মেহেদী হাসান
প্রায় ছয় দশক ধরে ভারতে যুদ্ধ করছে মাওবাদী নামে পরিচিত সশস্ত্র বামপন্থিরা। তাদের লক্ষ্য যুদ্ধের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করা। মাওবাদীদের মতে, ভারতের বর্তমান শাসনব্যবস্থা আধা-ঔপনিবেশিক, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং সর্বোপরি শোষণমূলক। তাই গণযুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায় মাওবাদীরা। এ ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের সশস্ত্র চীনা বিপ্লব।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৬ সালে মাওবাদকে ভারতের ‘এক নম্বর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। গত বছর ডিসেম্বরে ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ভারতকে মাওবাদমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তবে ৫৭ বছর ধরে চলা এই সশস্ত্র আন্দোলন আমিত শাহের ঘোষণা অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে, এটা বিশ্বাস করেন না বিশ্লেষকরা। বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। অমিত শাহের ঘোষণার পর গত ৬ জানুয়ারি ছত্তিশগড়ের বিজাপুরে মাওবাদীদের হামলায় নিহত হয়েছেন নয় পুলিশ সদস্য। ১২ জানুয়ারি একই এলাকায় পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছেন পাঁচ মাওবাদী যোদ্ধা।
মাওবাদ দমনে ভারত এর আগেও অনেকবার বড় পরিসরে অভিযান চালিয়েছে। ২০০৯ সালে সশস্ত্র বামপন্থিদের বিরুদ্ধে ভারত শুরু করে সবচেয়ে বড় অভিযান ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানে ভারত কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী, কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী, রাজ্য পুলিশ বাহনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর চার লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করে ‘রেড করিডোর’ নামে পরিচিত মাওবাদ অধ্যুষিত পাঁচটি রাজ্যে। এমনকি একপর্যায়ে কাশ্মীর থেকেও সেনা সরিয়ে এনে মোতায়েন করা হয় মাওবাদীদের বিরুদ্ধে।
ব্যাপক দমন অভিযানের মাধ্যমে সাময়িকভাবে মাওবাদীদের দুর্বল করতে পারলেও বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র মাওবাদ। ৫৭ বছর হলো ভারত মাওবাদ দমন করতে পারেনি, কারণ যেসব সমস্যা ও দাবি ঘিরে এ সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তা দূর করতে পারেনি ভারতের ক্ষমতাসীনরা। মাওবাদ দমনে ভারত বারবার নির্ভর করেছে বল প্রয়োগের ওপর, যা হিতে বিপরীত হয়েছে। এ ছাড়া মাওবাদ-অধ্যুষিত এলাকার মানুষের সমস্যা দূর করার জন্য উন্নয়নের নামে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়েও রয়েছে তুমুল বিতর্ক।
যে কোনো বিপ্লব শুরু বা টিকে থাকার ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত প্রযোজ্য—১. আদর্শিক ভিত্তি, ২. জনসমর্থন ও ৩. নেতৃত্ব। ভারতের সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ তিনটি শর্তই বেশ জোরালভাবে বিদ্যমান। ১৯৬৭ সালে পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি জেলার সীমান্তবর্তী নকশালবাড়ী গ্রামে জোতদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে শুরু হয় যে আন্দোলন, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতে। পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে লাভ করে ব্যাপক জনসমর্থন। গোটা পূর্ব ভারত ছাড়িয়ে সশস্ত্র মাওবাদ প্রবেশ করে ভারতের মধ্যাঞ্চলে। যেসব অঞ্চলে মাওবাদ আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নেয়নি, সেসব অঞ্চলেও অনেক সমর্থন রয়েছে মাওবাদী আন্দোলনের প্রতি।
২০০০ সালের পর থেকে সশস্ত্র মাওবাদ আন্দোলন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় ভারতে। একপর্যায়ে ভারতের ১০টির অধিক রাজ্যে ১৮০টি জেলায় বিস্তার লাভ করে এ সশস্ত্র আন্দোলন। ভারত সরকারের দাবি ২০২১ সালে মাওবাদ-অধ্যুষিত জেলা ১৮০টি থেকে ৭০টিতে নেমে এসেছে তাদের মাওবাদ-বিরোধী অভিযান ও বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে। ভারতের দাবি, বর্তমানে ২৫টি জেলায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন।
বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম পর্যন্ত ১০টি রাজ্যে বিস্তৃত মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রাম, যা ‘রেড করিডোর’ নামে পরিচত। ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, তেলাঙ্গানা, ওড়িষা, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবাংলা সবচেয়ে বেশি মাওবাদ-অধ্যুষিত রাজ্য এবং এসব রাজ্য অন্তর্ভুক্ত রেড করিডোর বা রেড জোনের। ভারতের সবচেয়ে অবহেলিত আর দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল হলো মাওবাদ-অধ্যুষিত এই রেড জোন। এসব অঞ্চলের অনেক এলাকায় ভারত সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং মাওবাদীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে সেসব এলাকা।
‘জল-জমি-জঙ্গল’ এই তিন ক্ষেত্রে অধিকার থেকে বঞ্চনা ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি। এর সঙ্গে রয়েছে পূর্ব ভারতের পাহাড়ি আর জঙ্গলঘেরা উপজাতি অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে খনিজ সম্পদ উত্তোলন, ড্যাম নির্মাণ, দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির স্থাপনা, রেল সড়কসহ বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের নামে অস্বাভাবিকভাবে জমি দখল, বন উজাড়, দারিদ্র্য ও পুলিশি নির্যাতনসহ আরো অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সবের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত সশস্ত্র মাওবাদ বিস্তারের অন্যতম কারণ রাষ্ট্রীয় শোষণ, বৈষম্য, অবিচার আর উন্নয়নের নামে উপজাতিসহ পাহাড়ি লোকজনকে তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা এবং ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমির সঠিক বরাদ্দ না দেওয়া।
ভারতে মাওবাদী হামলায় প্রতি তিন দিনে নিহত হয় ভারতীয় এক সেনা অথবা পুলিশ সদস্য। ভারতের মাওবাদী সশস্ত্র আন্দোলন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত। কেবল মাওবাদ নয়, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে চলছে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। পাঞ্জাবে চলছে শিখদের জন্য স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। পশ্চিম বাংলায় গোর্খা সম্প্রদায় চাচ্ছে তাদের জন্য স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড। সেভেন সিস্টারস নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছে কয়েক ডজন করে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মনিপুরে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। গুজরাটসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গত কয়েক দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। কাশ্মীর, সেভেন সিস্টারস, পাঞ্জাব, পশ্চিম বাংলাসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও মাওবাদীদের সরকার উচ্ছেদের যুদ্ধ দমনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় আর্মিসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে।
১৯২৫ সালে ভারতে যাত্রা শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা সিপিআই। এই কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার মাওবাদী গ্রুপ সিপিআই (এম) বর্তমানে মাওবাদী নামে পরিচিত, যারা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এর মূল নেতা চারু মজুমদার। মাওবাদীরা নকশাল নামেও পরিচিত। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবাংলার নকশালবাড়ী গ্রামে কৃষক বিদ্রোহে সমর্থন দিয়েছিল সিপিআই এবং এর নেতা চারু মজুমদার। সেই থেকে ভারতীয় বামপন্থি সশস্ত্র গ্রুপের আন্দোলন নকশালী নামে পরিচিতি পায়। এ সশস্ত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য রাজ্যে। কয়েক দশক ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তরুণ সমাজকে আলোড়িত করে সশস্ত্র নকশালী আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সানথাল মিলে গঠন করেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদ-লেনিনবাদ)। ২০০৪ সালে সশস্ত্র বামপন্থি কয়েকটি গ্রুপ মিলে গঠন করে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মাওবাদ) বা সিপিআই (এম)। ২০০৯ সালে ভারত সিপিআই’কে(এম) নিষিদ্ধ করে এবং আখ্যায়িত করে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে।
চীন-ভারত চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ। সেই চীনা সশস্ত্র বিপ্লবের আদলে বন্দুকের মাধ্যমে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের জন্য যুদ্ধ করছে বামপন্থি মাওবাদীরা। এটা যেন জ্বলন্ত শেলের মতো বিদ্ধ হয়ে আছে ভারতের বুকে। ভারতের মাওবাদীদের নেতা চারু মজুমদার একসময় ঘোষণা করেন, ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, চীনের পথ আমাদের পথ।’ চারু মজুমদারের এ ঘোষণা আজও তুষের আগুনের মতো জ্বলছে ভারতের ক্ষমতাসীনদের বুকে। ২০০৯ সালে ভারত অভিযোগ করে ভারতের মাওবাদী আন্দোলনকারীদের অস্ত্র দিচ্ছে চীন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও ভারতের অভিযোগ রয়েছে মাওবাদীদের সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। কথিত গণতান্ত্রিক ভারতে সশস্ত্র মাওবাদ, বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে ভারতের গণতান্ত্রিক চেহারার অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ
প্রায় ছয় দশক ধরে ভারতে যুদ্ধ করছে মাওবাদী নামে পরিচিত সশস্ত্র বামপন্থিরা। তাদের লক্ষ্য যুদ্ধের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করে ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করা। মাওবাদীদের মতে, ভারতের বর্তমান শাসনব্যবস্থা আধা-ঔপনিবেশিক, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং সর্বোপরি শোষণমূলক। তাই গণযুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায় মাওবাদীরা। এ ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের সশস্ত্র চীনা বিপ্লব।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৬ সালে মাওবাদকে ভারতের ‘এক নম্বর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। গত বছর ডিসেম্বরে ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ভারতকে মাওবাদমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তবে ৫৭ বছর ধরে চলা এই সশস্ত্র আন্দোলন আমিত শাহের ঘোষণা অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে, এটা বিশ্বাস করেন না বিশ্লেষকরা। বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। অমিত শাহের ঘোষণার পর গত ৬ জানুয়ারি ছত্তিশগড়ের বিজাপুরে মাওবাদীদের হামলায় নিহত হয়েছেন নয় পুলিশ সদস্য। ১২ জানুয়ারি একই এলাকায় পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছেন পাঁচ মাওবাদী যোদ্ধা।
মাওবাদ দমনে ভারত এর আগেও অনেকবার বড় পরিসরে অভিযান চালিয়েছে। ২০০৯ সালে সশস্ত্র বামপন্থিদের বিরুদ্ধে ভারত শুরু করে সবচেয়ে বড় অভিযান ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানে ভারত কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী, কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী, রাজ্য পুলিশ বাহনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর চার লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করে ‘রেড করিডোর’ নামে পরিচিত মাওবাদ অধ্যুষিত পাঁচটি রাজ্যে। এমনকি একপর্যায়ে কাশ্মীর থেকেও সেনা সরিয়ে এনে মোতায়েন করা হয় মাওবাদীদের বিরুদ্ধে।
ব্যাপক দমন অভিযানের মাধ্যমে সাময়িকভাবে মাওবাদীদের দুর্বল করতে পারলেও বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র মাওবাদ। ৫৭ বছর হলো ভারত মাওবাদ দমন করতে পারেনি, কারণ যেসব সমস্যা ও দাবি ঘিরে এ সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তা দূর করতে পারেনি ভারতের ক্ষমতাসীনরা। মাওবাদ দমনে ভারত বারবার নির্ভর করেছে বল প্রয়োগের ওপর, যা হিতে বিপরীত হয়েছে। এ ছাড়া মাওবাদ-অধ্যুষিত এলাকার মানুষের সমস্যা দূর করার জন্য উন্নয়নের নামে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়েও রয়েছে তুমুল বিতর্ক।
যে কোনো বিপ্লব শুরু বা টিকে থাকার ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত প্রযোজ্য—১. আদর্শিক ভিত্তি, ২. জনসমর্থন ও ৩. নেতৃত্ব। ভারতের সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ তিনটি শর্তই বেশ জোরালভাবে বিদ্যমান। ১৯৬৭ সালে পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি জেলার সীমান্তবর্তী নকশালবাড়ী গ্রামে জোতদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে শুরু হয় যে আন্দোলন, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতে। পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে লাভ করে ব্যাপক জনসমর্থন। গোটা পূর্ব ভারত ছাড়িয়ে সশস্ত্র মাওবাদ প্রবেশ করে ভারতের মধ্যাঞ্চলে। যেসব অঞ্চলে মাওবাদ আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নেয়নি, সেসব অঞ্চলেও অনেক সমর্থন রয়েছে মাওবাদী আন্দোলনের প্রতি।
২০০০ সালের পর থেকে সশস্ত্র মাওবাদ আন্দোলন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় ভারতে। একপর্যায়ে ভারতের ১০টির অধিক রাজ্যে ১৮০টি জেলায় বিস্তার লাভ করে এ সশস্ত্র আন্দোলন। ভারত সরকারের দাবি ২০২১ সালে মাওবাদ-অধ্যুষিত জেলা ১৮০টি থেকে ৭০টিতে নেমে এসেছে তাদের মাওবাদ-বিরোধী অভিযান ও বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে। ভারতের দাবি, বর্তমানে ২৫টি জেলায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন।
বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম পর্যন্ত ১০টি রাজ্যে বিস্তৃত মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রাম, যা ‘রেড করিডোর’ নামে পরিচত। ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, তেলাঙ্গানা, ওড়িষা, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবাংলা সবচেয়ে বেশি মাওবাদ-অধ্যুষিত রাজ্য এবং এসব রাজ্য অন্তর্ভুক্ত রেড করিডোর বা রেড জোনের। ভারতের সবচেয়ে অবহেলিত আর দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল হলো মাওবাদ-অধ্যুষিত এই রেড জোন। এসব অঞ্চলের অনেক এলাকায় ভারত সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং মাওবাদীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে সেসব এলাকা।
‘জল-জমি-জঙ্গল’ এই তিন ক্ষেত্রে অধিকার থেকে বঞ্চনা ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি। এর সঙ্গে রয়েছে পূর্ব ভারতের পাহাড়ি আর জঙ্গলঘেরা উপজাতি অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে খনিজ সম্পদ উত্তোলন, ড্যাম নির্মাণ, দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির স্থাপনা, রেল সড়কসহ বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের নামে অস্বাভাবিকভাবে জমি দখল, বন উজাড়, দারিদ্র্য ও পুলিশি নির্যাতনসহ আরো অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সবের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্যে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত সশস্ত্র মাওবাদ বিস্তারের অন্যতম কারণ রাষ্ট্রীয় শোষণ, বৈষম্য, অবিচার আর উন্নয়নের নামে উপজাতিসহ পাহাড়ি লোকজনকে তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা এবং ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমির সঠিক বরাদ্দ না দেওয়া।
ভারতে মাওবাদী হামলায় প্রতি তিন দিনে নিহত হয় ভারতীয় এক সেনা অথবা পুলিশ সদস্য। ভারতের মাওবাদী সশস্ত্র আন্দোলন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত। কেবল মাওবাদ নয়, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে চলছে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। পাঞ্জাবে চলছে শিখদের জন্য স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। পশ্চিম বাংলায় গোর্খা সম্প্রদায় চাচ্ছে তাদের জন্য স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড। সেভেন সিস্টারস নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছে কয়েক ডজন করে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মনিপুরে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। গুজরাটসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গত কয়েক দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। কাশ্মীর, সেভেন সিস্টারস, পাঞ্জাব, পশ্চিম বাংলাসহ বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও মাওবাদীদের সরকার উচ্ছেদের যুদ্ধ দমনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় আর্মিসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে।
১৯২৫ সালে ভারতে যাত্রা শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা সিপিআই। এই কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার মাওবাদী গ্রুপ সিপিআই (এম) বর্তমানে মাওবাদী নামে পরিচিত, যারা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এর মূল নেতা চারু মজুমদার। মাওবাদীরা নকশাল নামেও পরিচিত। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবাংলার নকশালবাড়ী গ্রামে কৃষক বিদ্রোহে সমর্থন দিয়েছিল সিপিআই এবং এর নেতা চারু মজুমদার। সেই থেকে ভারতীয় বামপন্থি সশস্ত্র গ্রুপের আন্দোলন নকশালী নামে পরিচিতি পায়। এ সশস্ত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য রাজ্যে। কয়েক দশক ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তরুণ সমাজকে আলোড়িত করে সশস্ত্র নকশালী আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সানথাল মিলে গঠন করেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদ-লেনিনবাদ)। ২০০৪ সালে সশস্ত্র বামপন্থি কয়েকটি গ্রুপ মিলে গঠন করে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মাওবাদ) বা সিপিআই (এম)। ২০০৯ সালে ভারত সিপিআই’কে(এম) নিষিদ্ধ করে এবং আখ্যায়িত করে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে।
চীন-ভারত চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ। সেই চীনা সশস্ত্র বিপ্লবের আদলে বন্দুকের মাধ্যমে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের জন্য যুদ্ধ করছে বামপন্থি মাওবাদীরা। এটা যেন জ্বলন্ত শেলের মতো বিদ্ধ হয়ে আছে ভারতের বুকে। ভারতের মাওবাদীদের নেতা চারু মজুমদার একসময় ঘোষণা করেন, ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, চীনের পথ আমাদের পথ।’ চারু মজুমদারের এ ঘোষণা আজও তুষের আগুনের মতো জ্বলছে ভারতের ক্ষমতাসীনদের বুকে। ২০০৯ সালে ভারত অভিযোগ করে ভারতের মাওবাদী আন্দোলনকারীদের অস্ত্র দিচ্ছে চীন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও ভারতের অভিযোগ রয়েছে মাওবাদীদের সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। কথিত গণতান্ত্রিক ভারতে সশস্ত্র মাওবাদ, বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে ভারতের গণতান্ত্রিক চেহারার অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে