সৌন্দর্য, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের নির্মাণ

ফাতিমা তামান্না
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১২: ৫৯
ফাতিমা তামান্না

‘সৌন্দর্য’ অত্যন্ত ছোট্ট একটা শব্দ অথচ এর শক্তি অভাবনীয়। দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আজও ফরসা হওয়াকে সুন্দর, সফল এবং আধুনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি, এই যে সুন্দর; কীভাবে এলো এর মানদণ্ড? কে ঠিক করল সুন্দরের সংজ্ঞা।

বিজ্ঞাপন

সৌন্দর্য একটি মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক নির্মাণ। মানুষ যে সুন্দরকে জানে, তার মধ্য দিয়ে সে যেমন নিজেকে দেখে, ঠিক তেমনি অন্যকেও বিচার করে। ফলে সৌন্দর্য হয়ে ওঠে একটি ক্ষমতার অস্ত্র। এই সৌন্দর্য ধারণ করে আছে অনেক ইতিহাস, রাজনীতি এবং ঔপনিবেশিক প্রভাব।

ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী শুধু আমাদের ভূমি বা সম্পদ কেড়ে নেয়নি, তারা আমাদের সংস্কৃতি, রুচি, এমনকি শরীরের ওপরও আধিপত্য বিস্তার করেছে। ঔপনিবেশিক শাসকরা আমাদের মধ্যে যে ফরসা গায়ের রঙকে উন্নত, আধুনিক এবং সফল হিসেবে আরোপ করেছিল, সেই ধারণা আজও আমাদের মনের গভীরে প্রজ্বালিত হয়ে আছে।

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা নিজেদের গায়ের রঙ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তারা সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় ত্বক ফরসাকারী প্রসাধনী ব্যবহার করেন। কিন্তু তারা জানতেই পারেন না, কী ভয়ানক ক্ষতির দিকে ছুটছেন। গবেষকরা পরীক্ষা করে বেশিরভাগ ত্বক ফরসা করার ক্রিমে পারদের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন। এসব ক্রিম অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন পেরিফেরাল দৃষ্টিশক্তি হারানোর আশঙ্কা থাকে, তেমনি কিডনির ক্ষতি এবং মানসিক সমস্যার কারণও হতে পারে।

সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা গেছে, ৬৫ বছর বয়সি এক কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান নারী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হাসপাতালে যাওয়ার দুই মাসের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করা প্রসাধনীই তার মৃত্যুর কারণ।

চিকিৎসকদের মতে, ত্বক ফরসাকারী ক্রিম ও লোশনের সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা এসব প্রসাধনী কঠোর নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানিয়েছেন।

বিষয়টি শুনে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এ তো শুধু একটি ঘটনা, প্রতিদিন আমাদের এমন অনেক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এরপর রয়েছে বিজ্ঞাপন সংস্থার চটকদার অনুপ্রেরণামূলক প্রচার। রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার রূপসাগরের হাতছানি। সব মিলিয়ে মানুষ এক দুর্বিষহ পরিণতির দিকে ছুটছে।

সুন্দরের প্রতিযোগিতায় কারো সংসারে আগুন জ্বলছে। বাড়ছে পরকীয়া ও ব্যভিচার। ঔপনিবেশিক বুদ্ধির তাড়নায় নিজেকে আরো উন্নত, আরো সুশীল বলে স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় দিশাহারা হয়ে পড়ছেন সুন্দরের প্রত্যাশীরা।

এ ঘটনা আমাদের বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে সৌন্দর্যের বিষ সমাজে ছড়াচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে রঙ ফরসাকারী বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আফ্রিকায় গড়ে উঠেছে কোটি কোটি টাকার ত্বক ফরসাকারী পণ্যের বাজার। সুন্দর হওয়ার আশায় একদিকে এসব পণ্যের পেছনে ঘুরে আমরা হারাচ্ছি সময়, অর্থ, এমনকি জীবন। আবার অন্যদিকে এমন ভাবনার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা নিজেদের আসল রূপকেই অস্বীকার করছি। এমনকি হারিয়ে ফেলছি সত্যিকার নিজেকে।

প্রকৃত বিবেচনায় সৌন্দর্য কী? সৌন্দর্য কি শুধুই চোখে দেখার বিষয়? সৌন্দর্য হচ্ছে নিজের পরিচয়, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা আর মানসিক স্বস্তি।

সৌন্দর্যের সামাজিক মানের কারণে যদি কেউ হতাশাগ্রস্ত এবং নিজেকে তুচ্ছ মনে করেন, তবে আমাদের অবশ্যই এই সংজ্ঞা পুনর্গঠন করতে হবে। যে সৌন্দর্যে থাকবে আত্মমর্যাদা ও সুস্থতার প্রতিচ্ছবি।

এমন এক সমাজ হতে হবে, যেখানে কে ফরসা আর কে কালো; এই হিসাব দিয়ে নয়, বরং মানুষের ভেতরের গুণ দিয়েই সৌন্দর্য মাপা হবে। সৌন্দর্যের মানদণ্ড হবে হৃদয়ের গভীরতা।

আফ্রিকান নারীর মৃত্যু এক দীর্ঘ ঔপনিবেশিক বিষ প্রয়োগের প্রতীক। সৌন্দর্যের নামে চাপিয়ে দেওয়া ঔপনিবেশিক চিন্তা কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা দেখা গেছে এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এই সৌন্দর্যবোধের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি। সময় এসেছে নিজেকে ভালোবাসার, নিজের প্রকৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করার।

লেখক : সাংবাদিক, কবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত