মারুফ কামাল খান
এই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশে দুটি নাম বোধ করি স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত। এর একটি নামের মানুষের লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতায় আঠারো শতকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার স্বাধীনতা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে আসা ব্রিটিশ বেনিয়াদের করতলগত হয়। সেই ঘৃণিত নামটি হচ্ছে মীর জাফর আলী খান। আরেকটি নাম কাজী লেন্দুপ দর্জি। নিজের জন্মভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিংশ শতাব্দীতে এই ঘৃণিত লোকটি স্বাধীন ক্ষুদ্র সিকিম দেশটি তুলে দেয় অতিকায় পড়শি রাষ্ট্র ভারতের হাতে। আসুন, গোড়াতেই খুব সংক্ষেপে জেনে নিই সিকিমের স্বাধীনতা হারানোর বেদনাভরা গল্পটি।
সিকিম ছিল হিমালয়ের কোলে অবস্থিত শান্ত, সুন্দর এক স্বাধীন দেশ। চোগিয়াল রাজবংশের অধীনে এই দেশটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা নিয়ে টিকে ছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাজী লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতের আগ্রাসী নীতির ফলে সিকিম তার স্বাধীনতা হারায় এবং ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত হয়। এটি শুধু একটি দেশের স্বাধীনতা হারানোর কাহিনি নয়, এটি দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং আঞ্চলিক রাজনীতির আগ্রাসী বাসনা পূরণের এক নোংরা খেলার করুণ পরিণতি।
কাজী লেন্দুপ দর্জি ছিলেন সিকিমের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। প্রাথমিকভাবে তিনি চোগিয়ালদের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ভারতের মদতপুষ্টতা তাকে দেশদ্রোহীর পথে ঠেলে দেয়। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং’ (RAW) লেন্দুপ দর্জির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং তাকে সিকিমের চোগিয়াল শাসন উৎখাত করে ভারতে যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। লেন্দুপ দর্জিকে ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির লোভ দেখানো হয়, যার কাছে তিনি সহজেই বিক্রি হয়ে যান।
১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকেই সিকিমে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বাধীন ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’ চোগিয়াল রাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন এবং আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনকে ভারত সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন জোগায়। ১৯৭৪ সালে সিকিমে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে লেন্দুপ দর্জির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং লেন্দুপ প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময়েই ভারতের হস্তক্ষেপ আরো প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ৯ এপ্রিল লেন্দুপ দর্জির আহ্বানে ভারতীয় সেনাবাহিনী সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক দখল করে নেয় এবং চোগিয়াল রাজা পালডেন থন্ডুপ নামগিয়ালকে গৃহবন্দি করে। এরপর একটি তথাকথিত ‘গণভোটের’ আয়োজন করা হয়। সেই গণভোট ছিল সম্পূর্ণ প্রহসনমূলক এবং অনৈতিক। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে এবং ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে গণভোটের ফলাফল ভারতের পক্ষে নিয়ে আসা হয়, যেখানে দেখানো হয় যে সিকিমের জনগণ ভারতে যোগ দিতে ইচ্ছুক। এই গণভোটের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু ভারত সরকার তা উপেক্ষা করে। ১৪ এপ্রিল, ১৯৭৫ সালে, ভারতীয় পার্লামেন্টে একটি বিল পাস করে সিকিমকে ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত করা হয়। লেন্দুপ দর্জি, যার বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই সিকিম তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল, ভারতের অনুগ্রহে সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন। সিকিমের ভারতের অন্তর্ভুক্তির ফলে এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সিকিম তার স্বতন্ত্র পরিচয় হারায় এবং ভারতীয় শাসনের অধীনে চলে যায়। এ ঘটনা সিকিমের জনগণের মনে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করে, যা আজও সম্পূর্ণরূপে প্রশমিত হয়নি। লেন্দুপ দর্জির নাম সিকিমের ইতিহাসে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে, যিনি ক্ষমতার লোভে নিজের দেশকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
এ ঘটনা শুধু সিকিমের জন্য নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর জন্যও একটি সতর্কবার্তা। এটি দেখিয়ে দেয় যে কীভাবে বৃহত্তর শক্তিগুলো ছোট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে। সিকিমের পতনকে আজও ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণ করা হয়, যা লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতের আগ্রাসী নীতির ফল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক পরিচালক অশোক রায়না তার বই ‘ইনসাইড স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’-এ উল্লেখ করেছেন, ভারত ১৯৭১ সালেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। এই লক্ষ্যে সিকিমে আন্দোলন, হত্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়।
স্বাধীনতা হারানোর আগে সিকিম জাতিসংঘের সদস্য পদভুক্তিরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে ভারতের হস্তক্ষেপে সিকিম জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়নি। ভারতের সিকিম অধিকার করার আগে বা পরে জাতিসংঘ সরাসরি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
সিকিম ঐতিহাসিকভাবে চীনের তিব্বতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল। সিকিম ভারতের অংশ হওয়ার পর চীন প্রথমদিকে এর বিরোধিতা করে। তারা এটিকে ‘অবৈধ’ এবং ‘আগ্রাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। চীন দীর্ঘকাল সিকিমকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বিশেষ করে ২০০৩ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর চীন সফরের সময়, উভয় দেশ একে অপরের সীমান্ত-সংক্রান্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে আলোচনা করে। ২০০৫ সালে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে সিকিমকে ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যদিও এর পেছনের কারণ ছিল উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত-বাণিজ্য ও অন্যান্য ভূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সমঝোতা।
সিকিম ইস্যুতে অন্যান্য পরাশক্তি, যেমনÑযুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং রাশিয়াও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তারা কেউই ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়নি বা সিকিমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জোরালো কোনো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেনি।
লেন্দুপ দর্জি সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পদে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। সিকিমের ভারতভুক্তির পর তার দলের প্রতি জনগণের ঘৃণা এতটাই প্রবল হয় যে, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তার দল কোনো আসনই পায়নি। এমনকি, ভোটার তালিকায় তার নিজের নামটাও ছিল না। জীবনের শেষপর্যায়ে তিনি নিঃসঙ্গ ও অপমানিত জীবনযাপন করেন। একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধী তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেও, কাজ ফুরালে কাজীকে ‘ডাস্টবিনে নিক্ষেপ’ করা হয় বলে তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন। কয়েক বছর ধরে যকৃতের রোগে ভোগার পর ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই ১০২ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পংয়ে নিজগৃহে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান লেন্দুপ দর্জি। তার মৃত্যুর পর সিকিমের মানুষ তার প্রতি কোনো সহানুভূতির বদলে ঘৃণা প্রকাশ করেছিল।
ইতিহাসের পাতা থেকে এখন বর্তমানে এবং নিজের দেশে ফিরে আসি। হাসিনার আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমের করাল গ্রাসে এক দশক প্রকাশনা বন্ধ ছিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার। ওই রেজিম পতনের পর নতুন করে প্রকাশনা শুরু করে আমার দেশ। ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর পুনঃপ্রকাশিত আমার দেশের প্রধান সংবাদটির শিরোনাম ছিল : ‘দিল্লিকে ঢাকা অ্যাটাক করতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা।’ খবরটিতে জানানো হয়েছিল, ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে ভারতে পালানোর আগে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট সকালে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ফোন করে ঢাকার ওপর দিল্লির হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। দিল্লির সহায়তা চাওয়ার আগে তিনি দেশে সামরিক শাসন কিংবা জরুরি অবস্থা জারির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কারণ, পরিস্থিতি খুব প্রতিকূল হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা তার প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
আমার দেশ অনুসন্ধান চালিয়ে আরো জানতে পেরেছিল, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে শেখ হাসিনার অন্তত দুবার কথা হয়। দোভাল অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেন এবং শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে ভারতীয় সেনাপ্রধান টেলিফোনে কথা বলেন বলেও অনুসন্ধানে জানতে পারে আমার দেশ। অর্থাৎ চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে সাময়িক আশ্রয় দেওয়াটাই ছিল ভারতের আশু কর্তব্য। পরে হাসিনাকে বাংলাদেশের বৈধ ও নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখিয়ে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাকে মসনদে আবার বসিয়ে দেওয়াই ছিল ভারতের আসল পরিকল্পনা। তাদের হাতে লেন্দুপের মতো হাসিনা ছিল, বাংলাদেশ আক্রমণের জন্য ভারতের প্রতি তার আহ্বান ছিল, হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেননি বলে বশংবদদের মাধ্যমে প্রচারণা ছিল, ভেতরে অগণিত কুইসলিং সক্রিয় ছিল, সব ধরনের সমর প্রস্তুতিও ছিল, তবু ভারত হাসিনার ডাকে কেন বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারল না? এ ক্ষেত্রে সুউচ্চ অটল হিমালয় পর্বতের মতো বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি নাম : ‘মুহাম্মদ ইউনূস’।
সারা দুনিয়ায় বিপুলভাবে নন্দিত ও প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২০২৪ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন হয়। কিন্তু হাসিনার পালানোর পর ড. ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব নেবেন, তখন এটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারত কল্পনাও করেনি। সে সময় বাংলাদেশে ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যারা সক্রিয় ছিলেন, তারাও ইউনূসের বিরোধিতা করে ব্যর্থ হন। আর তাই বাংলাদেশ দখল করতে ভারতের প্রতি হাসিনার আহ্বান সত্ত্বেও শুধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইউনূসের প্রভাবের কারণে ভারত তা করার সাহস পায়নি। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন এমনই এক অধ্যায়, যেখানে ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুনর্জাগরণ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোড়ন তোলে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দেয়।
দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণসমাজ, ২০২৪ সালে তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। হাসিনার সরকারের দমননীতি, দুর্নীতি এবং গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে লাখো ছাত্র-জনতা। এই গণঅভ্যুত্থান একটি ঐতিহাসিক পরিণতির দিকে গড়ায়, যার ফলে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ঘটে এবং তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু তার পতনের পর দেশ যখন এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আস্থা ও সম্মান অর্জনকারী একমাত্র নেতা হিসেবে উঠে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একজন নীতিবান, দুর্নীতিমুক্ত এবং মানবিক অর্থনীতির প্রবক্তা হিসেবে তার নেতৃত্ব জাতিকে নতুন এক দিশা দেখায়। ইউনূসের হাতে দেশের নেতৃত্ব যাওয়া ছিল ভারতের বর্তমান নেতৃত্বের জন্য এক বড় ধাক্কা, কারণ তারা ধরে নিয়েছিল, হাসিনার শাসনের অবসান হলেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ তারা সহজেই ধরে রাখতে পারবে।
ভারতের এই কল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয় ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা। তিনি শুধু একজন অর্থনীতিবিদ বা সমাজসেবক নন, বরং বিশ্বের চোখে একজন নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক। তার আহ্বানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো একসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার পক্ষে সোচ্চার হয়। ভারতের মধ্যে থাকা কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশে নিজেদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তারা ইউনূসের অবস্থানকে দুর্বল করতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। কারণ, ইউনূসের জনপ্রিয়তা শুধু বাংলাদেশের মাটিতেই নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও অপ্রতিরোধ্য। হাসিনাকে শিখণ্ডি হিসেবে বসিয়ে রেখে বাংলাদেশে পরোক্ষভাবে দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল ভারত। সেই অধীনতামূলক মিত্রতার সম্পর্কের জের ধরে এদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন, রাজনীতি, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারাঙ্গন, মিডিয়া এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে আছে ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীরা। আমরা জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে সশস্ত্র বাহিনী পুষি। দুর্ভাগ্য, এদেশেরই সেনাপ্রধান, একুশ শতকের মীরজাফর জেনারেল মঈনের ‘এক-এগারো চক্রান্তের’ পথ ধরেই বাংলাদেশে নতুন করে ভারতীয় কর্তৃত্ব স্থাপনের সূত্রপাত হয়েছিল। এই অবস্থায় সুযোগ্য টিমের আকালে ক্লিষ্ট ড. ইউনূস রাষ্ট্র পরিচালনা ও পুনর্গঠনে কতটা সফল হবেন তা নিয়ে আমার নিজেরও সংশয় আছে। তবে লেন্দুপের অপচেষ্টা, অতিকায় প্রতিবেশীর পরিকল্পনা, ধুন্ধুমার অপপ্রচারণা এবং ব্যাপক অন্তর্ঘাতমূলক নাশকতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এই মানুষটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পতাকা উড্ডীন রেখেছেন। নিঃসঙ্গ শেরপার মতো উপত্যকায় দাঁড়িয়ে সেই পতাকা তিনি একাই দোলাচ্ছেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে তার এই ভূমিকা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে দেদীপ্যমান থাকবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com
এই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশে দুটি নাম বোধ করি স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত। এর একটি নামের মানুষের লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতায় আঠারো শতকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার স্বাধীনতা সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে আসা ব্রিটিশ বেনিয়াদের করতলগত হয়। সেই ঘৃণিত নামটি হচ্ছে মীর জাফর আলী খান। আরেকটি নাম কাজী লেন্দুপ দর্জি। নিজের জন্মভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিংশ শতাব্দীতে এই ঘৃণিত লোকটি স্বাধীন ক্ষুদ্র সিকিম দেশটি তুলে দেয় অতিকায় পড়শি রাষ্ট্র ভারতের হাতে। আসুন, গোড়াতেই খুব সংক্ষেপে জেনে নিই সিকিমের স্বাধীনতা হারানোর বেদনাভরা গল্পটি।
সিকিম ছিল হিমালয়ের কোলে অবস্থিত শান্ত, সুন্দর এক স্বাধীন দেশ। চোগিয়াল রাজবংশের অধীনে এই দেশটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা নিয়ে টিকে ছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাজী লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতের আগ্রাসী নীতির ফলে সিকিম তার স্বাধীনতা হারায় এবং ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত হয়। এটি শুধু একটি দেশের স্বাধীনতা হারানোর কাহিনি নয়, এটি দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং আঞ্চলিক রাজনীতির আগ্রাসী বাসনা পূরণের এক নোংরা খেলার করুণ পরিণতি।
কাজী লেন্দুপ দর্জি ছিলেন সিকিমের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। প্রাথমিকভাবে তিনি চোগিয়ালদের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ভারতের মদতপুষ্টতা তাকে দেশদ্রোহীর পথে ঠেলে দেয়। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং’ (RAW) লেন্দুপ দর্জির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং তাকে সিকিমের চোগিয়াল শাসন উৎখাত করে ভারতে যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। লেন্দুপ দর্জিকে ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির লোভ দেখানো হয়, যার কাছে তিনি সহজেই বিক্রি হয়ে যান।
১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকেই সিকিমে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বাধীন ‘সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস’ চোগিয়াল রাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন এবং আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনকে ভারত সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন জোগায়। ১৯৭৪ সালে সিকিমে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে লেন্দুপ দর্জির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং লেন্দুপ প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময়েই ভারতের হস্তক্ষেপ আরো প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ৯ এপ্রিল লেন্দুপ দর্জির আহ্বানে ভারতীয় সেনাবাহিনী সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক দখল করে নেয় এবং চোগিয়াল রাজা পালডেন থন্ডুপ নামগিয়ালকে গৃহবন্দি করে। এরপর একটি তথাকথিত ‘গণভোটের’ আয়োজন করা হয়। সেই গণভোট ছিল সম্পূর্ণ প্রহসনমূলক এবং অনৈতিক। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে এবং ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে গণভোটের ফলাফল ভারতের পক্ষে নিয়ে আসা হয়, যেখানে দেখানো হয় যে সিকিমের জনগণ ভারতে যোগ দিতে ইচ্ছুক। এই গণভোটের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু ভারত সরকার তা উপেক্ষা করে। ১৪ এপ্রিল, ১৯৭৫ সালে, ভারতীয় পার্লামেন্টে একটি বিল পাস করে সিকিমকে ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত করা হয়। লেন্দুপ দর্জি, যার বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই সিকিম তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল, ভারতের অনুগ্রহে সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন। সিকিমের ভারতের অন্তর্ভুক্তির ফলে এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সিকিম তার স্বতন্ত্র পরিচয় হারায় এবং ভারতীয় শাসনের অধীনে চলে যায়। এ ঘটনা সিকিমের জনগণের মনে গভীর ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করে, যা আজও সম্পূর্ণরূপে প্রশমিত হয়নি। লেন্দুপ দর্জির নাম সিকিমের ইতিহাসে একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে, যিনি ক্ষমতার লোভে নিজের দেশকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
এ ঘটনা শুধু সিকিমের জন্য নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর জন্যও একটি সতর্কবার্তা। এটি দেখিয়ে দেয় যে কীভাবে বৃহত্তর শক্তিগুলো ছোট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে। সিকিমের পতনকে আজও ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণ করা হয়, যা লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতের আগ্রাসী নীতির ফল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক পরিচালক অশোক রায়না তার বই ‘ইনসাইড স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’-এ উল্লেখ করেছেন, ভারত ১৯৭১ সালেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। এই লক্ষ্যে সিকিমে আন্দোলন, হত্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়।
স্বাধীনতা হারানোর আগে সিকিম জাতিসংঘের সদস্য পদভুক্তিরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে ভারতের হস্তক্ষেপে সিকিম জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়নি। ভারতের সিকিম অধিকার করার আগে বা পরে জাতিসংঘ সরাসরি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
সিকিম ঐতিহাসিকভাবে চীনের তিব্বতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল। সিকিম ভারতের অংশ হওয়ার পর চীন প্রথমদিকে এর বিরোধিতা করে। তারা এটিকে ‘অবৈধ’ এবং ‘আগ্রাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। চীন দীর্ঘকাল সিকিমকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বিশেষ করে ২০০৩ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর চীন সফরের সময়, উভয় দেশ একে অপরের সীমান্ত-সংক্রান্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে আলোচনা করে। ২০০৫ সালে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে সিকিমকে ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যদিও এর পেছনের কারণ ছিল উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত-বাণিজ্য ও অন্যান্য ভূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সমঝোতা।
সিকিম ইস্যুতে অন্যান্য পরাশক্তি, যেমনÑযুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং রাশিয়াও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তারা কেউই ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়নি বা সিকিমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জোরালো কোনো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেনি।
লেন্দুপ দর্জি সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পদে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। সিকিমের ভারতভুক্তির পর তার দলের প্রতি জনগণের ঘৃণা এতটাই প্রবল হয় যে, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তার দল কোনো আসনই পায়নি। এমনকি, ভোটার তালিকায় তার নিজের নামটাও ছিল না। জীবনের শেষপর্যায়ে তিনি নিঃসঙ্গ ও অপমানিত জীবনযাপন করেন। একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধী তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেও, কাজ ফুরালে কাজীকে ‘ডাস্টবিনে নিক্ষেপ’ করা হয় বলে তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন। কয়েক বছর ধরে যকৃতের রোগে ভোগার পর ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই ১০২ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পংয়ে নিজগৃহে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান লেন্দুপ দর্জি। তার মৃত্যুর পর সিকিমের মানুষ তার প্রতি কোনো সহানুভূতির বদলে ঘৃণা প্রকাশ করেছিল।
ইতিহাসের পাতা থেকে এখন বর্তমানে এবং নিজের দেশে ফিরে আসি। হাসিনার আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমের করাল গ্রাসে এক দশক প্রকাশনা বন্ধ ছিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার। ওই রেজিম পতনের পর নতুন করে প্রকাশনা শুরু করে আমার দেশ। ২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর পুনঃপ্রকাশিত আমার দেশের প্রধান সংবাদটির শিরোনাম ছিল : ‘দিল্লিকে ঢাকা অ্যাটাক করতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা।’ খবরটিতে জানানো হয়েছিল, ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে ভারতে পালানোর আগে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট সকালে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ফোন করে ঢাকার ওপর দিল্লির হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। দিল্লির সহায়তা চাওয়ার আগে তিনি দেশে সামরিক শাসন কিংবা জরুরি অবস্থা জারির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কারণ, পরিস্থিতি খুব প্রতিকূল হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা তার প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
আমার দেশ অনুসন্ধান চালিয়ে আরো জানতে পেরেছিল, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে শেখ হাসিনার অন্তত দুবার কথা হয়। দোভাল অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেন এবং শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে ভারতীয় সেনাপ্রধান টেলিফোনে কথা বলেন বলেও অনুসন্ধানে জানতে পারে আমার দেশ। অর্থাৎ চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে সাময়িক আশ্রয় দেওয়াটাই ছিল ভারতের আশু কর্তব্য। পরে হাসিনাকে বাংলাদেশের বৈধ ও নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখিয়ে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাকে মসনদে আবার বসিয়ে দেওয়াই ছিল ভারতের আসল পরিকল্পনা। তাদের হাতে লেন্দুপের মতো হাসিনা ছিল, বাংলাদেশ আক্রমণের জন্য ভারতের প্রতি তার আহ্বান ছিল, হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেননি বলে বশংবদদের মাধ্যমে প্রচারণা ছিল, ভেতরে অগণিত কুইসলিং সক্রিয় ছিল, সব ধরনের সমর প্রস্তুতিও ছিল, তবু ভারত হাসিনার ডাকে কেন বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারল না? এ ক্ষেত্রে সুউচ্চ অটল হিমালয় পর্বতের মতো বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি নাম : ‘মুহাম্মদ ইউনূস’।
সারা দুনিয়ায় বিপুলভাবে নন্দিত ও প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২০২৪ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন হয়। কিন্তু হাসিনার পালানোর পর ড. ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব নেবেন, তখন এটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারত কল্পনাও করেনি। সে সময় বাংলাদেশে ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যারা সক্রিয় ছিলেন, তারাও ইউনূসের বিরোধিতা করে ব্যর্থ হন। আর তাই বাংলাদেশ দখল করতে ভারতের প্রতি হাসিনার আহ্বান সত্ত্বেও শুধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইউনূসের প্রভাবের কারণে ভারত তা করার সাহস পায়নি। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন এমনই এক অধ্যায়, যেখানে ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুনর্জাগরণ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোড়ন তোলে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দেয়।
দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণসমাজ, ২০২৪ সালে তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। হাসিনার সরকারের দমননীতি, দুর্নীতি এবং গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে লাখো ছাত্র-জনতা। এই গণঅভ্যুত্থান একটি ঐতিহাসিক পরিণতির দিকে গড়ায়, যার ফলে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ঘটে এবং তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু তার পতনের পর দেশ যখন এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আস্থা ও সম্মান অর্জনকারী একমাত্র নেতা হিসেবে উঠে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একজন নীতিবান, দুর্নীতিমুক্ত এবং মানবিক অর্থনীতির প্রবক্তা হিসেবে তার নেতৃত্ব জাতিকে নতুন এক দিশা দেখায়। ইউনূসের হাতে দেশের নেতৃত্ব যাওয়া ছিল ভারতের বর্তমান নেতৃত্বের জন্য এক বড় ধাক্কা, কারণ তারা ধরে নিয়েছিল, হাসিনার শাসনের অবসান হলেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ তারা সহজেই ধরে রাখতে পারবে।
ভারতের এই কল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয় ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা। তিনি শুধু একজন অর্থনীতিবিদ বা সমাজসেবক নন, বরং বিশ্বের চোখে একজন নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক। তার আহ্বানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো একসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার পক্ষে সোচ্চার হয়। ভারতের মধ্যে থাকা কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশে নিজেদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তারা ইউনূসের অবস্থানকে দুর্বল করতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। কারণ, ইউনূসের জনপ্রিয়তা শুধু বাংলাদেশের মাটিতেই নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও অপ্রতিরোধ্য। হাসিনাকে শিখণ্ডি হিসেবে বসিয়ে রেখে বাংলাদেশে পরোক্ষভাবে দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল ভারত। সেই অধীনতামূলক মিত্রতার সম্পর্কের জের ধরে এদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন, রাজনীতি, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারাঙ্গন, মিডিয়া এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে আছে ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীরা। আমরা জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে সশস্ত্র বাহিনী পুষি। দুর্ভাগ্য, এদেশেরই সেনাপ্রধান, একুশ শতকের মীরজাফর জেনারেল মঈনের ‘এক-এগারো চক্রান্তের’ পথ ধরেই বাংলাদেশে নতুন করে ভারতীয় কর্তৃত্ব স্থাপনের সূত্রপাত হয়েছিল। এই অবস্থায় সুযোগ্য টিমের আকালে ক্লিষ্ট ড. ইউনূস রাষ্ট্র পরিচালনা ও পুনর্গঠনে কতটা সফল হবেন তা নিয়ে আমার নিজেরও সংশয় আছে। তবে লেন্দুপের অপচেষ্টা, অতিকায় প্রতিবেশীর পরিকল্পনা, ধুন্ধুমার অপপ্রচারণা এবং ব্যাপক অন্তর্ঘাতমূলক নাশকতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এই মানুষটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পতাকা উড্ডীন রেখেছেন। নিঃসঙ্গ শেরপার মতো উপত্যকায় দাঁড়িয়ে সেই পতাকা তিনি একাই দোলাচ্ছেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে তার এই ভূমিকা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে দেদীপ্যমান থাকবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন এক অববাহিকায় অবস্থিত, যার ওপর প্রভাব ফেলে প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে ভারতের নদী ব্যবস্থাপনা। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়, বিশেষ করে ভারতের উজানে অপ্রত্যাশিতভাবে পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে।
১৮ ঘণ্টা আগেঈদের আগে ৪ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে নির্বাচন ইস্যুতে এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে হয়েছিল। সভাটি মূলত ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর চাপ তৈরির অংশ হিসেবেই আয়োজন করা হয় বলে মনে হয়েছে। বিএনপির প্রথম সারির কয়েকজন নেতা ছাড়াও সমমনা প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীরা এতে অংশ নেন।
১৮ ঘণ্টা আগেএকবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
২ দিন আগেঅধিকৃত কাশ্মীরে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলাগুলোকে পুঁজি করে প্রায় এক দশক ধরেই ভারত চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে কোণঠাসা ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলার।
২ দিন আগে