নির্বাসন থেকে কনক সারওয়ারের ইউটিউব চ্যানেলে বেশ কয়েকবার বলেছিলাম, হাসিনার দৈহিক মৃত্যু নয়, বরং এই দানব শাসকের রাজনৈতিক মৃত্যু দেখার খুবই আকাঙ্ক্ষা আমার। ২০২৪ সালে আগস্টের ৫ তারিখে বিপ্লবের চূড়ান্ত সময়ে গণভবন ছেড়ে দিল্লিতে পালিয়ে গিয়ে শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক মৃত্যুর ঘণ্টা নিজেই বাজিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। বাগাড়ম্বরপ্রিয় হাসিনার পলায়নের ৮২০ বছর আগে সেই ১২০৪ সালে, গৌড়ের রাজা লক্ষণ সেন একইভাবে রাজবাড়ীর পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছিলেন, যখন তুর্কি-আফগান জেনারেল ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি অশ্বপৃষ্ঠে, তলোয়ার হাতে মাত্র সতেরোজন ঘোড়সওয়ার সঙ্গে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন। সেই ক্ষুদ্র অগ্রগামী দলের পেছনে অবশ্য বিশাল মুসলিম সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছিল। লক্ষণ সেন দুপুরের খাবার ফেলে আওয়ামী লীগের মার্কা নৌকায় করে পালিয়েছিলেন আর হাসিনা পালালেন সৈন্য বহনকারী বিমানে চড়ে। লক্ষণ সেনের মতো হাসিনারও ভাগ্যে দুপুরের খাবার জোটেনি। চলমান মাসের ১৭ তারিখে গণহত্যার অপরাধে আদালতে বিচারক মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলে মুজিবকন্যার রাজনৈতিক মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে, ফ্যাসিস্ট শাসকের সেই প্রত্যাশিত মৃত্যু শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করেছেন শেখ হাসিনারই কর্মী-সমর্থকরা। কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! পাঠকরা হয়তো ভাবছেন, ওরা আবার এখানে কী করল? প্রশ্নের জবাবে আমাকে ২০১৩ সালে ফিরতে হচ্ছে।
সেই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আইসিটি আদালত মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলে এক ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে সারা দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল। দুই দিনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন ১৫০ জন বিক্ষোভকারী। অসংখ্য মানুষ গুলিতে, কাঁদানে গ্যাসে এবং লাঠিচার্জে আহত হয়েছিলেন। হতাহতরা সবাই কিন্তু জামায়াতে ইসলামী দলের সমর্থক ছিলেন না। দল-মত নির্বিশেষে তারা কেবল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রচণ্ড অনুরাগী ছিলেন। চল্লিশের অধিক জেলা প্রশাসক তৎকালীন কেবিনেট সেক্রেটারিকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, বিক্ষোভের তীব্রতায় তাদের জেলাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তিন দিনের প্রতিবাদে প্রায় সরকার পতনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে আটকেপড়া মানুষদের উদ্ধারের জন্য চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ পাঠাতে হয়েছিল; কারণ চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের হাইওয়ে লাখো জনতার নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমার মনে আছে, কক্সবাজারে সে সময় আমার দেশ-এর বিপুল পাঠকপ্রিয়তা থাকায় তাদের অনুরোধে আমি কয়েকদিন বিমানে কাগজ পাঠিয়েছিলাম।
উপরের চিত্রের ঠিক বিপরীত দৃশ্য আমরা ১৭ নভেম্বর দেখেছি। হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হলে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে। সর্বত্র মিষ্টি খাওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। বিচারপতি এবং আইসিটির প্রসিকিউটররা সবাই জাতীয় নায়ক বনে গিয়েছেন। তাদের বিষয়ে ইউটিউব কনটেন্টগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়েছে। আরো আশ্চর্যের বিষয়, হাসিনার দণ্ডের বিরুদ্ধে তার পূর্বপুরুষের দেশ গোপালগঞ্জে পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ হয়নি। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে হাসিনার বাবার পতনেও বাংলাদেশের মানুষ একইভাবে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। সেদিনও গোপালগঞ্জে জানাজা পড়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আধুনিক কালের ফ্যাসিস্ট শাসক পতনের এই গৌরবজনক ইতিহাস বাংলাদেশের জনগণকে ভুলিয়ে দেওয়া কঠিন হবে। পলাতক হাসিনা এখনো শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও ‘রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা’র লাশটি প্রকৃতপক্ষে কফিনবন্দি হয়ে দিল্লিতে পড়ে আছে। সেই কফিনে শেষ পেরেক গেঁথে কবরস্থ কিংবা সৎকার করার দায়িত্ব মোদি-দোভালের কাঁধে। বাংলাদেশে ১৫ বছর অঘোষিত ঔপনিবেশিক শাসন চালানোর পর ভারত এখন মহা ফ্যাসাদে। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার স্বঘোষিত মালিক, আণবিক শক্তিধর বিশাল দেশটির নীতিনির্ধারকরা কী করতে পারেন, তার একটা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করছি।
১. বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরিতা অব্যাহত রাখতে চাইলে ভারতের কট্টরপন্থি ‘ডিপ স্টেট’ আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বানচাল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় গোয়েন্দাদের যতগুলো ‘স্লিপার সেল’ আছে, তার সবগুলোকে তারা এ সময়ে সক্রিয় করবে। কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন না হলে দেশ যে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে, সেই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে দিল্লি হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের চেষ্টা চালাতে পারে। মোদি-অমিত-দোভাল ট্রয়কার এ-জাতীয় পরিকল্পনার সম্ভাবনা আমাদের হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। এই ষড়যন্ত্র যাতে সফল না হতে পারে, সে জন্য সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ দেশের সব রাজনৈতিক দলের কথা এবং কাজে অধিকতর দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে। নানা কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর বিপ্লবোত্তর পনেরো মাসের কর্মকাণ্ডে দেশপ্রেমিক জনগণ হতাশ এবং বিরক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তাদের জবান আমাদের ওপর জুলুম চালাচ্ছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টার অতি সাম্প্রতিক দিল্লি সফরকালে তার কাউন্টারপার্ট অজিত দোভালের সঙ্গে একাধিক মিটিং করে এসেছেন। তারা কী আলোচনা করেছেন আমার জানা নেই। তবে চাণক্যনীতিতে বিশ্বাসী গোয়েন্দা ও কূটনীতিকদের প্রতিশ্রুতিতে অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন বিপজ্জনক হতে পারে। সব সম্ভাবনা আমলে নিয়ে ড. ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ ও ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে ইতিহাসে স্থান করে নেবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
২. বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আপাতত পরিস্থিতি চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। শুভেচ্ছার প্রদর্শন হিসেবে অজিত দোভাল ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে মুখ বন্ধ রাখারও নির্দেশ দিতে পারেন। হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর ভারত কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে যে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে, তার ভাষা প্রথমবারের মতো বেশ সংযত। সেই বিবৃতিতে তারা কেবল অবগত হওয়ার কথা বলেছে (Noted), হাসিনার ভাগ্য বিপর্যয়ে কোনোরকম উদ্বেগ (Concern) প্রকাশ করেনি। দেরিতে হলেও হয়তো ভারতের সুবুদ্ধির উদ্রেক হয়েছে।
আমার ধারণা, দিল্লি ইতোমধ্যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেছে। সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ সরকার পরিষ্কারভাবে ভারতকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের কোনোরকম সুযোগ কিংবা সম্ভাবনা নেই। প্রফেসর ইউনূস নিজেও একাধিকবার কোনো রাখঢাক না করে পশ্চিমা দেশগুলোর সফররত মন্ত্রীদের একই কথা বলেছেন। আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে যে দল সরকার গঠন করবে, তারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনে দিল্লির চাপ কতটা মোকাবিলা করবে, সেটা দেখার জন্য আমাদের কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। প্রফেসর ইউনূস এ ব্যাপারে দৃঢ়তার যে প্রশংসনীয় বেঞ্চমার্ক রেখে যাচ্ছেন, আগামী সরকার সেখান থেকে সরে গেলে তাদের কঠিন রাজনৈতিক মাশুল চুকাতে হবে বলেই আমার ধারণা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আত্মপরিচয়ে বলিয়ান আমাদের তরুণ প্রজন্ম ভারতীয় হেজেমনি এবং অভ্যন্তরীণ ফ্যাসিবাদ আর মানবে না।
৩. ভারতের জন্য তৃতীয় বিকল্প হতে পারে ‘কফিনবন্দি রাজনৈতিক লাশ’ শেখ হাসিনাকে অন্য কোনো দেশে চালান করে দেওয়া। অবশ্য আমি জানি না মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই গণহত্যাকারীকে ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ আশ্রয় দিতে সম্মত হবে কি না। ভারতের মতো তাদের হাসিনাকে নিয়ে কোনো দায় নেই। শেখ হাসিনাকে প্রায় পঞ্চাশ বছর ব্যবহার করার পর তার জন্য একটা ব্যবস্থা করা ছাড়া ভারতের কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে দিল্লি তার আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে হাসিনার মতো দালাল রাজনীতিবিদ সৃষ্টি করতে চাইলে আমৃত্যু এই বোঝা মোদিকে বহন করেই যেতে হবে। স্মরণে রাখা দরকার যে, শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের পর থেকে মোদির আশ্রয়ে থাকলেও, এই দানবকে তৈরির প্রক্রিয়ায় ভারতীয় কংগ্রেস আদি এবং মূল ভূমিকা পালন করেছে। সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও, ভবিষ্যতে কখনো কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরতে পারলে এবং ততদিন হাসিনা জীবিত থাকলে তার বিষয়ে দিল্লির সরকারি অবস্থানের কোনো পরিবর্তনের আশা আমরা করতে পারি না।
৪. বাংলাদেশের বর্তমান অথবা আগামী সরকারের সঙ্গে ভারতসৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দিল্লি হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য ব্যতীত ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যান্য দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ঢাকার কাছে প্রত্যর্পণের প্রস্তাব দিতে পারে। শেখ হাসিনা নিজেও অন্যদের রক্ষার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ না-ও দেখাতে পারেন। তার এরকম স্বার্থপর আচরণের একাধিক পূর্ব-ইতিহাস রয়েছে। গত বছর ৫ আগস্টের দুই-একদিন আগে শেখ হাসিনা পরিবারের সব সদস্যকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেও, গণহত্যা ও লুটপাটে জড়িত দলীয়, সরকারি, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক সাঙ্গোপাঙ্গদের কোনো কিছু না জানিয়েই ছোট বোন রেহানা এবং তার দেবর মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিককে নিয়ে সেনাপ্রহরায় দিল্লিতে পালিয়েছিলেন। এর আগেও ২০০৭ সালে মঈন-ফখরুদ্দীনের ১/১১ সরকার ক্ষমতা দখল করার পর হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্তও তিনি ভারতেই ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে ‘হাসিনা পালায় না’ বলে বড়াই করলেও শেখ হাসিনা সারা জীবন সুযোগ পেলেই পালিয়েছেন। সুতরাং, ভারত সরকার কোনো তৃতীয় দেশে তার অজ্ঞাতবাসের ব্যবস্থা করলে, এবারও ভারতে পলাতক কয়েক হাজার আওয়ামী খুনি ও লুটেরাকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করে হাসিনা মেয়ে ও নাতনিদের নিয়ে পালাতে এক মুহূর্ত দেরি করবেন না।
প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো ভারতের আদি চরিত্র। নেপালের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল নেপালি ন্যাশনাল কংগ্রেস ১৯৪৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতায় জন্মলাভ করেছিল। দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বি. পি. কৈরালা। তারপর ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ত্যাগ করলে সুবর্ণ শমশের রানা সেই কলকাতাতেই ১৯৪৮ সালের ৪ আগস্ট নেপাল ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই দুই দল ১৯৫০ সালের ১০ এপ্রিল মিলে গিয়ে নেপালি কংগ্রেস নামে পরিচিত হয় এবং বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা যুক্ত দলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের মতো নেপালি কংগ্রেসকেও জন্মাবধি দিল্লি নিয়ন্ত্রিত বিবেচনা করা হয়।
তিব্বতের ধর্মগুরু এবং রাজনৈতিক নেতা দালাই লামা চীন সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ১৯৫৯ সালের মার্চে রাজধানী লাসা থেকে পালিয়ে ভারতে চলে আসেন। সেই থেকে দালাই লামা ভারতেই আছেন। হিমালয়ের অপর রাজ্য ভুটানকে আজ পর্যন্ত ভারত প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হতে দেয়নি। দেশটির পররাষ্ট্র নীতি এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিল্লি নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে আমাদের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের কথা সারা বিশ্ব জানে।
আশির দশকে শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদ তৈরিতে ভারতের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী সংগঠন, তামিল টাইগার ভারতের মাটিতেই তৈরি হয়েছিল। ভারতের দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে কট্টরপন্থি ইন্দিরা গান্ধী সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় হেজেমনি প্রতিষ্ঠার বাসনা লালন করতেন। ইতিহাসের এক নির্মম বিচারে ইন্দিরা গান্ধীর বড় ছেলে রাজীব গান্ধী ১৯৯১ সালে তামিলনাড়ুতেই এক জনসভায় অংশ নিতে গিয়ে তামিল বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছিলেন। ভারত দুই দশক ধরে তামিল টাইগারদের প্রয়োজনীয় অর্থ, অস্ত্র এবং কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। তবে, ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় ভারতের স্বার্থবিরুদ্ধ হওয়ায় শ্রীলঙ্কা বিভক্ত করে দেশটির সংখ্যালঘু তামিলদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বরাবর অনীহা ছিল। শ্রীলঙ্কায় স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে তামিলনাড়ু রাজ্য ভারত থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেই নতুন রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে ভারতের পাশে আরেকটি বিশাল ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্মলাভের আশঙ্কা ছিল। ভারত তামিলদের ক্ষোভকে ব্যবহার করে শ্রীলঙ্কাকে বশীভূত করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী ২০০৯ সালে তামিল টাইগার বাহিনীকে পরাজিত এবং সুপ্রিম লিডার প্রভাকরণকে সপরিবারে হত্যা করলে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রে কুড়ি বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে।
দক্ষিণ এশিয়ায় অধিকাংশ যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাণ ও সম্পদহানি এবং অনৈক্যের জন্য ভারত এককভাবে দায়ী। আশা করি, মহান জুলাই বিপ্লবে আমাদের নিরস্ত্র অথচ প্রবল সাহসী তরুণদের হাতে ভারতীয় আধিপত্যবাদের অপ্রত্যাশিত ও দর্শনীয় পরাজয় দেশটির নীতিনির্ধারকদের প্রভুত্ব বিস্তারের আদিম আকাঙ্ক্ষাকে খানিকটা হলেও প্রশমিত করবে। রাজনৈতিক বাস্তবতায় শেখ হাসিনা যে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই সত্যটি দিল্লি আর দেরি না করে মেনে নিলে, পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে আমাদের দুই প্রতিবেশী ও স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে লাভজনক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা হতে পারে। দিল্লির শাসকদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।


গুমের দুঃসহ ক্ষত নিয়ে নির্বাচনি মাঠে
অগ্রণী ব্যাংকের ভল্টে মিলল হাসিনার ৮৩২ ভরি স্বর্ণালংকার