দক্ষিণ এশিয়ায় বেইজিংয়ের ত্রিমুখী কূটনীতি

মো. ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৫: ১১

বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে একদিকে যেমন পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন একমুখী বিশ্বব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়েছে, অন্যদিকে উদীয়মান শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে নতুন আঞ্চলিক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যকার রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না ত্রিপক্ষীয় ফোরাম পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ এবং একই সঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বেইজিংয়ের সক্রিয় ভূমিকা—এই দুই কূটনৈতিক ঘটনা প্রমাণ করে, চীন এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

পরিত্যক্ত কাঠামোর পুনর্জন্ম

বিজ্ঞাপন

১৯৯৬ সালে তৎকালীন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভজেনি প্রিমাকভ RIC ফোরামের ধারণা দেন। এরপর ২০০২ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আরো উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়, যেখানে তিন দেশের শীর্ষ নেতারা অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ২০১৯ সালে গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সংঘর্ষের পর থেকে এই ফোরাম কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

চলতি বছরের ১৭ জুলাই বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ‘চীন, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতা শুধু তিন দেশের স্বার্থে নয়, বরং এটি বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক।’ এই বক্তব্যের সূত্রপাত রুশ উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুদেনকোর একটি ঘোষণার পর, যেখানে তিনি জানান, রাশিয়া RIC ফোরাম আবার চালু করার ব্যাপারে কাজ করছে এবং চীন-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে এটি আবার শুরু হতে পারে।

তবে এটি নিছকই প্রতীকী কোনো প্রচেষ্টা নয়। বরং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে, সেখানে রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না ত্রিপক্ষীয় ফোরামকে একটি বিকল্প আঞ্চলিক মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় বেইজিং ও মস্কো। চীন চাইছে ভারসাম্যপূর্ণ বহুপাক্ষিকতার দিকে এগিয়ে যেতে, আর রাশিয়া তার পশ্চিমা বিচ্ছিন্নতার পর বৈপ্লবিকভাবে এশিয়ায় ঘুঁটি সাজাচ্ছে।

ভারতের অবস্থান তুলনামূলকভাবে জটিল। একদিকে তারা কোয়াডের সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন রয়েছে। তবু ভারতের কূটনৈতিক বাস্তবতা হয়তো তাকে RIC-এর মতো ফোরামে অংশ নিতে বাধ্য করতে পারে, বিশেষত যদি এর মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুরক্ষিত হয়।

পাকিস্তান-আফগানিস্তান কাছাকাছি

২০২৫ সালের ২১ মে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এক অনানুষ্ঠানিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান অংশ নেয়। এই বৈঠকের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো—চার বছর পর ইসলামাবাদ ও কাবুল আবারও পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সম্মত হয়েছে। এর আগে পাকিস্তান প্রায় ১০ লাখ ‘অবৈধ’ আফগান অভিবাসীকে ফেরত পাঠায়, যা দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল তৈরি করে।

চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার প্রস্তাব—এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল। এই অর্থনৈতিক উদ্যোগ কেবল বাণিজ্যিক উন্নয়ন নয়, বরং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, সীমান্তে স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতেও কার্যকর হতে পারে।

চীন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে আরো বিস্তৃত করতে চায়। আফগানিস্তান পর্যন্ত সিপিইসি সম্প্রসারিত হলে তা একদিকে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের রেল ও সড়ক যোগাযোগ তৈরি করবে, অন্যদিকে আফগান ভূখণ্ড চীনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় করিডোর হিসেবে গড়ে উঠবে।

নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ ও অবিশ্বাস

তবে এই কূটনৈতিক অগ্রগতি এখনো অসম্পূর্ণ। বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ বা আফগান অভিবাসী ইস্যু নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়নি। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, আফগানিস্তান সীমান্তের ভেতর থেকে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান সদস্যরা তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে। আফগান তালেবান যদিও সরাসরি জড়িত নয়, কিন্তু দুই গোষ্ঠীর আদর্শিক ঘনিষ্ঠতা বিষয়টিকে আরো স্পর্শকাতর করে তোলে।

চীনের উদ্বেগের জায়গাও আলাদা নয়। ২০২১ সাল থেকে পাকিস্তানে চীনা নাগরিকদের ওপর হামলায় অন্তত ২০ জন নিহত হন, যার দায় নিয়েছে টিটিপি ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠী। তাছাড়া চীন আফগানিস্তানে পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, যারা চীনা ভূখণ্ডে হামলার পরিকল্পনায় যুক্ত বলে বেইজিং দাবি করে।

চীনের কৌশলগত কূটনীতি কি কার্যকর হবে?

চীনের কূটনীতির এ নতুন রূপ শুধু বৈঠক বা চুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি এমন এক আঞ্চলিক কাঠামো নির্মাণের প্রচেষ্টা, যা পশ্চিমা মডেলের বিকল্প হতে পারে। এই কাঠামোয় আছে—অর্থনৈতিক সংযোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা, আস্থাভিত্তিক মধ্যস্থতা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ নীতিতে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি।

তবে এই কাঠামো সফল হতে হলে তিনটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি—১. নিরাপত্তা ইস্যুতে খোলামেলা আলোচনা ও সমাধান। ২. প্রকল্পগুলোয় স্বচ্ছতা ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ।
৩. দ্বিপক্ষীয় অবিশ্বাস দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা নির্মাণ।

চীন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় এক নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে শুধু বিনিয়োগকারী হিসেবে নয়, বরং মধ্যস্থতাকারী ও স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী শক্তি হিসেবেও। রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না ত্রিপক্ষীয় ফোরাম পুনরুজ্জীবন ও পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মধ্য দিয়ে বেইজিং একটি কৌশলগত বার্তা দিয়েছে যে, তারা বিশ্বরাজনীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চায়, যেখানে দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব নয়, বরং বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও আন্তঃনির্ভরশীলতাই ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি হবে।

লেখক : ‘ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা’র একজন ভিজিটিং স্কলার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপিতে পলিটিক্যাল সায়েন্সে উচ্চশিক্ষারত

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত