গাজা উপত্যকায় দুই বছর ধরে চলা গণহত্যা ও নির্মম ধ্বংসযজ্ঞে ইসরাইলের অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা। এখন তারাই আবার তথাকথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’র নামে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে তথাকথিত ‘গাজা শান্তি বোর্ড’ এই উপত্যকা শাসন করবে। ট্রাম্পই গাজার ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। তিনি যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন, সেটিকেই গাজার জন্য ‘শান্তি’ বলে চালিয়ে দেওয়া হবে।
শান্তি বোর্ড গঠনের নামে গাজা শাসনের এই ব্যবস্থা হবে কার্যত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ১০০ বছর আগের ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের দিকে একটি স্পষ্ট প্রত্যাবর্তন, যাতে একমাত্র পরিবর্তনটি হবে যুক্তরাজ্যের বদলে যুক্তরাষ্ট্র এই ম্যান্ডেট পাবে। গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার লক্ষ্যে এই পরিবর্তন আনার বিষয়টি দুঃখজনক। গাজা নিয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবটি একটি প্রহসন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গাজায় ইসরাইলের গণহত্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে এখন এই ভূখণ্ডটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার নীলনকশা আটছে।
এই প্রহসনে ট্রাম্পের সম্ভাব্য পার্শ্ব-চরিত্র হবেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। তিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে ট্রাম্পের পূর্বসূরিদের একজন জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে ইরাকে অবৈধ আক্রমণ এবং পরবর্তীকালে একটি বিপর্যয়কর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা দেশটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত ২৮০৩ নম্বর প্রস্তাবটি ট্রাম্পকে গাজার অহংকারী সামন্ততান্ত্রিক একজন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছে। তথাকথিত এই ‘শান্তি বোর্ড’-এ তার দালালদের মধ্যে থাকবেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সম্মানিত নেতারা’। আগামী দুই বছর এবং নিঃসন্দেহে এরপরও গাজার ধ্বংসাবশেষের ওপর তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে গাজা কীভাবে পরিচালিত হবে, এর সীমানা কী হবে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এই ভূখণ্ড কীভাবে পুনর্নির্মাণ করা হবে এবং কোনো অর্থনৈতিক কর্মসূচি অনুমোদিত হবে কি না।
গাজা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন-ইসরাইলি যৌথ দখলদারিত্বে চলে যাবে। সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন গাজার ভাগ্য নির্ধারণ করবে যে দেশটি দুই বছর ধরে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে গাজায় গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য।
ট্রাম্পের এই ‘শান্তি পরিকল্পনা’ বাস্তবে গাজার ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা প্রদানের পরিবর্তে তাদের অধিকারকে আরো ক্ষুণ্ণ করবে। এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনিদের বৈধ সংগ্রামকে উপেক্ষা করে তাদের ওপর একটি বিদেশি বহিরাগত শক্তিকে অভিভাবক হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গৃহীত ৩২৩৬ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে আরো সংকুচিত এবং গাজায় আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘনকে জোরদার করবে।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা গাজাকে দ্বিখণ্ডিত করবে। ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে গাজাকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন তথাকথিত ‘গ্রিন জোন’ বা ‘সবুজ অঞ্চল’ এবং তথাকথিত ‘রেড জোন’ বা ‘লাল অঞ্চলে’ বিভক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সেখানে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ দুটি অঞ্চলকে পৃথক করা হয়েছে অদৃশ্য ‘হলুদরেখা’র মাধ্যমে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে, গাজার পুনর্গঠন শুধু ‘সবুজ অঞ্চল’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যেখানে ইসরাইল এবং তার মিত্ররা তথাকথিত ‘বিকল্প নিরাপদ সম্প্রদায়’-এর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। যদি এই ‘নিরাপদ সম্প্রদায়’-এর পরিকল্পনা এগিয়ে যায়, তাহলে এর মাধ্যমে গাজায় একটি খণ্ডিত অঞ্চল তৈরি হবে। এই শিবিরগুলো তৈরির উদ্দেশ্য মানবিক ত্রাণ সহায়তা দেওয়া নয়, বরং উচ্ছেদের মাধ্যমে এমন একটি অঞ্চল তৈরি করা, যেখানে ফিলিস্তিনিদের মৌলিক পরিষেবা গ্রহণ করতে সেখানে প্রবেশের জন্য স্ক্রিনিং এবং যাচাই করা হবে। একইভাবে সীমানার বাইরে যেতে বাধা দেওয়া হবে এবং ‘রেড জোন’ অবরোধ করা হবে।
বৃহত্তর ইহুদিবাদী রাষ্ট্রগঠনের ইসরাইলি লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘ভাগ করো এবং জয় করো’ কৌশল অনুসরণ করছে। এ জন্য তারা আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে কখনো হুমকি দিয়ে আবার কখনো নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। যখন বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের দাবির বিরোধিতা করে, তখন এসব দেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি তারা বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের ঋণ পাওয়ার সুবিধা হারায় এবং ইসরাইলি বোমা হামলার শিকার হয়।
সম্প্রতি ইসরাইলি অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম শরিমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা সীমান্তে বড় একটি সামরিক ঘাঁটি বানানোর পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১১ নভেম্বর শরিম জানিয়েছে, এই ঘাঁটি নির্মাণে প্রায় ৫০ কোটি ডলার ব্যয় হতে পারে। এই ঘাঁটি বানানোর সিদ্ধান্তে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের অব্যাহত এই অপকৌশলের শিকার ফিলিস্তিন। এর ফল শুধু সরাসরি গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনের জন্যই ধ্বংসাত্মক নয়, বরং আরব বিশ্ব এবং তার বাইরেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে লিবিয়া, সুদান, সোমালিয়া, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক ও ইরানে প্রকাশ্যে বা গোপনে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।
জাতিসংঘ সনদ অনুসারে নিরাপত্তা পরিষদ যদি কোনো দেশ বা জাতি-গোষ্ঠীকে সত্যিকারের নিরাপত্তা দিতে চায়, তাহলে পরিষদকে অবশ্যই মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করতে হবে। শান্তির জন্য একটি সত্যিকারের প্রস্তাবে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। এগুলো হচ্ছেÑ
প্রথমত, এটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের একটি সার্বভৌম সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বাগত জানাবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। দ্বিতীয়ত, এটি ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুসারে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করবে। তৃতীয়ত, এটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো থেকে গঠিত ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ-নির্দেশিত একটি সুরক্ষা বাহিনী প্রতিষ্ঠা করবে। চতুর্থত, যুদ্ধরত সব অ-রাষ্ট্রীয় সংগঠনের তহবিল বন্ধ এবং এগুলোর নিরস্ত্রীকরণ এতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
এসব পদক্ষেপ ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের পারস্পরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান প্রকৃত শান্তির জন্য। ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলি উভয়েরই নিরাপদ থাকার সময় এসেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকেও ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর স্থায়ীভাবে নিজেদের শাসন চাপিয়ে দেওয়ার নিষ্ঠুর ও ভ্রান্ত ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে।
সমালোচকদের মতে, ট্রাম্প এর আগে হাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় এই ভূখণ্ডটিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা বিনোদন ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার যে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, এবার তা বাস্তবায়নের সুযোগ এসেছে তার সামনে। গাজা শান্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
আলজাজিরা ও মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

