মো. হারুন-অর-রশিদ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংক্রামক ক্যানসারে পরিণত হয়েছে খেলাপি ঋণ, ঘুস-দুর্নীতি ও অর্থ পাচার। এই তিন ব্যাধি সম্ভাবনার বাংলাদেশকে বারবার গর্তে নিমজ্জিত করছে। আইনের শাসন বা সুশাসন না থাকায় এখানে সম্পদ অর্জন করা যেমন সহজ, তার চেয়ে বেশি সহজ উন্নত কোনো দেশে সম্পদ পাচার করা। অবৈধ সম্পদকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে নিরাপদ স্থান হিসেবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে বেছে নিচ্ছে দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী। দেশের ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে এবং ক্রমাগত তা বাড়ছে। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় আবহমানকাল ধরে ঘুস-দুর্নীতি চলে আসছে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যম এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেই অর্থ পাচার ক্রমাগত সহজতর হচ্ছে। এতেই বিপদ বাড়ছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের তথা অর্থনীতির মারাত্মক ক্যানসার খেলাপি ঋণ। এই খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি এক দিনে গড়ে ওঠেনি। শাসনব্যবস্থার অরাজকতার কারণে খেলাপি ঋণ মারাত্মক আকার ধারণ করে দেড় যুগে। দেড় যুগে ঋণখেলাপিদের দাপট এতটাই বেশি ছিল, তাদের ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিতই করা যায়নি। ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী—গৃহীত ঋণ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত না দিলে তা খেলাপি তালিকাভুক্ত করা হবে। কিন্তু ১৬ বছরে প্রভাবশালীরা ব্যাংকের ঋণ শুধু গ্রহণ করেছেন কিন্তু ফেরত দেননি। ফেরত না দেওয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর নতুন করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এই ঋণের সমুদয় অর্থ যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোয় পাচার করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলোয় কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় ১৬ জুন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমার দেশ-এ ‘খেলাপি ঋণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা : ৩ মাসে বেড়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের লুকানো খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
খেলাপি ঋণের এই করুণচিত্র প্রকাশিত হওয়ার কয়েক দিন পর সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সরকারি সেবা গ্রহণ করেছেন, এমন নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ৩২ শতাংশ ঘুস-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। প্রতি তিনজনের মধ্যে গড়ে একজনকে ঘুস দিয়ে সেবা নিতে হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানার ৮৪ হাজার ৮০৭ নারী-পুরুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। জরিপের তথ্যানুসারে, সবচেয়ে বেশি ঘুস-দুর্নীতি হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, গত এক বছরে বিআরটিএতে সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকদের ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ ঘুস-দুর্নীতির শিকার হন। এই হার আইন প্রয়োগকারীর সংস্থায় ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ভূমি নিবন্ধন অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতির অর্থের গন্তব্য কোথায়, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের এক বার্ষিক প্রতিবেদনে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বিদেশিদের কী পরিমাণ অর্থ জমা আছে, তার ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২৩ সালে ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ। এক বছরে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৫৭ কোটি ১৮ লাখ ফ্রাঁ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১৪৯ টাকা। সেই হিসাবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ ৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা।
সুইস ব্যাংকের অর্থ জমার হিসাব প্রতিবছর প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এর বাইরে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদন, মালয়েশিয়ান সরকারের মাই সেকেন্ড হোম প্রজেক্ট প্রতিবেদন, পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক আর্থিক দুর্নীতির প্রতিবেদন বাংলাদেশি অর্থ পাচার, কর ফাঁকিবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—এসব প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো এসব তথ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছিল অর্থ পাচার প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এসব তথ্য সম্পর্কে তাদের জানা নেই এবং অর্থ পাচার হচ্ছে এমন কোনো তথ্য, তাদের কাছে নেই বলে বরাবরই দায় এড়িয়ে গেছে বিএফআইইউ।
তবে অর্থ পাচার নিয়ে সরকার বরাবর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে অনেক তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে আমলা ও রাজনীতিবিদরা ঘুস নিয়েছেন আড়াই লাখ কোটি টাকা। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে শেয়ারবাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চাঁদাবাজি ও ঘুস হিসেবে গ্রহণ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং আমলারা।
এই অর্থ পাচারকারীর তালিকায় যেমন বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন, তেমনি আছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি আমলা, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, বিচারপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ অনেকেই। যাদের কিছুটা তথ্য এখন সরকারিভাবে স্বীকার করা হচ্ছে এবং তাদের অর্থ পাচার নিয়ে তদন্ত চলছে। আশার দিক হলো, অন্তত ১০ থেকে ১২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে পাচারের অর্থ সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
অর্থ পাচারের কয়েকটি সহজ পদ্ধতির মধ্যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি কাজ করেন। স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে যারা উপার্জনে উদ্দেশ্যে প্রবাসে রয়েছেন, তারা তাদের অর্থ দেশে পাঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘উইকলি সিলেকটেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছয়ের ১১ মাসে (জুলাই-মে) প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এটি আগের বছরের একসময়ের তুলনায় ২৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। এখানে লক্ষণীয়, বর্তমানে যুদ্ধাক্রান্ত বিশ্বে কারোর বেতন বাড়েনি। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়েছে। আগে রেমিট্যান্স হুন্ডি হতো। দেশের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বৈধ করার জন্য রেমিট্যান্স কেনাবেচা হতো। এতে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং রিজার্ভে টান পড়েছে। অর্থ পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হলে প্রতিবছর রেমিট্যান্সপ্রবাহ ৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
এ কথা সত্য, দুর্নীতিবাজদের শিকড় অনেক গভীরে। তাদের বিস্তার অনেকটা মাকড়সার জালের মতো। বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাদের জিম্মি করার প্রবণতাও বেশি এবং এর নেতিবাচক প্রভাবও বেশি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের ফলে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে দুর্নীতির জন্য যারা বেশি পরিচিত, তাদের দ্বারা আন্দোলনের নামে জিম্মি করার অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের আন্দোলনের ধারা সবসময় জারি রাখতে হবে ভবিষ্যৎ সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থে।
লেখক : সাংবাদিক, কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট
harunjubd@gmail.com
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংক্রামক ক্যানসারে পরিণত হয়েছে খেলাপি ঋণ, ঘুস-দুর্নীতি ও অর্থ পাচার। এই তিন ব্যাধি সম্ভাবনার বাংলাদেশকে বারবার গর্তে নিমজ্জিত করছে। আইনের শাসন বা সুশাসন না থাকায় এখানে সম্পদ অর্জন করা যেমন সহজ, তার চেয়ে বেশি সহজ উন্নত কোনো দেশে সম্পদ পাচার করা। অবৈধ সম্পদকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে নিরাপদ স্থান হিসেবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে বেছে নিচ্ছে দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী। দেশের ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে এবং ক্রমাগত তা বাড়ছে। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় আবহমানকাল ধরে ঘুস-দুর্নীতি চলে আসছে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যম এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেই অর্থ পাচার ক্রমাগত সহজতর হচ্ছে। এতেই বিপদ বাড়ছে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের তথা অর্থনীতির মারাত্মক ক্যানসার খেলাপি ঋণ। এই খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি এক দিনে গড়ে ওঠেনি। শাসনব্যবস্থার অরাজকতার কারণে খেলাপি ঋণ মারাত্মক আকার ধারণ করে দেড় যুগে। দেড় যুগে ঋণখেলাপিদের দাপট এতটাই বেশি ছিল, তাদের ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিতই করা যায়নি। ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী—গৃহীত ঋণ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত না দিলে তা খেলাপি তালিকাভুক্ত করা হবে। কিন্তু ১৬ বছরে প্রভাবশালীরা ব্যাংকের ঋণ শুধু গ্রহণ করেছেন কিন্তু ফেরত দেননি। ফেরত না দেওয়া সত্ত্বেও প্রতিবছর নতুন করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এই ঋণের সমুদয় অর্থ যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোয় পাচার করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলোয় কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে, তার একটি চিত্র পাওয়া যায় ১৬ জুন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমার দেশ-এ ‘খেলাপি ঋণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা : ৩ মাসে বেড়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের লুকানো খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
খেলাপি ঋণের এই করুণচিত্র প্রকাশিত হওয়ার কয়েক দিন পর সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সরকারি সেবা গ্রহণ করেছেন, এমন নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ৩২ শতাংশ ঘুস-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। প্রতি তিনজনের মধ্যে গড়ে একজনকে ঘুস দিয়ে সেবা নিতে হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানার ৮৪ হাজার ৮০৭ নারী-পুরুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। জরিপের তথ্যানুসারে, সবচেয়ে বেশি ঘুস-দুর্নীতি হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, গত এক বছরে বিআরটিএতে সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকদের ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ ঘুস-দুর্নীতির শিকার হন। এই হার আইন প্রয়োগকারীর সংস্থায় ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ভূমি নিবন্ধন অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতির অর্থের গন্তব্য কোথায়, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের এক বার্ষিক প্রতিবেদনে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বিদেশিদের কী পরিমাণ অর্থ জমা আছে, তার ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২৩ সালে ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ। এক বছরে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৫৭ কোটি ১৮ লাখ ফ্রাঁ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১৪৯ টাকা। সেই হিসাবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ ৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা।
সুইস ব্যাংকের অর্থ জমার হিসাব প্রতিবছর প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এর বাইরে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদন, মালয়েশিয়ান সরকারের মাই সেকেন্ড হোম প্রজেক্ট প্রতিবেদন, পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক আর্থিক দুর্নীতির প্রতিবেদন বাংলাদেশি অর্থ পাচার, কর ফাঁকিবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—এসব প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো এসব তথ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছিল অর্থ পাচার প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এসব তথ্য সম্পর্কে তাদের জানা নেই এবং অর্থ পাচার হচ্ছে এমন কোনো তথ্য, তাদের কাছে নেই বলে বরাবরই দায় এড়িয়ে গেছে বিএফআইইউ।
তবে অর্থ পাচার নিয়ে সরকার বরাবর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে অনেক তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে আমলা ও রাজনীতিবিদরা ঘুস নিয়েছেন আড়াই লাখ কোটি টাকা। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে শেয়ারবাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত চাঁদাবাজি ও ঘুস হিসেবে গ্রহণ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং আমলারা।
এই অর্থ পাচারকারীর তালিকায় যেমন বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন, তেমনি আছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি আমলা, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, বিচারপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ অনেকেই। যাদের কিছুটা তথ্য এখন সরকারিভাবে স্বীকার করা হচ্ছে এবং তাদের অর্থ পাচার নিয়ে তদন্ত চলছে। আশার দিক হলো, অন্তত ১০ থেকে ১২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে পাচারের অর্থ সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
অর্থ পাচারের কয়েকটি সহজ পদ্ধতির মধ্যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি কাজ করেন। স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে যারা উপার্জনে উদ্দেশ্যে প্রবাসে রয়েছেন, তারা তাদের অর্থ দেশে পাঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘উইকলি সিলেকটেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছয়ের ১১ মাসে (জুলাই-মে) প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৭ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এটি আগের বছরের একসময়ের তুলনায় ২৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। এখানে লক্ষণীয়, বর্তমানে যুদ্ধাক্রান্ত বিশ্বে কারোর বেতন বাড়েনি। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়েছে। আগে রেমিট্যান্স হুন্ডি হতো। দেশের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বৈধ করার জন্য রেমিট্যান্স কেনাবেচা হতো। এতে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং রিজার্ভে টান পড়েছে। অর্থ পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হলে প্রতিবছর রেমিট্যান্সপ্রবাহ ৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
এ কথা সত্য, দুর্নীতিবাজদের শিকড় অনেক গভীরে। তাদের বিস্তার অনেকটা মাকড়সার জালের মতো। বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাদের জিম্মি করার প্রবণতাও বেশি এবং এর নেতিবাচক প্রভাবও বেশি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের ফলে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে দুর্নীতির জন্য যারা বেশি পরিচিত, তাদের দ্বারা আন্দোলনের নামে জিম্মি করার অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের আন্দোলনের ধারা সবসময় জারি রাখতে হবে ভবিষ্যৎ সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থে।
লেখক : সাংবাদিক, কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট
harunjubd@gmail.com
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৬ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৬ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৭ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে