবে প্রথম দামেস্ক সফর করেছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। এই সফরই বলে দেয় সিরিয়ার ভবিষ্যতের প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায় কাতার। ফলে আল-শারাসহ দামেস্কের নেতারা এখন উপসাগরীয় অঞ্চলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা আশা করছেন, এই দেশগুলো একটা সমন্বিত বহুপক্ষীয় সিরিয়া কৌশল গ্রহণ করবে, যেটা রাজনৈতিকভাবে ইরানের প্রভাব কমিয়ে আনবে, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ত্বরান্বিত করবে এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
এটা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতেই মূলত আল-শারা আর সিরিয়ার নতুন নেতারা উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করছেন। তবে উপসাগরীয় দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে এই সম্পর্কের ব্যাপ্তি আরো বড়। দামেস্ক পুনর্গঠনের বাইরেও তারা বৈরুত-দামেস্ক অক্ষ এবং এর ব্যবস্থাপনার কথা ভাবছে, যেটাকে তারা ইরানবিরোধী ব্লক হিসেবে দাঁড় করাতে চায়।
২০১৯ সালের জুনে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপর ২০২৩ সালের মার্চে সৌদি আরবও একই পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু ইরান এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ৭ অক্টোবরের পর থেকে তাদের ব্যাপারে আগাম কিছু বলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক যদিও স্বাভাবিকভাবে জারি রাখবে উপসাগরীয় দেশগুলো, কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কৌশলগত জায়গা থেকে ইরানের প্রভাব হ্রাসের বিষয়টিকে তারা স্বাগত জানাবে।
এসব ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে আসাদ সরকারের পতনের কারণে দামেস্কে তেহরানের প্রভাব বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এদিকে ৭ অক্টোবরের পর থেকে তাদের প্রক্সি গ্রুপগুলোর রাজনৈতিক, সামরিক ও আভিযানিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরান হিজবুল্লাহকে যে অস্ত্র সরঞ্জাম সরবরাহ করত, সেটাও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে হিজবুল্লাহর আভিযানিক শক্তি বেশ খানিকটা কমে গেছে এবং লেবাননের ওপর তেহরান তাদের প্রভাব ধরে রাখতে পারছে না।
এই পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় দেশগুলো এখন সরাসরি বৈরুতের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। জোসেফ আউন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই শহরের সঙ্গে সম্পর্কের একটা নতুন দরজা খুলতে চাচ্ছেন তারা। রিয়াদ ও দোহা সম্প্রতি তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মাধ্যমে লেবাননের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ আরো বাড়িয়েছে। দোহার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন, তিনি বৈরুতের পুনর্গঠনের ব্যপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। সিরিয়ার পুনর্গঠনের ব্যপারেও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কাতার।
ইরান-ইসরাইল উত্তেজনার প্রভাব এখন উপসাগরীয় অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে দামেস্ক-বৈরুত অক্ষে তেহরানের প্রভাবও আর আগের মতো নেই। উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য এখানে সংকট ও সুযোগ দুটোই হাজির হয়েছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্প আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার ব্যপারে যে আইন-বহির্ভূত ও ইতিহাস-বিমুখ পরিকল্পনা নিয়েছেন, সেটা হবে উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ। এই প্রস্তাব এতটাই কট্টর ও অবাস্তব যে, অধিকাংশ আঞ্চলিক দেশ তাৎক্ষণিকভাবে সেটাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আর উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে গাজা পুনর্গঠনের প্রশ্নে যে আলোচনা হবে, সেখানে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতের ইস্যুটিই মূলত প্রাধান্য পাবে। উপসাগরীয় দেশগুলো গাজার অধিবাসীদের সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কঠোর বিরোধিতা করেছে এবং ওয়াশিংটনকে তারা তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।
পরিবর্তিত আঞ্চলিক পরিস্থিতি একই সঙ্গে উপসাগরীয় ভূরাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির জন্য নতুন সুযোগও নিয়ে এসেছে। তেহরানের প্রভাব কমে যাওয়ায় দামেস্ক ও বৈরুতের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলোর ভূমিকা অনেকটাই বেড়ে গেছে।
তবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইল যেসব কট্টর নীতি গ্রহণ করেছে, তার মোকাবিলায় উপসাগরীয় দেশগুলোকে হয়তো গালফ কোঅপারেশান কাউন্সিল বা জিসিসির গৃহীত পদক্ষেপ এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলোকে হয়তো আরো স্বাধীন ও আগ্রাসী কৌশল গ্রহণের দিকে যেতে হবে।
অদূর ভবিষ্যতে দামেস্ক, বৈরুত ও গাজার পুনর্গঠনের ইস্যুগুলো উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠবে। এজন্য তাদের বড় ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
এই ইস্যুগুলোকে কেন্দ্র করে আগামীতে একটা অভিন্ন ধারা দেখা যেতে পারে। সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরাইল এসব ইস্যুতে কট্টর সব প্রস্তাব হাজির করতে পারে। ধারণা করা যায়, এর মোকাবিলায় উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের আঞ্চলিক পদক্ষেপের ব্যাপ্তি আরো বাড়াবে। শুধু গাজাকেন্দ্রিক নয়, বরং দামেস্ক আর বৈরুতের ব্যপারেও তারা সক্রিয় হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই প্রচেষ্টাগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার ব্যাপারে তারা নেতৃত্ব দেবে। এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র যেভাবে বদলে যাচ্ছে, এই নেতৃত্বের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় পক্ষ হিসেবে হাজির হবে।
মধ্যপ্রাচ্য একটা রাজনৈতিক রূপান্তরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। চলতি শতাব্দীর শুরুর দশকের গোড়া থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু রাজধানীতে নিজেদের প্রভাব পাকাপোক্ত করেছিল ইরান। সেই প্রভাবে এখন ভাটা পড়েছে। আর সেই শূন্য জায়গাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে এই নতুন রাজনৈতিক রূপান্তর। গাজা, দামেস্ক ও বৈরুতের পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে উপসাগরীয় দেশগুলো।
তবে তাদের এই প্রচেষ্টা শুধু পুনর্গঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইরান ও তাদের প্রক্সি গ্রুপগুলোর শক্তি কমে যাওয়ায় এই অঞ্চলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, উপসাগরীয় দেশগুলো এখন সেই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছে। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার ৬১ বছরের দীর্ঘ বাথিস্ট সরকার এবং বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। দামেস্কের ওপর ইরানের যে প্রভাব ছিল, আসাদের পতনে সেটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। অন্যদিকে ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুথি ছাড়াও ইরাকে ইরান-সমর্থিত অন্য মিলিশিয়াদের ওপর হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে ইসরাইল। এই হামলা মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ইরানকেও বেশ খানিকটা দুর্বল করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলো নিজস্ব নিরাপত্তা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই আঞ্চলিক ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় নিতে বাধ্য হচ্ছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালেও উপসাগরীয় দেশগুলোয় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তবে এই দুই সময়ের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এবার তারা সুনির্দিষ্টি কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে আঞ্চলিক এই বহুমাত্রিক চাপকে নিজেদের সুবিধায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বলয়ে ইরানের প্রভাব-উত্তর সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার করা। এই দেশগুলো তেহরানের প্রভাব মোকাবিলা করছে, প্রভাব হ্রাসের শূন্যতা ইরান কী দিয়ে পূরণ করবে, সে বিষয়ে তাদের ধারণা অর্জন করতে হচ্ছে এবং সে অনুসারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে লেবানন ও সিরিয়ার মতো যে দেশগুলোয় ইরানের কর্তৃত্ব কমে এসেছে, সেই দেশগুলোর ব্যাপারে নতুন কৌশলও গ্রহণ করছে উপসাগরীয় দেশগুলো।
ইরানের প্রভাব হ্রাসের যে প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা সবচেয়ে বেশি বোঝা যাবে দামেস্কে। এরই মধ্যে সেটা স্পষ্ট হয়েছে। সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা প্রথম আনুষ্ঠানিক সফরে রিয়াদ আর আঙ্কারাকে বেছে নিয়েছেন। এই সফরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি বার্তা দিয়েছেন যে, দামেস্ক এখন আর তেহরানের বলয়ের মধ্যে নেই।
রিয়াদে আল-শারার সফরের মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে, সিরিয়ার নতুন সরকার উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। এমনকি রিয়াদ সফরের আগেও আল-শারা সৌদি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি রিয়াদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা, বিশেষ করে ‘ভিশন ২০৩০’-এর ব্যাপারে সমর্থন জানিয়েছেন। সিরিয়ার পুনর্গঠনে সৌদি আরব যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাও উল্লেখ করেছেন আল-শারা।
রিয়াদের সঙ্গে আল-শারার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাদ দিলেও সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য যে সহায়তা দরকার, সেটার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দামেস্ক-রিয়াদের শক্তিশালী সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু রিয়াদ নয়, বরং সিরিয়ার পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার ব্যাপারে দোহাও গভীর আগ্রহ জানিয়েছে।
আল-শারা নিজে যদিও প্রথম সফরে রিয়াদ গেছেন, কিন্তু বাইরের কোনো দেশের প্রধান হিসেবে প্রথম দামেস্ক সফর করেছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। এই সফরই বলে দেয় সিরিয়ার ভবিষ্যতের প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায় কাতার। ফলে আল-শারাসহ দামেস্কের নেতারা এখন উপসাগরীয় অঞ্চলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা আশা করছেন, এই দেশগুলো একটা সমন্বিত বহুপক্ষীয় সিরিয়া কৌশল গ্রহণ করবে, যেটা রাজনৈতিকভাবে ইরানের প্রভাব কমিয়ে আনবে, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ত্বরান্বিত করবে এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
এটা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতেই মূলত আল-শারা আর সিরিয়ার নতুন নেতারা উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করছেন। তবে উপসাগরীয় দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে এই সম্পর্কের ব্যাপ্তি আরো বড়। দামেস্ক পুনর্গঠনের বাইরেও তারা বৈরুত-দামেস্ক অক্ষ এবং এর ব্যবস্থাপনার কথা ভাবছে, যেটাকে তারা ইরানবিরোধী ব্লক হিসেবে দাঁড় করাতে চায়।
২০১৯ সালের জুনে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপর ২০২৩ সালের মার্চে সৌদি আরবও একই পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু ইরান এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ৭ অক্টোবরের পর থেকে তাদের ব্যাপারে আগাম কিছু বলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এজন্য ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক যদিও স্বাভাবিকভাবে জারি রাখবে উপসাগরীয় দেশগুলো, কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কৌশলগত জায়গা থেকে ইরানের প্রভাব হ্রাসের বিষয়টিকে তারা স্বাগত জানাবে।
এসব ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে আসাদ সরকারের পতনের কারণে দামেস্কে তেহরানের প্রভাব বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এদিকে ৭ অক্টোবরের পর থেকে তাদের প্রক্সি গ্রুপগুলোর রাজনৈতিক, সামরিক ও আভিযানিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরান হিজবুল্লাহকে যে অস্ত্র সরঞ্জাম সরবরাহ করত, সেটাও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে হিজবুল্লাহর আভিযানিক শক্তি বেশ খানিকটা কমে গেছে এবং লেবাননের ওপর তেহরান তাদের প্রভাব ধরে রাখতে পারছে না।
এই পরিস্থিতিতে উপসাগরীয় দেশগুলো এখন সরাসরি বৈরুতের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। জোসেফ আউন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই শহরের সঙ্গে সম্পর্কের একটা নতুন দরজা খুলতে চাচ্ছেন তারা। রিয়াদ ও দোহা সম্প্রতি তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মাধ্যমে লেবাননের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ আরো বাড়িয়েছে। দোহার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন, তিনি বৈরুতের পুনর্গঠনের ব্যপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। সিরিয়ার পুনর্গঠনের ব্যপারেও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কাতার।
ইরান-ইসরাইল উত্তেজনার প্রভাব এখন উপসাগরীয় অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে দামেস্ক-বৈরুত অক্ষে তেহরানের প্রভাবও আর আগের মতো নেই। উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য এখানে সংকট ও সুযোগ দুটোই হাজির হয়েছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্প আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার ব্যপারে যে আইন-বহির্ভূত ও ইতিহাস-বিমুখ পরিকল্পনা নিয়েছেন, সেটা হবে উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ। এই প্রস্তাব এতটাই কট্টর ও অবাস্তব যে, অধিকাংশ আঞ্চলিক দেশ তাৎক্ষণিকভাবে সেটাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আর উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে গাজা পুনর্গঠনের প্রশ্নে যে আলোচনা হবে, সেখানে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতের ইস্যুটিই মূলত প্রাধান্য পাবে। উপসাগরীয় দেশগুলো গাজার অধিবাসীদের সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কঠোর বিরোধিতা করেছে এবং ওয়াশিংটনকে তারা তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।
পরিবর্তিত আঞ্চলিক পরিস্থিতি একই সঙ্গে উপসাগরীয় ভূরাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির জন্য নতুন সুযোগও নিয়ে এসেছে। তেহরানের প্রভাব কমে যাওয়ায় দামেস্ক ও বৈরুতের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলোর ভূমিকা অনেকটাই বেড়ে গেছে।
তবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইল যেসব কট্টর নীতি গ্রহণ করেছে, তার মোকাবিলায় উপসাগরীয় দেশগুলোকে হয়তো গালফ কোঅপারেশান কাউন্সিল বা জিসিসির গৃহীত পদক্ষেপ এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলোকে হয়তো আরো স্বাধীন ও আগ্রাসী কৌশল গ্রহণের দিকে যেতে হবে।
অদূর ভবিষ্যতে দামেস্ক, বৈরুত ও গাজার পুনর্গঠনের ইস্যুগুলো উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠবে। এজন্য তাদের বড় ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
এই ইস্যুগুলোকে কেন্দ্র করে আগামীতে একটা অভিন্ন ধারা দেখা যেতে পারে। সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরাইল এসব ইস্যুতে কট্টর সব প্রস্তাব হাজির করতে পারে। ধারণা করা যায়, এর মোকাবিলায় উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের আঞ্চলিক পদক্ষেপের ব্যাপ্তি আরো বাড়াবে। শুধু গাজাকেন্দ্রিক নয়, বরং দামেস্ক আর বৈরুতের ব্যপারেও তারা সক্রিয় হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই প্রচেষ্টাগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার ব্যাপারে তারা নেতৃত্ব দেবে। এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র যেভাবে বদলে যাচ্ছে, এই নেতৃত্বের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় পক্ষ হিসেবে হাজির হবে।
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৬ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৭ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৭ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে