বদরুদ্দীন উমর
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়ন ও তার সরকারের পতনের পর দেশে প্রশাসনের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। এই শূন্যতা পূরণ হয়েছিল জরুরি ভিত্তিতে বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার একটানা পনেরো বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকে সামগ্রিকভাবে দেশের প্রশাসন, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করেছিল।
এ অবস্থায় সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থান ফিরিয়ে আনা দাঁড়িয়েছিল যেকোনো সরকারের পক্ষে এক পর্বতসমান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে বর্তমান সরকার প্রাথমিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল, যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম না হলেও অনেকখানি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পেরেছিল। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনকারী ছাত্র এবং ব্যাপক জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পাঁচমিশালি লোক নিয়ে গঠিত বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের অবস্থান যে দুর্বল থাকবে, এটা স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে এই সরকারের অনেক দুর্বল দিক আছে। এই দুর্বলতার সব থেকে বড় দিক হলো, বিগত সরকারের আমলে যারা দেশে এই সর্বাত্মক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তাদের তৎপরতা বন্ধ করা ও নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা। এটা ঠিক যে, এই বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শেখ হাসিনা।
কিন্তু তার পক্ষে তো একা ও বিচ্ছিন্নভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল না। তার এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের দলের, প্রশাসনের ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হাজার হাজার লোক। শেখ হাসিনা ও তার লোকজন অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের অধিকাংশ লোকই আছে এবং ঘাপটি মেরে থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় নিযুক্ত আছে।
বিশেষ করে দেশের সব থেকে শক্তিশালী অংশ ব্যবসায়ী শ্রেণি এখনও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান বজায় রেখেছে। তারা এখনও প্রশাসন বা অর্থনীতির প্রত্যেক ক্ষেত্রে এমনভাবে তৎপর রয়েছে, যাতে বর্তমান সরকার তাদের উপেক্ষা করতে বা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারছে না। এরই প্রতিফলন এখন সরকারের নানা নীতি ও কার্যক্রমের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
দেশে বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি চলছে তাকে অপশক্তির তৎপরতা ও চাপ মেনে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সময় নেই। এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা অনেক কথা বললেও কেন এই পরিস্থিতি বজায় আছে এবং কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করছে, এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এর কারণ বোঝাও কঠিন নয়। আসলে এর কারণ তারাও মৌলিক অর্থে কোনো না কোনোভাবে এই শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্রেণিগতভাবে তারাও এদেরই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্রে আবদ্ধ। তারাও এদেরই শ্রেণিভাই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ডিসেম্বরে গড় মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা শতকরা ১০ দশমিক ৮৯ ভাগের কথা বললেও বাস্তবে সাধারণ মানুষ বাজারে দেখছেন ২০ শতাংশের বেশি। বিবিএস বলছে, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা শতকরা ১২ দশমিক ৯২ ভাগ। কিন্তু বাস্তবে তার থেকেও অনেক বেশি। শ্রমজীবী গরিবদের ওপর এই মূল্যবৃদ্ধির চাপ অসহনীয়।
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির মাত্রা অভ্যুত্থানের পর সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যবসায়ে চাঁদাবাজি চলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। নানা যোগসূত্রে আবদ্ধ থেকে মাস্তানরা চাঁদাবাজি করছে। এ ক্ষেত্রে অথর্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারছে না।
এই মূল্যস্ফীতির মুখে সরকার একশ রকম দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি করেছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফ বাংলাদেশের মতো দেশকে ঋণ দিয়ে থাকে এবং এই ঋণের সুবাদে তারা সব সময়ই দ্রব্যমূল্য ও কর বৃদ্ধির জন্য চাপ দেয়। এখন বাংলাদেশের ওপরও তারা এই চাপ ভালোভাবেই দিচ্ছে।
এই চাপ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সরকারের নেই। এর মূল্যবৃদ্ধি নয়, কর বৃদ্ধির জন্য চাপ তার থেকেও বেশি। তারা বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন বা ৪৭০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে বাংলাদেশকে কর বৃদ্ধি করে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ২০২৫-২৬ সালে বাড়াতে হবে শতকরা শূন্য দশমিক ২ ভাগ। এর জন্য দেশকে অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। এটা বলাইবাহুল্য যে, এ সকল দ্রব্যের ওপর ও সেবা খাতে কর বৃদ্ধি সাধারণভাবে অন্যান্য দ্রব্যেরও মূল্যবৃদ্ধি করবে।
সরকারের বক্তব্য, যেসব দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো সাধারণ দোকানের ভোগ্য নয়। কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক নয়। কাপড়ের ওপর ৭ দশমিক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ যে কর বৃদ্ধি হয়েছে, সেটা সাধারণ লোককে আঘাত করবে। মিষ্টির ওপর যে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেখানেও আঘাত আছে। কারণ সাধারণ মানুষ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে এবং নিজেদের ভোগের জন্য মিষ্টি কিনে থাকে।
রেস্তোরাঁর খাবারের ভ্যাট বাড়িয়ে ৫ থেকে করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। এটা অবশ্যই সাধারণ লোককে আঘাত করবে। কারণ ব্যাপকসংখ্যক মানুষ রেস্তোরাঁয় খেয়ে থাকেন। শুকনো ফলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে আকস্মিকভাবে। নানা খাদ্য তৈরিতে শুকনো ফল ব্যবহার করা হয়। এসব খাদ্যের মধ্যে রয়েছে বিস্কুট, পায়েস, ফিরনি ইত্যাদি মিষ্টি, যা অতিথিসেবা ও বিয়ে ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে সাধারণ লোককে কিনতে হয়।
ভ্যাট হচ্ছে পরোক্ষ কর। এই করের ভার ধনীদের তেমন আঘাত না করলেও সাধারণ লোকের ওপর এর প্রভাব পড়ে। তাদের আয় কম এবং এই আয়ের একটা অংশ কর বৃদ্ধির জন্য দেওয়ায় তাদের প্রকৃত মজুরি বা আয় কমে আসে। যেভাবে ১০০ দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই বৃদ্ধি যে শুধু এই দ্রব্যগুলোর ক্ষেত্রে ঘটবে, তা নয়। এর প্রভাব প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রেও ঘটতে বাধ্য। এটাই অর্থনৈতিক নিয়ম। প্রত্যেক পরোক্ষ কর সব দিক দিয়ে গরিব এবং অল্প আয়ের মানুষের জীবিকার মান কমিয়ে আনে।
সরকারের আয় বৃদ্ধির জন্য পরোক্ষ করই একমাত্র ব্যাপার নয়। প্রত্যক্ষ কর (direct tax) এর অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই কর আয়ের ওপর ধার্য করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে দেশে ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে কম, শতকরা মাত্র ৮। ভারতে এই অনুপাত শতকরা ১২, নেপালে ১৭, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ১১ এবং দুনিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল অন্য দেশে ২৫।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি অবশ্যই দরকার। কিন্তু এর জন্য প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে পরোক্ষ করের আশ্রয় তারাই নিতে পারে, যারা জনগণের প্রতিনিধি নয়, ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি। বাংলাদেশে এত দিন এটাই হয়ে এসেছে এবং বর্তমান সরকার যেভাবে আয় বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ কর ধার্যের পরিবর্তে পরোক্ষ করের আশ্রয় নিয়েছে, তার মধ্যেই এদের আসল চরিত্র ধরা পড়ছে।
বড় বড় মিল কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীর ওপর কর অশ্লীলভাবে কম। তাদের প্রতি প্রত্যেকটি সরকারই খুব সদয়। তাদের ওপর ধার্য করের পরিমাণ সামান্য। তারা কর ফাঁকিও দেয়, তা ছাড়া বড় কারখানার মালিকদের কর রেয়াত দেওয়া হয়। এভাবে ধনীদের রেয়াত দিয়ে সাধারণ শ্রমজীবী ও গরিদের রক্ত শোষণ করেই সরকারের ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে।
১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যবসায়ী শ্রেণি নিজেদের শক্তিশালী ও সংযত করে দেশের শাসকশ্রেণি হিসেবে অর্থনীতি ও রাজনীতি থেকে নিজেদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছে। বিগত জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে পূর্ব অবস্থাতেই বজায় আছে।
হাজার হাজার মানুষের জীবনদান নয়, শারীরিক ও অন্যান্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর অভ্যুত্থানকারী ছাত্র, জনগণসহ সবাই আশা করেছিলেন এদিক দিয়ে পরিবর্তন হবে। ছাত্র অভ্যুত্থানের পরবর্তী পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার যে আশার আলো সামান্য দেখালেও এখন তারা যেভাবে নানা নীতিনির্ধারণ করছেন, তাতে এর উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, এত দিন এই সরকার যেভাবে ট্রাকে করে অল্প দামে কয়েকটি জিনিস অল্প আয়ের মানুষের কাছে দিয়ে আসছিল, সেটাও এখন বন্ধ হয়েছে। জিনিসপত্রের অবাধ মূল্যবৃদ্ধি ও কর আরোপের সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে খুব বিস্ময়কর।
কিন্তু এই বিস্ময়কর ব্যাপারটি এখন ঘটছে। বর্তমান সরকার যেভাবে তার প্রাথমিক অবস্থান থেকে দ্রুত সরে আসছে, তাতে তাদের জনপ্রিয়তা যে আর কিছুদিনের মধ্যে বড় আকারে কমে আসবে, তাতে সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় এ সরকার অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকার কোনো যৌক্তিক দাবি অথবা জনগণের জন্য তার কোনো প্রয়োজনীয়তা আর নেই। এরা এখন দ্রুতগতিতে দেশের শাসকশ্রেণি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করতে শুরু করায় জুলাই অভ্যুত্থানের মূল্যবোধ ও চরিত্রকে এরা শিকেয় তুলেছে। শুধু কর আরোপের ক্ষেত্রে নয়, অন্য অনেক ক্ষেত্রেও এটা দেখা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতির পরিবর্তন যথা শিগগিরই দরকার। এর জন্য আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার জন্য যা কিছু করা দরকার, সেসব কাজ সম্পন্ন করে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কাছে হস্তান্তর করা দরকার।
অবশ্য সেভাবে নির্বাচিত সরকারও যে বর্তমান শাসকশ্রেণি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রভাবমুক্ত হয়ে দেশের লোকের জন্য দুধ-ভাতের ব্যবস্থা করবে, এটা আশা করারও কিছু নেই এবং এভাবে একটি অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় না থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেবে—এই বিষয়টি এখন জরুরি হয়ে গেছে। এর জন্য সরকারের দরকার এই মুহূর্তে আগামী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা।
এমবি
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়ন ও তার সরকারের পতনের পর দেশে প্রশাসনের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। এই শূন্যতা পূরণ হয়েছিল জরুরি ভিত্তিতে বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার একটানা পনেরো বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকে সামগ্রিকভাবে দেশের প্রশাসন, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করেছিল।
এ অবস্থায় সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থান ফিরিয়ে আনা দাঁড়িয়েছিল যেকোনো সরকারের পক্ষে এক পর্বতসমান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে বর্তমান সরকার প্রাথমিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল, যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম না হলেও অনেকখানি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পেরেছিল। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনকারী ছাত্র এবং ব্যাপক জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পাঁচমিশালি লোক নিয়ে গঠিত বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের অবস্থান যে দুর্বল থাকবে, এটা স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে এই সরকারের অনেক দুর্বল দিক আছে। এই দুর্বলতার সব থেকে বড় দিক হলো, বিগত সরকারের আমলে যারা দেশে এই সর্বাত্মক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তাদের তৎপরতা বন্ধ করা ও নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা। এটা ঠিক যে, এই বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শেখ হাসিনা।
কিন্তু তার পক্ষে তো একা ও বিচ্ছিন্নভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল না। তার এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের দলের, প্রশাসনের ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হাজার হাজার লোক। শেখ হাসিনা ও তার লোকজন অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের অধিকাংশ লোকই আছে এবং ঘাপটি মেরে থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় নিযুক্ত আছে।
বিশেষ করে দেশের সব থেকে শক্তিশালী অংশ ব্যবসায়ী শ্রেণি এখনও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান বজায় রেখেছে। তারা এখনও প্রশাসন বা অর্থনীতির প্রত্যেক ক্ষেত্রে এমনভাবে তৎপর রয়েছে, যাতে বর্তমান সরকার তাদের উপেক্ষা করতে বা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারছে না। এরই প্রতিফলন এখন সরকারের নানা নীতি ও কার্যক্রমের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
দেশে বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি চলছে তাকে অপশক্তির তৎপরতা ও চাপ মেনে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সময় নেই। এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা অনেক কথা বললেও কেন এই পরিস্থিতি বজায় আছে এবং কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করছে, এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এর কারণ বোঝাও কঠিন নয়। আসলে এর কারণ তারাও মৌলিক অর্থে কোনো না কোনোভাবে এই শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্রেণিগতভাবে তারাও এদেরই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্রে আবদ্ধ। তারাও এদেরই শ্রেণিভাই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ডিসেম্বরে গড় মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা শতকরা ১০ দশমিক ৮৯ ভাগের কথা বললেও বাস্তবে সাধারণ মানুষ বাজারে দেখছেন ২০ শতাংশের বেশি। বিবিএস বলছে, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা শতকরা ১২ দশমিক ৯২ ভাগ। কিন্তু বাস্তবে তার থেকেও অনেক বেশি। শ্রমজীবী গরিবদের ওপর এই মূল্যবৃদ্ধির চাপ অসহনীয়।
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির মাত্রা অভ্যুত্থানের পর সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যবসায়ে চাঁদাবাজি চলছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। নানা যোগসূত্রে আবদ্ধ থেকে মাস্তানরা চাঁদাবাজি করছে। এ ক্ষেত্রে অথর্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারছে না।
এই মূল্যস্ফীতির মুখে সরকার একশ রকম দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি করেছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফ বাংলাদেশের মতো দেশকে ঋণ দিয়ে থাকে এবং এই ঋণের সুবাদে তারা সব সময়ই দ্রব্যমূল্য ও কর বৃদ্ধির জন্য চাপ দেয়। এখন বাংলাদেশের ওপরও তারা এই চাপ ভালোভাবেই দিচ্ছে।
এই চাপ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সরকারের নেই। এর মূল্যবৃদ্ধি নয়, কর বৃদ্ধির জন্য চাপ তার থেকেও বেশি। তারা বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন বা ৪৭০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ কর্মসূচির শর্ত হিসেবে বাংলাদেশকে কর বৃদ্ধি করে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ২০২৫-২৬ সালে বাড়াতে হবে শতকরা শূন্য দশমিক ২ ভাগ। এর জন্য দেশকে অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। এটা বলাইবাহুল্য যে, এ সকল দ্রব্যের ওপর ও সেবা খাতে কর বৃদ্ধি সাধারণভাবে অন্যান্য দ্রব্যেরও মূল্যবৃদ্ধি করবে।
সরকারের বক্তব্য, যেসব দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো সাধারণ দোকানের ভোগ্য নয়। কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক নয়। কাপড়ের ওপর ৭ দশমিক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ যে কর বৃদ্ধি হয়েছে, সেটা সাধারণ লোককে আঘাত করবে। মিষ্টির ওপর যে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেখানেও আঘাত আছে। কারণ সাধারণ মানুষ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে এবং নিজেদের ভোগের জন্য মিষ্টি কিনে থাকে।
রেস্তোরাঁর খাবারের ভ্যাট বাড়িয়ে ৫ থেকে করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। এটা অবশ্যই সাধারণ লোককে আঘাত করবে। কারণ ব্যাপকসংখ্যক মানুষ রেস্তোরাঁয় খেয়ে থাকেন। শুকনো ফলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে আকস্মিকভাবে। নানা খাদ্য তৈরিতে শুকনো ফল ব্যবহার করা হয়। এসব খাদ্যের মধ্যে রয়েছে বিস্কুট, পায়েস, ফিরনি ইত্যাদি মিষ্টি, যা অতিথিসেবা ও বিয়ে ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে সাধারণ লোককে কিনতে হয়।
ভ্যাট হচ্ছে পরোক্ষ কর। এই করের ভার ধনীদের তেমন আঘাত না করলেও সাধারণ লোকের ওপর এর প্রভাব পড়ে। তাদের আয় কম এবং এই আয়ের একটা অংশ কর বৃদ্ধির জন্য দেওয়ায় তাদের প্রকৃত মজুরি বা আয় কমে আসে। যেভাবে ১০০ দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই বৃদ্ধি যে শুধু এই দ্রব্যগুলোর ক্ষেত্রে ঘটবে, তা নয়। এর প্রভাব প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রেও ঘটতে বাধ্য। এটাই অর্থনৈতিক নিয়ম। প্রত্যেক পরোক্ষ কর সব দিক দিয়ে গরিব এবং অল্প আয়ের মানুষের জীবিকার মান কমিয়ে আনে।
সরকারের আয় বৃদ্ধির জন্য পরোক্ষ করই একমাত্র ব্যাপার নয়। প্রত্যক্ষ কর (direct tax) এর অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই কর আয়ের ওপর ধার্য করা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে দেশে ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে কম, শতকরা মাত্র ৮। ভারতে এই অনুপাত শতকরা ১২, নেপালে ১৭, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ১১ এবং দুনিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল অন্য দেশে ২৫।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি অবশ্যই দরকার। কিন্তু এর জন্য প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে পরোক্ষ করের আশ্রয় তারাই নিতে পারে, যারা জনগণের প্রতিনিধি নয়, ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি। বাংলাদেশে এত দিন এটাই হয়ে এসেছে এবং বর্তমান সরকার যেভাবে আয় বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ কর ধার্যের পরিবর্তে পরোক্ষ করের আশ্রয় নিয়েছে, তার মধ্যেই এদের আসল চরিত্র ধরা পড়ছে।
বড় বড় মিল কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীর ওপর কর অশ্লীলভাবে কম। তাদের প্রতি প্রত্যেকটি সরকারই খুব সদয়। তাদের ওপর ধার্য করের পরিমাণ সামান্য। তারা কর ফাঁকিও দেয়, তা ছাড়া বড় কারখানার মালিকদের কর রেয়াত দেওয়া হয়। এভাবে ধনীদের রেয়াত দিয়ে সাধারণ শ্রমজীবী ও গরিদের রক্ত শোষণ করেই সরকারের ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে।
১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যবসায়ী শ্রেণি নিজেদের শক্তিশালী ও সংযত করে দেশের শাসকশ্রেণি হিসেবে অর্থনীতি ও রাজনীতি থেকে নিজেদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছে। বিগত জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে পূর্ব অবস্থাতেই বজায় আছে।
হাজার হাজার মানুষের জীবনদান নয়, শারীরিক ও অন্যান্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর অভ্যুত্থানকারী ছাত্র, জনগণসহ সবাই আশা করেছিলেন এদিক দিয়ে পরিবর্তন হবে। ছাত্র অভ্যুত্থানের পরবর্তী পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার যে আশার আলো সামান্য দেখালেও এখন তারা যেভাবে নানা নীতিনির্ধারণ করছেন, তাতে এর উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, এত দিন এই সরকার যেভাবে ট্রাকে করে অল্প দামে কয়েকটি জিনিস অল্প আয়ের মানুষের কাছে দিয়ে আসছিল, সেটাও এখন বন্ধ হয়েছে। জিনিসপত্রের অবাধ মূল্যবৃদ্ধি ও কর আরোপের সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে খুব বিস্ময়কর।
কিন্তু এই বিস্ময়কর ব্যাপারটি এখন ঘটছে। বর্তমান সরকার যেভাবে তার প্রাথমিক অবস্থান থেকে দ্রুত সরে আসছে, তাতে তাদের জনপ্রিয়তা যে আর কিছুদিনের মধ্যে বড় আকারে কমে আসবে, তাতে সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় এ সরকার অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকার কোনো যৌক্তিক দাবি অথবা জনগণের জন্য তার কোনো প্রয়োজনীয়তা আর নেই। এরা এখন দ্রুতগতিতে দেশের শাসকশ্রেণি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করতে শুরু করায় জুলাই অভ্যুত্থানের মূল্যবোধ ও চরিত্রকে এরা শিকেয় তুলেছে। শুধু কর আরোপের ক্ষেত্রে নয়, অন্য অনেক ক্ষেত্রেও এটা দেখা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতির পরিবর্তন যথা শিগগিরই দরকার। এর জন্য আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার জন্য যা কিছু করা দরকার, সেসব কাজ সম্পন্ন করে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কাছে হস্তান্তর করা দরকার।
অবশ্য সেভাবে নির্বাচিত সরকারও যে বর্তমান শাসকশ্রেণি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রভাবমুক্ত হয়ে দেশের লোকের জন্য দুধ-ভাতের ব্যবস্থা করবে, এটা আশা করারও কিছু নেই এবং এভাবে একটি অনির্বাচিত সরকার অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় না থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেবে—এই বিষয়টি এখন জরুরি হয়ে গেছে। এর জন্য সরকারের দরকার এই মুহূর্তে আগামী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা।
এমবি
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৪ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৪ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে