আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়া

এক সতর্ক ঘণ্টা

সরদার ফরিদ আহমদ
এক সতর্ক ঘণ্টা
সরদার ফরিদ আহমদ

শরীফ ওসমান হাদি। একটি নাম। একটি মুখ। আবার একটি প্রতীকও। ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র। জুলাই বিপ্লবের সক্রিয় তরুণ সংগঠক। এমন একজন মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন—এটুকুই যথেষ্ট ছিল দেশকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু নাড়া শুধু শোকের নয়; আতঙ্কেরও। প্রশ্নেরও। আর সবচেয়ে বড় একটি সংকেতের।

বিজ্ঞাপন

এক. তরুণ রাজনীতির ওপর হামলা

বাংলাদেশে রাজনীতির ভাষা আজও বন্দুকের ভাষায় অনুবাদ হয়। তর্ক নয়—টার্গেট। বক্তব্য নয়—বুলেট। গণতন্ত্র নয়—গুপ্ত হামলা।

হাদির ওপর হামলা সেই পুরোনো সংস্কৃতিরই আরেক অধ্যায়। তবে বিশেষত্ব আছে। কারণ তিনি মূলত তরুণদের কণ্ঠস্বর। বড় দলের ছত্রছায়ায় বড় হওয়া কোনো নেতা নন।

নিজস্ব অবস্থান, নিজস্ব যুক্তি, নিজস্ব সাহস—এই তিনেই দাঁড়ানো এক কর্মী।

তরুণ রাজনীতির ওপর হামলা মানে ভবিষ্যতের ওপর হামলা। এই হামলা শুধু একজনকে চুপ করানোর প্রচেষ্টা নয়। এটি একটি বার্তা : ‘তুমি প্রশ্ন করলে, তুমি ভিন্ন পথ বেছে নিলে, তুমি স্বতন্ত্র দাঁড়ালে—বুলেট তোমার অপেক্ষায়।’ এটাই ভয়ংকর।

দুই. জনতার প্রতিক্রিয়া—একটি নতুন সামাজিক বাস্তবতা

হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর ছড়াতেই ঢামেকে তরুণদের ঢল। রাজনীতির মাঠে যে উদাসীন প্রজন্মকে খুঁজে পাওয়া যেত না, সেই প্রজন্ম এখন হাসপাতালে ছুটে যায় একজন তরুণ নেতাকে দেখতে। এটা কি সাধারণ ঘটনা? না। এটি একটি সামাজিক মোড়। একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। একটি ইঙ্গিত যে এখনকার যুবসমাজ আর পুরোনো রাজনীতির দর্শক হয়ে থাকতে রাজি নয়।

তারা প্রশ্ন করে। তারা অনুসরণ করে। তারা যুক্তি শোনে এবং তারা প্রতিবাদী কণ্ঠকে রক্ষা করতে চায়—যেভাবেই হোক।

এই পরিবর্তনটি রাজনৈতিক দল বা আধিপত্যবাদের দোসররা এগুলো বুঝতে পারছে কি? নাকি তারা এখনো মনে করছে তরুণরা ‘ফেসবুক জেনারেশন’, ভোটের মাঠে অকার্যকর? ঢাকা মেডিকেলের দৃশ্যই বলে দিয়েছে—তরুণরা আর প্রান্তিক দর্শক নয়। তারা ভবিষ্যতের রাজনীতির কেন্দ্রে। তারা সজাগ এবং তারা ক্ষুব্ধ।

তিন. ভারতের আধিপত্যবাদ প্রশ্ন—এটাই কি হামলার কারণ?

হাদি ভারতের আধিপত্যবাদ নিয়ে সরব। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলে, প্রবন্ধে, লাইভে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন। তার বক্তব্যে তীক্ষ্ণতা আছে। কখনো কখনো কঠোরতাও।

কিন্তু সেগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য—বুলেটের প্রতিক্রিয়া নয়।

আগস্টের পতন ছিল দ্বিমুখী। ফলে পতন শুধু একটি দলের নয়—একটি প্রভাবনির্ভর রাজনীতিও। বছরের পর বছর জমে থাকা ক্ষোভ সেদিন বিস্ফোরিত হয়েছিল। সেই বিস্ফোরণের সামনের সারিতে ছিলেন হাদি। তিনি স্পষ্ট বলতেন—বাংলাদেশ কারো করিডোর নয়। কারো বাজার নয়। কারো নিরাপত্তা বেল্টও নয়।

ভারতের আধিপত্যবাদ নিয়ে হাদি ছিলেন সরব। সংখ্যা, তথ্য ও দলিল—সব এনে প্রশ্ন করেছেন। অসম চুক্তি কেন? একতরফা সুবিধা কেন? সীমান্তে হত্যা কেন? এই প্রশ্ন শুনে অনেকের ঘুম হারাম হয়েছিল। কারণ তিনি কথার মানুষ নন—মাঠের মানুষ। তিনি কাজ করেন। দিনে-রাতে মানুষকে সচেতন করেন। ঘুম ভাঙান। ভাবতে শেখান। জনমত তৈরি করেন।

আগস্টের বিপ্লবের পর হাদি থামেননি। বরং গতি আরো বেড়েছে। তার ভাবনা পরিষ্কার—‘পতন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু প্রভাবের ছায়া এখনো আছে।’

এই ছায়া যেন ফিরে না আসে—এটাই তার লড়াই। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতা মানে শুধু ভৌগোলিক মানচিত্র নয়। স্বাধীনতা মানে নীতি-স্বাধীনতা। মানে মর্যাদা। মানে সমান সম্পর্ক।

হাদি তাই আজ এক সতর্ক-ঘণ্টা। যেন বলছেন—‘জেগে থাকো। শূন্যতার সুযোগে পুরোনো আধিপত্য যেন ফিরে না আসে।’

এটাই তার যজ্ঞ। এটাই তার লড়াই। এটাই তার বার্তা।

বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা মানেই কেউ আপনাকে ‘বিরোধী’, ‘বিপজ্জনক বা ‘উসকানিদাতা’ বলে ফ্রেম করার চেষ্টা করে। এটি নতুন নয়। তবে জুলাই-অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি বদলেছে। এখন এই প্রশ্ন শুধু কয়েকজন ছাত্রনেতার নয়—সাধারণ মানুষেরও।

হাদির ওপর হামলা কি সেই প্রশ্ন তুলেই? নাকি এটি নির্বাচনি প্রতিপক্ষের কৌশল? নাকি এটি একটি অস্থির রাজনৈতিক মাঠের স্বাভাবিক সহিংস পরিণতি?

এখনো আমরা জানি না। কিন্তু জানা কথা—সত্য বলার দরজা বুলেটে বন্ধ করা যায় না। বরং প্রশ্ন আরো বড় হয়, আরো তীব্র হয়, আরো বিস্তৃত হয়।

শরিফ ওসমান হাদি
শরিফ ওসমান হাদি

চার. ইনকিলাব মঞ্চ—একটি নতুন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চের জন্ম। এটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়ার পথে না হলেও, একটি তরুণ সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের বক্তব্যগুলো স্পষ্ট, রূঢ়, কখনো কখনো উত্তপ্ত—তবে অন্তত প্রশ্নহীন নয়।

তাই হাদির ওপর হামলা মানে ইনকিলাব মঞ্চের ওপর হামলা এবং মঞ্চের ওপর হামলা মানে নতুন সামাজিক প্রতিরোধের ওপর হামলা।

এমন হামলা কখনোই একক ঘটনা থাকে না। এটি একটি বার্তা পাঠায় এবং এই বার্তা যদি প্রতিরোধহীন থাকে, তবে পরবর্তী টার্গেটও তৈরি হয়ে যায়।

পাঁচ. রাষ্ট্র, প্রশাসন ও তদন্ত—গতি কোথায়?

যে দেশে একজন সম্ভাব্য প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হন—সেই দেশে তদন্তের গতি নির্ধারণ করে রাজনীতির পরিণতি। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে প্রশ্নগুলো দাঁড়িয়েছে—

কারা হামলাকারী? উদ্দেশ্য কী? হাদি কি আগে হুমকি পেয়েছিলেন? তিনি কি নির্বাচন নিয়ে চাপের মুখে ছিলেন? হামলার স্থানে সিসিটিভি ছিল? সেটি জব্দ হয়েছে?

এই প্রশ্নগুলো সাধারণ মানুষও করছে। সরকার, প্রশাসন, তদন্ত সংস্থা কী করছে—মানুষ সেটি দেখতে চায়। জানতে চায়।

দ্রুত তদন্ত এখানে শুধু আইনগত বিষয় নয়। এটি রাজনৈতিক আস্থার প্রশ্ন। এটি তরুণ সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রশ্ন। এটি নিরাপত্তার প্রশ্ন। এটি নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্ন।

ছয়. তরুণদের কাছে এ ঘটনার বার্তা

হাদির ওপর হামলা একটি বেদনাদায়ক সত্যকে সামনে এনেছে : বাংলাদেশে সত্য বললে শত্রু তৈরি হয়। সাহস দেখালে বুলেট তৈরি হয়। ঐতিহ্যবাহী এবং আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে পরিকল্পিত হামলাও তৈরি হয়।

কিন্তু তরুণরা যেভাবে হাসপাতালে ছুটে গেছে—এটি অন্য বার্তাও দেয় : এই প্রজন্ম ভয় পায় না। তারা নীরব নয়। তারা নতুন নেতৃত্ব চায়—এবং নেতৃত্বকে রক্ষা করতেও প্রস্তুত।

রাজনীতি যদি তরুণদের এই শক্তিকে মূল্য দিতে না শেখে, তবে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব কাঠামো অদ্ভুত রকমের শূন্যতায় পড়বে।

সাত. শেষ কথা

শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলা কোনো ‘আইনশৃঙ্খলার বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নয়। এটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক সংস্কৃতির রোগ। সাহসের ওপর আঘাত।

ভবিষ্যতের পথে বাধা।

এখন প্রয়োজন তিনটি বিষয়—

১. দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত।

২. তরুণ নেতৃত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতার চর্চা থামানো।

হাদি সুস্থ হবেন। হয়তো আরো শক্ত হয়ে ফিরবেন। কিন্তু এই হামলা বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে—আমরা কি এখনো বুলেটের রাজনীতি চাই, নাকি যুক্তির? আধিপত্যবাদ প্রতিরোধে আমরা কী করছি? আমরা কি পুরোনো পথে হাঁটব?

এসব প্রশ্নের উত্তরই আগামী দিনের বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন