আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

হাদি: একটি অসমাপ্ত রাষ্ট্রচিন্তার নাম

সরদার ফরিদ আহমদ

হাদি: একটি অসমাপ্ত রাষ্ট্রচিন্তার নাম

কিছু মৃত্যু শুধু মৃত্যু নয়। কিছু মৃত্যু রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শরীফ ওসমান হাদি তেমনই এক নাম।

আজ একজন জুলাই যোদ্ধা নিভে গেলেন। নিভে গেল এমন এক কণ্ঠ, যে কণ্ঠ নীরব থাকলে সুবিধা হতো অনেকের।

বিজ্ঞাপন

হাদি ছিলেন অস্বস্তিকর। কারণ তিনি প্রশ্ন করতেন। তিনি মাথা নত করেননি। তিনি আপসকে রাজনীতি ভাবেননি। রাষ্ট্রকে ভাবতেন, ক্ষমতাকে নয়। হাদির রাজনীতি ছিল রাষ্ট্রচিন্তার রাজনীতি। ক্ষমতায় যাওয়ার তাড়না নয়, রাষ্ট্রকে উদ্ধার করার দায়বদ্ধতা।

তিনি বিশ্বাস করতেন-রাষ্ট্র মানে শুধু সংবিধানের পৃষ্ঠা নয়,রাষ্ট্র মানে মানুষের মর্যাদা। রাষ্ট্র মানে ভোটের অধিকার। রাষ্ট্র মানে কথা বলার সাহস।

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় হাদি শুধু রাস্তায় ছিলেন না, তিনি ছিলেন চিন্তায়, বক্তব্যে, সংগঠনে। তিনি বলতেন,‘ফ্যাসিজম শুধু একটি দল নয়,ফ্যাসিজম একটি মানসিকতা।’

এই মানসিকতার বিরুদ্ধেই ছিল তার যুদ্ধ।

হাদি কখনো ধোঁয়াশায় কথা বলেননি। তিনি ফ্যাসিস্টকে ফ্যাসিস্ট বলতেন। নাম ধরে বলতেন। দল ধরে বলতেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারকে চিহ্নিত করতেন। এ কারণেই তিনি টার্গেট ছিলেন। এ কারণেই তাকে গুলি করা হয়েছিল। এ কারণেই তার জীবন নিরাপদ ছিল না। তিনি জানতেন ঝুঁকি আছে। তবু পিছিয়ে যাননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন-

ভয়কে জয় না করলে, রাষ্ট্রকে বাঁচানো যায় না।

রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ হাদির রাজনীতি ছিল সার্বভৌমত্বের রাজনীতি। তিনি শুধু দেশের ভেতরের ফ্যাসিজম নয়, বাইরের রাজনৈতিক আধিপত্যকেও প্রশ্ন করতেন। তিনি স্পষ্ট করে বলতেন-বাংলাদেশ কোনো প্রটেক্টোরেট নয়। এই রাষ্ট্র কারো করুণা নয়। এই রাষ্ট্র রক্ত দিয়ে কেনা। তার এই অবস্থান অনেকের পছন্দ হয়নি। অনেকে তাকে ‘অতিরিক্ত স্পষ্ট’ বলেছে। কিন্তু হাদি জানতেন-আধিপত্যবাদের সঙ্গে আপস মানেই ভবিষ্যতের সঙ্গে প্রতারণা।

হাদির লড়াই শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সংস্কৃতির প্রশ্নেও ছিলেন সচেতন। তিনি বলতেন-সংস্কৃতি দিয়ে যখন জাতিকে দুর্বল করা হয়, তখন রাজনৈতিক দখল সহজ হয়ে যায়। তিনি তরুণদের নিয়ে কথা বলতেন। ভাষা নিয়ে বলতেন। ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে বলতেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন-সংস্কৃতির স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা টেকে না। এ কারণেই তিনি শুধু মিছিলের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন আলোচনার মানুষ। বক্তৃতার মানুষ। লেখার মানুষ।

হাদি ছিলেন তরুণদের মানুষ। কারণ তিনি তাদের ভাষায় কথা বলতেন। তাদের হতাশাকে অস্বীকার করতেন না। তিনি তরুণদের বলতেন-তোমরা শুধু পোস্ট দিও না,দায়িত্ব নাও। এই কথাটা তরুণরা বিশ্বাস করেছিল। কারণ হাদি নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি ভাঙেননি। তিনি চুপ হননি। তিনি বার্তা দিয়েছিলেন- লড়াই থেমে নেই। এই সাহস তরুণদের স্পর্শ করেছিল।

বয়োজ্যেষ্ঠদের আস্থা হাদি শুধু তরুণদের নন, বয়োজ্যেষ্ঠদেরও আপন ছিলেন। কারণ তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি ইতিহাস অস্বীকার করতেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিকে ধারণ করতেন, কিন্তু বিকৃত মুক্তিযুদ্ধকে নয়। বয়োজ্যেষ্ঠরা দেখেছেন- এই তরুণটি দায়িত্বজ্ঞানহীন নয়। এই তরুণটি হঠকারী নয়। এই তরুণটি রাষ্ট্র বোঝে। এই আস্থাই তাকে আলাদা করেছিল।

ঢাকা-৮ আসনে হাদি শুধু প্রার্থী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সম্ভাবনার প্রতীক। একটি ভিন্নধারার রাজনীতির ইঙ্গিত। একটি সাহসী রাজনীতির আশ্বাস। তার চলে যাওয়া মানে একটি আসন শূন্য হওয়া নয়, একটি স্বপ্ন থমকে যাওয়া। কিন্তু ইতিহাস বলে- স্বপ্ন কখনো একজনের সঙ্গে মরে না।

এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। এই মৃত্যু রাষ্ট্রকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। একজন জুলাই যোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। সেখানেই জীবন-মৃত্যুর লড়াই করেন। রাষ্ট্র কোথায় ছিল? নিরাপত্তা কোথায় ছিল? দায় কার? এই প্রশ্নগুলো অস্বস্তিকর। কিন্তু এড়ানো যাবে না। কারণ হাদি একা নন। হাদির পরেও অন্যরা আছে।

৫ আগস্টের পর সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দলগুলো কোথায়? তারা হাদির ব্যাপারে নীরব কেন। তারা হাদিকে কেন চেনেন না? ইনকিলাব মঞ্চের নাম কেন জানেন না? কারা হাদিকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করেছে? কেন করেছে? এসব প্রশ্ন উঠবে। উঠতেই থাকবে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এদেশে তাদের রাজনীতি আর সম্ভব নয়।

কারা আধিপত্যের পক্ষে, কারা বিপক্ষে-সবাই জেনে গেছে। আধিপত্যবাদের দলদাস কারা হতে চায়, কেন হতে চায়- মানুষ সব জেনে গেছে। বাংলাদেশপন্থার বাইরে আর কোনো রাজনীতি চলবে না। হাদি এটা আমাদের শিখিয়ে গেছে। হাদি বাংলাদেশপন্থার মাপকাঠি। এর বাইরে আর রাজনীতি হবে না। রেড লাইন। যে অতিক্রম করবে, সেই-ই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।

জীবনকে দায়িত্ব, ধর্মকে বিবেক, মৃত্যুকে ভয় না করার শিক্ষা

শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন সরল। কিন্তু সহজ নন। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি জীবনকে ভোগ নয়-দায়িত্ব হিসেবে দেখেছেন। তার রাজনীতি সুবিধার ছিল না। ছিল ঝুঁকির। হাদি বিশ্বাস করতেন, চুপ থাকা কখনো নিরপেক্ষতা নয়। চুপ থাকা অনেক সময় অপরাধ। তিনি বলেতেন, ‘জীবন মানে শুধু বেঁচে থাকা না। মাথা উঁচু করে বাঁচাই জীবন।’ এই একটি বাক্যেই ধরা পড়ে তার জীবনদর্শন। তিনি নিরাপদ রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না।

তিনি বলতেন,‘নিরাপদ রাজনীতি মানে সুবিধাভোগীদের রাজনীতি।’এই কারণেই তিনি অস্বস্তিকর ছিলেন। এই কারণেই তিনি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন।

হাদির কাছে রাষ্ট্র ছিল ক্ষমতার কাঠামো নয়। রাষ্ট্র ছিল নৈতিকতার প্রশ্ন। তিনি স্পষ্ট করে বলতেন,‘রাষ্ট্র যদি নাগরিকের মর্যাদা না দেয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করাই নাগরিকের দায়িত্ব।’ এই কথার মধ্যেই ছিল তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তিনি ভয়কে রাজনীতির ভাষা হতে দেননি। তিনি বলতন, ‘ভয়কে যদি রাজনীতির ভিত্তি বানানো হয়, তাহলে রাষ্ট্র একদিন জেলখানা হয়ে যায়।’

হাদি জানতেন,ভয় ছড়িয়ে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে, কিন্তু সম্মান নিয়ে টিকে থাকতে পারে না।

হাদি বলেছেন, ‘আগামী ৫০ বছর বাঁচলাম কোন ইমপ্যাক্ট তৈরি হলো না আমারে দিয়ে। দেশের জন্য রাষ্ট্রের জন্য উম্মার জন্য। কিন্তু ধরেন আমি পাঁচ বছর বাঁচলাম সেটার মধ্যে দিয়ে যদি আগামী ৫০ বছরের ইম্প্যাক্ট তৈরি হয় তাহলে অনেকদিন বেঁচে থাকায় কি সাফল্য বলেন? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কয়টা দিন বেচেছেন। কিন্তু ভাবেন আজকে পর্যন্ত উনি আমার অনুপ্রেরণা। হাঁটতে হাঁটতে আমার পা ফুলে যায়। আমি আমার টিম সেদিন ব্যাগের মধ্যে জুতা নিয়ে তারপরে একটা শপিং মলে ঘুরছিলাম। পা ফুলে গেছে ,পা জুতার ঢুকাতে পারছিলাম না। জিয়াউর রহমানের একটা গল্প মনে পড়ছিল। ওনি যখন মাইলকে মাইল হাঁটতেন ওনার সাথে স্টাফদের পা ফুলে যেতো। কিন্তু ওনার তো আর্মি ট্রেনিং আছে। ওনার স্টাফরা বলেন, আমরা তো আর পারি না। এ জন্য ওনাকে মানুষ রাখাল রাজা বলতো। আমরাও সারা বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে হাটতে চাই। আমরা ইনসাফের চাষাবাদ করতে চাই। একটা স্বাধীন সার্বভৌমত্বের সততার বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই।’

‘ইনসাফের চাষাবাদ’-কি অসাধারণ ভাবনা, পংক্তি। এই কাজটিই করতে চেয়েছেন হাদি। এটাই হাদি। ‘স্বাধীন সার্বভৌমত্বের সততার বাংলাদেশ’- কি তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী কণ্ঠস্বর!

আলোচনা হচ্ছে হাদির ধর্মচিন্তা নিয়েও । হাদির ধর্মচিন্তা ছিল গভীর, কিন্তু প্রদর্শনমূলক নয়। তিনি ধর্মকে কখনো ক্ষমতার হাতিয়ার করেননি। তিনি বলতেন,‘ধর্ম আমার কাছে ক্ষমতার হাতিয়ার না। ধর্ম আমার কাছে বিবেকের জায়গা।’ তার কাছে ধর্ম মানে ছিল অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো। বলতেন, ‘যে ধর্ম অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়, সে ধর্ম নয়-সে ব্যবহার।’ এই বক্তব্য তাকে আলাদা করেছে। কারণ তিনি ধর্ম দিয়ে রাজনীতি করেননি। রাজনীতি দিয়ে ধর্মকেও বিক্রি করেননি।

তিনি বলতেন,‘আল্লাহ অন্যায়ের সঙ্গে নেই-এই বিশ্বাসটাই আমার রাজনীতি।’ এটা কোনো স্লোগান ছিল না। এটা ছিল তার নৈতিক অবস্থান।

হাদি মৃত্যুকে রোমান্টিক করেননি। কিন্তু ভয়ও পাননি। তিনি বলতেন, ‘মৃত্যুকে ভয় পাই না। ভয় পাই যদি বেঁচে থেকেও চুপ থাকতে হয়।’তিনি একবার বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে না, আসমানে হয়। আমি চলে গেলে আমার সন্তান লড়বে। তার সন্তান লড়বে। যুগ হতে যুগান্তরে আজাদের সন্তানেরা স্বাধীনতা পতাকার সমুন্নত রাখবেই। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা তো শাহাদাতের জন্যই মায়ের উদর হতে পৃথিবীতে পা দিয়ে রেখেছি।’

এই কথায় তার সাহসের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি জানতেন-সত্য বললে মৃত্যু আসতে পারে।‘আমি যদি মারা যাই, প্রশ্নগুলো যেন বেঁচে থাকে’-এটা আত্মত্যাগের ঘোষণা নয়। এটা দায়িত্বের স্মরণ।

শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন জীবনের প্রশ্নে দায়িত্বশীল, ধর্মের প্রশ্নে বিবেকবান, আর মৃত্যুর প্রশ্নে ভয়হীন। তার মৃত্যু আমাদের আবেগী করে তোলে। কিন্তু তিনি আবেগ চাননি। তিনি চেয়েছিলেন- মানুষ প্রশ্ন করুক। ভয় না পাক। চুপ না থাকে। হাদি আজ নেই। কিন্তু তার কথাগুলো রয়ে গেছে।

হাদি ছিলেন জুলাই যোদ্ধা। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ানো এক নাম। তিনি ছিলেন ভয় না পাওয়ার শিক্ষা। তিনি থাকবেন- তার কথায়,তার সাহসে, তার অসমাপ্ত রাষ্ট্রচিন্তায়।

হাদিদের মতো মানুষ মারা গেলে ক্ষতি হয়। কিন্তু হাদিদের ভাবনা মরে না। বরং আরও ধারালো হয়। কারণ কিছু মৃত্যু রাষ্ট্রকে ঘুমাতে দেয় না।

আসলে কিছু মানুষ মরে না। তারা রাষ্ট্রের বিবেকে পরিণত হয়। শরীফ ওসমান হাদি সেই বিরল নামগুলোর একটি। হাদির মতো মানুষ প্রশ্ন ও প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকে। শরীফ ওসমান হাদি-তুমি তেমনই একটি প্রশ্ন ও প্রেরণা।

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন