ভারতের আওয়ামী পুনর্বাসন প্রকল্প

ডা. ওয়াজেদ খান
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫১
ডা. ওয়াজেদ খান

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। ইতিহাসের নজিরবিহীন এই ঘটনায় দলীয় নেতাসহ তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। এদিকে দেশে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় হবে সহসাই। তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ডজন ডজন মামলা বিচারাধীন। হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকারের দাবি আমলে নেয়নি ভারত। সম্ভাব্য ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়ে হাসিনা দেশে ফিরবেন, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তা আওয়ামী মহল থেকে যত অপপ্রচারই চালানো হোক না কেন। এছাড়া দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ কিংবা রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনাও নেই। তবে অদূর ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং দলটির পুনর্বাসনের একমাত্র পথ হয়ে উঠতে পারে নির্বাচন। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসিত হবেÑঅতীত ইতিহাস এমন সাক্ষ্য দেয় না। কেন নির্বাচন এবং নির্বাচনই হতে পারে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের একমাত্র উপায়Ñএমন ধারণা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই যৌক্তিক।

নির্বাচনের সঙ্গে আওয়ামী পুনর্বাসনের সম্পর্ক

বিজ্ঞাপন

নানা কারণেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দাঁড়িয়েছে জাতীয় রাজনৈতিক জীবনের টার্নিং পয়েন্টে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ কি আবার রাজনীতির পুরোনো পথেই হাঁটবে? নাকি জুলাই সনদের ভিত্তিতে এগোবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে ব্যর্থ হলে এর দায়ভার বহন করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেই। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে শুধু দেশের রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, অতীতের মতো ভারত এবারও হাতে নিয়েছে বড় ধরনের প্রকল্প। ভারত শেখ হাসিনাকে এই মুহূর্তে প্রত্যাবর্তন করাতে না পারলেও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তার দল আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের। এ জন্য দেশটি বেছে নিয়েছে ফেব্রুয়ারির ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যে কারণে চব্বিশের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই ভারত বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে আসছে। এমনকি দেশটির সেনাপ্রধান ও অন্য কর্মকর্তারা বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের কথা উল্লেখ করছেন বারবার। ভারত এ জন্য কৌশলী ছক এঁকেছে। আশ্রয় নিয়েছে চাণক্যনীতির। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারেÑএমন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইতোমধ্যেই বোঝাপাড়া হয়েছে দেশটির। যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে আওয়ামী শাসনামলের মতো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলবে ভারতের সঙ্গে। রক্ষা করবে ভারতের সব স্বার্থ। যার অন্যতম শর্ত হবে হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। এ জন্য ভারত সব ধরনের সহযোগিতা দেবে দলটিকে নির্বাচনে বিজয়ী হতে। নির্বাচনে আওয়ামী ভোটব্যাংকও ক্যাশ করার অবাধ সুযোগ পাবে দলটি।

এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের পছন্দনীয় রাজনৈতিক দল কোনটি এবং দৃশ্যত কোন দলের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী অবশ্যই ভারতের পছন্দের দল নয়। তাছাড়া পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের বিষয়টি নিশ্চিত। ফলে উঠে আসে বিএনপির নাম। বিগত প্রায় দেড় যুগ ধরে বিএনপি নেতৃত্বের একটি প্রভাবশালী অংশ নানাভাবে চেষ্টা করেছেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে। যারা দলের অভ্যন্তরে কাজও করছেন ভারতের স্বার্থের পক্ষে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের অবর্তমানে মহলটি এখন অনেকটাই সক্রিয়। এরাই ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বাহাত্তর ঘণ্টা না পেরোতেই নব্বই দিনের মধ্যে দাবি জানান নির্বাচনের। জিকির তোলেন দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের। রাষ্ট্র সংস্কার, ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার এবং গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসনের চেয়ে তারা বড় করে দেখতে থাকেন নির্বাচনকে। কারণ দলটি জানে যত দ্রুত নির্বাচন হবে, তত দ্রুত তারা আরোহণ করতে পারবেন ক্ষমতার মসনদে। তাছাড়া যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী এ দলটি। কিন্তু নানামুখী চাপে বিএনপিকে বাধ্য হতে হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় যোগদান এবং জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে। এর আগে গত জুনে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমঝোতা হয় লন্ডনে। এর মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের নিজ সরকারের মেয়াদকাল দীর্ঘায়িত করার যে পরিকল্পনা ছিল, তা ভেস্তে যায়। সরকারের গুটিকয় উপদেষ্টা এই সমঝোতার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিএনপি সরকারে নিশ্চিত করে নিয়েছেন নিজেদের নিরাপদ অবস্থান।

দায়মুক্তির নির্বাচনে আগ্রহী যারা

আসন্ন নির্বাচন ঘিরে শুধু আওয়ামী পুনর্বাসনের ভারতীয় প্রকল্পই নয়, নিজেদের দায়মুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা। বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট আমলের সুবিধাভোগী সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা, সরকারি আমলা, বড় ব্যবসায়ী, সংবাদমাধ্যম, একশ্রেণির সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী, যারা প্রচণ্ড চাপে আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। গুম, খুন, দুর্নীতি, অর্থপাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী যারা এখনো আইনের আওতায় আসেননি, এখন তাদের রাত কাটছে নির্ঘুম। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা পিছু ছাড়ছে না তাদের। কখন কার ডাক পড়ে, কোন অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। কোনোভাবেই ড. ইউনূস সরকারের ওপর বিশ্বাসী হতে পারছে না তারা। রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থবিত্তের মালিক এই শ্রেণির একমাত্র ভরসা এখন নির্বাচন। তারা ভাবছেন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন সরকার সহনশীল হবে, শ্লথ হয়ে যাবে ধরপাকড় ও মামলা-মোকদ্দমা। বিভিন্ন অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পাবেন তারা। জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবেন বড় বড় রাঘববোয়াল। রাষ্ট্র ফিরে যাবে পূর্বাবস্থায়। তারা ফিরবেন টেনশনমুক্ত নিরাপদ জীবনে। দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকা আওয়ামী নেতারা ফিরবেন স্বদেশে। সচল হয়ে উঠবে বন্ধ থাকা লাখো মোবাইল। দুর্দিনে আওয়ামী লুটেরাদের ধন-সম্পদের রক্ষকরা ফিরবেন সহাবস্থানে। এ জন্য অপেক্ষা শুধু একটি নির্বাচনের। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষ অবস্থানে। এমনকি দলটি চায় ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ। দলটির এমন আওয়ামীপ্রীতি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন জুলাইযোদ্ধারা। এছাড়া জুলাই জাতীয় সনদে রাষ্ট্র সংস্কারের অনেক বিষয়ে আপত্তি রয়েছে বিএনপির। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোট নিয়েও বিএনপির সঙ্গে বড় ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে সরকার ও অন্যান্য দলের সঙ্গে। ফলে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এ ব্যাপারে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে দেখা দিতে পারে বড় ধরনের সংকট। অনেকের আশঙ্কা, ওয়ান-ইলেভেন স্টাইলে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এগোতে পারে রাষ্ট্র। দীর্ঘ সময় ধরে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী। এর অবসান চায় তারা। তাছাড়া সেনা কর্মকর্তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে পুরো বাহিনী। এসব কারণে সেনাবাহিনীর কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দ্রুত নির্বাচনের বিষয়টি। গত ৫ নভেম্বর সেনা সদরে সেনাবাহিনী সংবাদ সম্মেলন করেছে এ প্রসঙ্গে।

ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং ঐতিহাসিক নির্বাচন অবশ্যই জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো, জনগণ, নির্বাচন কমিশন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্মোহভাবে কাজ করতে হবে। কোনো দেশি-বিদেশি শক্তির প্রভাব, প্রাধান্য এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ যেন নির্বাচন বাধাগ্রস্ত না করে, অবশ্যই তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন বা চক্রান্ত নির্বাচন যাতে প্রভাবিত না করে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে দেশবাসীকে। ভুলে গেলে চলবে না যে, নির্বাচন হলেই দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। যেমনটি হয়নি বিগত ১২টি সংসদ নির্বাচনের পর ৫৪ বছরে। ত্রয়োদশ নির্বাচনের পর এমনটি না হওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের একজন নেতাও এখন পর্যন্ত চব্বিশের গণহত্যা, গুম-খুনের জন্য মাফ চাওয়া তো দূরের কথা, এ জন্য তারা সামান্যতম অনুতপ্ত নন। গণহত্যার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না দলটি। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা দলের দায়মুক্তি ও পুনর্বাসনের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে না কিছুতেই। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের অপরাধ কর্মের দায় সংশ্লিষ্ট বাহিনী বা প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপানোর সুযোগ নেই। মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মে জড়িত ও সহায়তাকারীদের অবশ্যই জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও আইন-আদালত মেনে রাজনীতির স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত