
রঞ্জন সলোমন

ভারতের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপ। ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি বর্তমানে সমরাস্ত্র, রাসায়নিক শক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৩০টিরও বেশি কোম্পানি পরিচালনা করছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপকে ভারতীয় পুঁজিবাদের বিবেক হিসেবে উদযাপন করা হয়েছে। লাখ লাখ ভারতীয়ের কাছে ‘টাটা’ নামটি একটি আস্থার প্রতীক।
কিন্তু এই শিল্প গ্রুপ ও এর সুনামের পেছনে একটি অন্ধকার দিকও আছে। আধুনিকতার মুখোশের আড়ালে সেই অন্ধকার দিকটি হলোÑফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখা ও গণহত্যায় টাটা গ্রুপের পুঁজির ব্যবহার, যা এখন সামনে আসছে। টাটা যে গাজায় ইসরাইলের বিধ্বংসী যুদ্ধ ও গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তা এখন সামনে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশীয় সমন্বিত সংগঠন ‘সালাম’ প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছেÑ‘দখলদারিত্বের স্থপতি : টাটা গ্রুপ, ভারতীয় পুঁজি এবং ভারত-ইসরাইল জোট’। এই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, টাটা ভারত-ইসরাইল সামরিক অংশীদারত্বের ‘কেন্দ্রে’ রয়েছে এবং মৌলিকভাবে দখলদারিত্বকে অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছে। কীভাবে টাটার বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ইসরাইলের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সে খাদ্য সরবরাহ করে থাকে, তা এতে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে টাটা গ্রুপের বেশ কয়েকটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমস লিমিটেড (টিএএসএল)। ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের (আইএআই) সঙ্গে টিএএসএলের দীর্ঘদিনের অংশীদারত্বের সম্পর্ক আছে। তারা যৌথভাবে বারাক-৮ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেমের মূল উপাদান তৈরি করে। এই মিসাইল সিস্টেম ইসরাইলের নৌ-প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত এবং এগুলো গাজায় হামলায় ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া টিএএসএল এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের জন্য বিমানের মূল কাঠামো এবং অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের ফিউজলেজও তৈরি করে। এ দুটিই ইসরাইলি বিমানবাহিনী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। টাটার আরেকটি সহযোগী সংস্থা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (জেএলআর) অধিকৃত পশ্চিম তীরে টহল এবং শহুরে ফিলিস্তিনিদের দমনে ইসরাইলি বাহিনীর ব্যবহৃত এমডিটি ডেভিড হালকা সাঁজোয়া যানের চ্যাসিস সরবরাহ করে।
আইটি জায়ান্ট টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (টিসিএস) ইসরাইলের সরকারি ও আর্থিক খাতের জন্য ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরিতে জড়িত বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি গুগল এবং আমাজনের সঙ্গে মিলে বিতর্কিত ক্লাউড-কম্পিউটিং চুক্তি প্রজেক্ট নিম্বাসে জড়িত, যা ইসরাইলি রাষ্ট্রীয় নজরদারি সহজতর করে।
‘সালাম’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক কোনো কর্মকাণ্ড নয়, বরং ইসরাইলের ‘দখল অর্থনীতির’ মধ্যে ভারতীয় পুঁজির একটি পদ্ধতিগত অন্তর্ভুক্তির অংশ। টাটা নিউ ইয়র্ক সিটি ম্যারাথনের মতো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। টাটার এই পৃষ্ঠপোষকতাকে ‘স্পোর্টস ওয়াশিং’ বা ‘ক্রীড়া-ধোলাই’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটি হচ্ছে টাটার বিশ্বব্যাপী সামাজিক দায়বদ্ধতার আড়ালে যুদ্ধকে পুঁজি করে মুনাফা অর্জনের পথকে আড়াল করার একটি কৌশল মাত্র।
ইসরাইলকে টাটার সহযোগিতা শূন্যে ভাসমান কোনো বিষয় নয়। এটি ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের একটি করপোরেট আয়না মাত্র। ১৯৯০ সাল থেকে এবং আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে পরিণত হয়েছে। ভারত এখন ইসরাইলি অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানির ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই আসে ভারতে।
ভারতের ডিআরডিও এবং ইসরাইলের আইএআইয়ের যৌথ উদ্যোগে তৈরি বারাক-৮ ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটি টাটার স্থাপনাগুলোয় আংশিকভাবে সংযোজন করা হয়। ভারতের কেনা হেরন ড্রোন, ফ্যালকন অ্যাওয়াকস সিস্টেম এবং স্পাইক অ্যান্টি-ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র একই শিল্প নেটওয়ার্কের পণ্য, যা ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। এই সিস্টেমগুলোর বেশ কয়েকটি ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে ব্যবহার করে থাকে।
এই ভূরাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ এবং ইহুদিবাদ তাদের আদর্শিক ফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দুদেশই ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই’-এর বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে আধিপত্যকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। সুতরাং, ইসরাইলের সঙ্গে টাটা গ্রুপের অংশীদারত্ব শুধু নিছক বাণিজ্যিক নয়। তাদের সম্পর্ক একটি অভিন্ন রাজনৈতিক প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রকাশ, যেখানে করপোরেট পুঁজি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং মতাদর্শ পরস্পরের সঙ্গে মিশে থাকে।
শুধু টাটা একা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করপোরেট হাউসগুলো দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে সমর্থন দিয়ে আসছে। হিউলেট-প্যাকার্ড, ক্যাটারপিলার এবং বর্তমানে গুগল, আমাজনসহ বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিরুদ্ধে ইসরাইলের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসার নামে ইসরাইলের সঙ্গে টাটার এর ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক এখন অনেকেরই নজরে আসছে। যদিও টাটা গ্রুপ গাজার যুদ্ধ থেকে মুনাফা অর্জনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেছে ।
যে কোম্পানি তার প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার বিজ্ঞাপনে গান্ধীর ছবি ব্যবহার করে এবং জনহিতকর কাজের কথা বলে, তারাই এখন মৃত্যুর অর্থনীতি থেকে লাভবান হচ্ছে। তাদের নিজস্ব আচরণবিধি জাতিসংঘের ব্যবসা ও মানবাধিকার নির্দেশিকা নীতিমালার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনে অংশগ্রহণকে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু তারপরও গাজায় গণহত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে টাটার জবাবদিহির দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই।
ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন ও গণহত্যায় টাটার জড়িত থাকার বিষয়ে তেমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। নরেন্দ্র মোদির সরকারও তাদের তদন্তে টাটার বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। বরং এর বিপরীতে ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি মডেল হিসেবে ভারত-ইসরাইলের ‘কৌশলগত সম্পর্ককে’ গুরুত্ব দিয়ে জোরেশোরে এর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিষয়টি নিয়ে ভারতের নাগরিক সমাজও দ্বিধাগ্রস্ত। কয়েক দশক আগে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষেই সোচ্চার ছিল ভারত। কিন্তু আজ সেই সংহতির স্থান দখল করেছে ভারতের নীরবতা। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা ভারতের কাছে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ভারতের যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় ইসরাইলি দখলদারিত্বের ওপর আলোচনার আয়োজন করত, তারা এখন বিষয়টি এড়িয়ে চলে। গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে ভারতে বিক্ষোভকারীদের দেশটির কঠোর আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়। করপোরেট স্বার্থ দখল করেছে সাধারণ মানুষের বিবেককে, যা জনজীবনে নৈতিক পতনের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক আইন খুবই স্পষ্ট : যদি কোনো কোম্পানি জেনেশুনে কোনো দেশকে এমন কোনো সরঞ্জাম সরবরাহ বা পরিষেবা দেয়, যা যুদ্ধাপরাধকে জোরদার করে, তাহলে সেই কোম্পানিও একই অপরাধে জড়িত। কোনো সশস্ত্র সংঘাতে করপোরেট দায়িত্বের রূপরেখা কী ধরনের হবে, তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি এবং জাতিসংঘের নির্দেশিকা নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। গাজায় টাটা তা মেনে চলেনি কখনো।
তাই গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে টাটার তৈরি অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিরপেক্ষ তদন্তের আওতায় আসা উচিত। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি তোলার অধিকার ও কর্তব্য বিনিয়োগকারী, ট্রেড ইউনিয়ন এবং ভোক্তাদের রয়েছে। এ বিষয়ে নজির আছে। ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে বিশ্বব্যাপী জোরালো প্রচারণার সময় দেশটি থেকে সরে আসার জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বেড়েছিল।
ইসরাইলি বর্ণবাদী নীতি থেকে মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও একই ধরনের নৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। ইসরাইলবিরোধী ‘বয়কট, বিনিয়োগ এবং নিষেধাজ্ঞা’ (বিডিএস) প্রচারণা এমনই একটি আন্দোলন, যেটাকে ভারতীয় নাগরিক সমাজের পূর্ণ সমর্থন জানানো উচিত। ইসরাইলের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে যখন গাজার শিশুরা অনাহারে থেকে মারা যায় এবং পুরো পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে, তখন টাটা গোষ্ঠী ঘাতক ইসরাইল রাষ্ট্রের কাছে সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি করে চলেছে। যখন কোনো দেশের কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীগুলো নিপীড়িতদের রক্ত থেকে মুনাফা অর্জন করে, তখন সেই দেশ ও জাতিও নৈতিক নেতৃত্ব দাবি করতে পারে না।
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

ভারতের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপ। ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি বর্তমানে সমরাস্ত্র, রাসায়নিক শক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৩০টিরও বেশি কোম্পানি পরিচালনা করছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপকে ভারতীয় পুঁজিবাদের বিবেক হিসেবে উদযাপন করা হয়েছে। লাখ লাখ ভারতীয়ের কাছে ‘টাটা’ নামটি একটি আস্থার প্রতীক।
কিন্তু এই শিল্প গ্রুপ ও এর সুনামের পেছনে একটি অন্ধকার দিকও আছে। আধুনিকতার মুখোশের আড়ালে সেই অন্ধকার দিকটি হলোÑফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখা ও গণহত্যায় টাটা গ্রুপের পুঁজির ব্যবহার, যা এখন সামনে আসছে। টাটা যে গাজায় ইসরাইলের বিধ্বংসী যুদ্ধ ও গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তা এখন সামনে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশীয় সমন্বিত সংগঠন ‘সালাম’ প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছেÑ‘দখলদারিত্বের স্থপতি : টাটা গ্রুপ, ভারতীয় পুঁজি এবং ভারত-ইসরাইল জোট’। এই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, টাটা ভারত-ইসরাইল সামরিক অংশীদারত্বের ‘কেন্দ্রে’ রয়েছে এবং মৌলিকভাবে দখলদারিত্বকে অব্যাহত রাখতে সহায়তা করছে। কীভাবে টাটার বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ইসরাইলের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সে খাদ্য সরবরাহ করে থাকে, তা এতে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে টাটা গ্রুপের বেশ কয়েকটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমস লিমিটেড (টিএএসএল)। ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের (আইএআই) সঙ্গে টিএএসএলের দীর্ঘদিনের অংশীদারত্বের সম্পর্ক আছে। তারা যৌথভাবে বারাক-৮ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেমের মূল উপাদান তৈরি করে। এই মিসাইল সিস্টেম ইসরাইলের নৌ-প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত এবং এগুলো গাজায় হামলায় ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া টিএএসএল এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের জন্য বিমানের মূল কাঠামো এবং অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের ফিউজলেজও তৈরি করে। এ দুটিই ইসরাইলি বিমানবাহিনী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। টাটার আরেকটি সহযোগী সংস্থা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (জেএলআর) অধিকৃত পশ্চিম তীরে টহল এবং শহুরে ফিলিস্তিনিদের দমনে ইসরাইলি বাহিনীর ব্যবহৃত এমডিটি ডেভিড হালকা সাঁজোয়া যানের চ্যাসিস সরবরাহ করে।
আইটি জায়ান্ট টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (টিসিএস) ইসরাইলের সরকারি ও আর্থিক খাতের জন্য ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরিতে জড়িত বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি গুগল এবং আমাজনের সঙ্গে মিলে বিতর্কিত ক্লাউড-কম্পিউটিং চুক্তি প্রজেক্ট নিম্বাসে জড়িত, যা ইসরাইলি রাষ্ট্রীয় নজরদারি সহজতর করে।
‘সালাম’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক কোনো কর্মকাণ্ড নয়, বরং ইসরাইলের ‘দখল অর্থনীতির’ মধ্যে ভারতীয় পুঁজির একটি পদ্ধতিগত অন্তর্ভুক্তির অংশ। টাটা নিউ ইয়র্ক সিটি ম্যারাথনের মতো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। টাটার এই পৃষ্ঠপোষকতাকে ‘স্পোর্টস ওয়াশিং’ বা ‘ক্রীড়া-ধোলাই’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটি হচ্ছে টাটার বিশ্বব্যাপী সামাজিক দায়বদ্ধতার আড়ালে যুদ্ধকে পুঁজি করে মুনাফা অর্জনের পথকে আড়াল করার একটি কৌশল মাত্র।
ইসরাইলকে টাটার সহযোগিতা শূন্যে ভাসমান কোনো বিষয় নয়। এটি ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের একটি করপোরেট আয়না মাত্র। ১৯৯০ সাল থেকে এবং আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে পরিণত হয়েছে। ভারত এখন ইসরাইলি অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানির ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই আসে ভারতে।
ভারতের ডিআরডিও এবং ইসরাইলের আইএআইয়ের যৌথ উদ্যোগে তৈরি বারাক-৮ ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পটি টাটার স্থাপনাগুলোয় আংশিকভাবে সংযোজন করা হয়। ভারতের কেনা হেরন ড্রোন, ফ্যালকন অ্যাওয়াকস সিস্টেম এবং স্পাইক অ্যান্টি-ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র একই শিল্প নেটওয়ার্কের পণ্য, যা ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। এই সিস্টেমগুলোর বেশ কয়েকটি ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে ব্যবহার করে থাকে।
এই ভূরাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ এবং ইহুদিবাদ তাদের আদর্শিক ফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দুদেশই ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই’-এর বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে আধিপত্যকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। সুতরাং, ইসরাইলের সঙ্গে টাটা গ্রুপের অংশীদারত্ব শুধু নিছক বাণিজ্যিক নয়। তাদের সম্পর্ক একটি অভিন্ন রাজনৈতিক প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রকাশ, যেখানে করপোরেট পুঁজি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং মতাদর্শ পরস্পরের সঙ্গে মিশে থাকে।
শুধু টাটা একা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করপোরেট হাউসগুলো দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে সমর্থন দিয়ে আসছে। হিউলেট-প্যাকার্ড, ক্যাটারপিলার এবং বর্তমানে গুগল, আমাজনসহ বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিরুদ্ধে ইসরাইলের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসার নামে ইসরাইলের সঙ্গে টাটার এর ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক এখন অনেকেরই নজরে আসছে। যদিও টাটা গ্রুপ গাজার যুদ্ধ থেকে মুনাফা অর্জনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেছে ।
যে কোম্পানি তার প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার বিজ্ঞাপনে গান্ধীর ছবি ব্যবহার করে এবং জনহিতকর কাজের কথা বলে, তারাই এখন মৃত্যুর অর্থনীতি থেকে লাভবান হচ্ছে। তাদের নিজস্ব আচরণবিধি জাতিসংঘের ব্যবসা ও মানবাধিকার নির্দেশিকা নীতিমালার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনে অংশগ্রহণকে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু তারপরও গাজায় গণহত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে টাটার জবাবদিহির দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই।
ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন ও গণহত্যায় টাটার জড়িত থাকার বিষয়ে তেমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। নরেন্দ্র মোদির সরকারও তাদের তদন্তে টাটার বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। বরং এর বিপরীতে ভারতীয় কর্মকর্তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি মডেল হিসেবে ভারত-ইসরাইলের ‘কৌশলগত সম্পর্ককে’ গুরুত্ব দিয়ে জোরেশোরে এর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিষয়টি নিয়ে ভারতের নাগরিক সমাজও দ্বিধাগ্রস্ত। কয়েক দশক আগে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষেই সোচ্চার ছিল ভারত। কিন্তু আজ সেই সংহতির স্থান দখল করেছে ভারতের নীরবতা। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা ভারতের কাছে একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ভারতের যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় ইসরাইলি দখলদারিত্বের ওপর আলোচনার আয়োজন করত, তারা এখন বিষয়টি এড়িয়ে চলে। গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে ভারতে বিক্ষোভকারীদের দেশটির কঠোর আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়। করপোরেট স্বার্থ দখল করেছে সাধারণ মানুষের বিবেককে, যা জনজীবনে নৈতিক পতনের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক আইন খুবই স্পষ্ট : যদি কোনো কোম্পানি জেনেশুনে কোনো দেশকে এমন কোনো সরঞ্জাম সরবরাহ বা পরিষেবা দেয়, যা যুদ্ধাপরাধকে জোরদার করে, তাহলে সেই কোম্পানিও একই অপরাধে জড়িত। কোনো সশস্ত্র সংঘাতে করপোরেট দায়িত্বের রূপরেখা কী ধরনের হবে, তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি এবং জাতিসংঘের নির্দেশিকা নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। গাজায় টাটা তা মেনে চলেনি কখনো।
তাই গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে টাটার তৈরি অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিরপেক্ষ তদন্তের আওতায় আসা উচিত। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি তোলার অধিকার ও কর্তব্য বিনিয়োগকারী, ট্রেড ইউনিয়ন এবং ভোক্তাদের রয়েছে। এ বিষয়ে নজির আছে। ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে বিশ্বব্যাপী জোরালো প্রচারণার সময় দেশটি থেকে সরে আসার জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বেড়েছিল।
ইসরাইলি বর্ণবাদী নীতি থেকে মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও একই ধরনের নৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। ইসরাইলবিরোধী ‘বয়কট, বিনিয়োগ এবং নিষেধাজ্ঞা’ (বিডিএস) প্রচারণা এমনই একটি আন্দোলন, যেটাকে ভারতীয় নাগরিক সমাজের পূর্ণ সমর্থন জানানো উচিত। ইসরাইলের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে যখন গাজার শিশুরা অনাহারে থেকে মারা যায় এবং পুরো পরিবার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে, তখন টাটা গোষ্ঠী ঘাতক ইসরাইল রাষ্ট্রের কাছে সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি করে চলেছে। যখন কোনো দেশের কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীগুলো নিপীড়িতদের রক্ত থেকে মুনাফা অর্জন করে, তখন সেই দেশ ও জাতিও নৈতিক নেতৃত্ব দাবি করতে পারে না।
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে পলাতক হাসিনা ও তার সহযোগীরা। এই পরিকল্পনায় দিল্লির যে সক্রিয় সমর্থন আছে, তাও স্পষ্ট। গত বছরের ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন নীরব ছিলেন হাসিনা।
৩ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে দেশ আজ প্রায় ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে উন্নীত হলেও এর কাঠামোগত দুর্বলতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেশের বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি বর্তমানে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার, যার মূল কারণ প্রযুক্তি, জ্বালানি, শিল্পযন্ত্রপাতি
২১ ঘণ্টা আগে
শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ১০ টাকা সের দরে জনগণকে চাল খাওয়াবেন। ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। এসব দইয়ের ডিব্বা কেমন করে চুন হয়েছিলÑতা সবার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।
১ দিন আগে
আমেরিকায় রীতিমতো রাজনৈতিক ভূমিকম্প সৃষ্টি করে জোহরান মামদানি যে কদিন আগে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, সেটি সব পাঠকই জানেন। কিন্তু তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিবার, রাজনীতিতে প্রবেশ, ইত্যাদি সম্পর্কে সবার হয়তো পুরো ধারণা নাও থাকতে পারে। আমি তাই অতি সংক্ষেপে সেই তথ্যগুলো দিয়ে তারপর আজকের আসল আলোচনায়
১ দিন আগে