খানের আখ্যান
মারুফ কামাল খান
বিশ শতকের গোড়ার দিকে হিরাম জনসন ছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত একজন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। তিনি ১৯১১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ার ২৩তম গভর্নর এবং ১৯১৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন সিনেটে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগ্রেসিভ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯১২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে থিওডোর রুজভেল্টের রানিং মেট ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হিসেবে বেশ কিছু সংস্কারমূলক আইন পাস করেছিলেন হিরাম জনসন। তিনি সিনেটে থাকাকালে শ্রমিকদের অধিকার, বেসরকারি ইউটিলিটিগুলোর বিরুদ্ধে এবং জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
সেই হিরাম জনসনের একটা বিখ্যাত উক্তি অনেককাল পেরিয়ে এখনো জ্বলজ্বল করছে। তিনি বলেছিলেন : ‘The first casualty when war comes is truth.’ এ কথার মানে হলো, ‘যুদ্ধ শুরু হলে প্রথম নিহত হয় সত্য।’ তার আগে-পরে আরো অনেকেই এর কাছাকাছি উক্তি করেছেন। যেমন : চীনা সমরবিশারদ সান জু, প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার এস্কিলাস, ব্রিটিশ সাহিত্যিক স্যামুয়েল জনসন, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আর্থার পনসনবি, উইন্সটন চার্চিল এবং আরো অনেকে। তবে এর মধ্যে হিরাম জনসনের উক্তিটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
যুদ্ধে সবার আগে যে সত্য নিহত হয়Ñএই উক্তিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইতিহাসের পাতায় এর অসংখ্য প্রমাণ মেলে। খুব সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ হয়ে গেল। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র সে যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে ইরানের আন্ডারগ্রাউন্ড পারমাণবিক প্রকল্পে বোমা হামলা চালাল। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল, ক্ষয়ক্ষতি ও জয়-পরাজয়ের আসল ছবি ঢাকা পড়ে গেল বিভিন্ন পক্ষের প্রচারণার ধূম্রজালে।
যুদ্ধের উন্মত্ত পরিবেশে সত্য প্রায়ই বিকৃত হয়, চাপা পড়ে যায় অথবা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর অনেক কারণ আছে। যেমন : যুদ্ধরত পক্ষগুলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তথ্যকে নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করে। শত্রুদের খারাপ প্রমাণ করতে এবং নিজেদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায়সংগত প্রতিপন্ন করতে তারা মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। এতে প্রকৃত ঘটনা আড়াল হয়ে যায় এবং জনমতকে প্রভাবিত করা হয়। প্রোপাগান্ডার তোড়ে সত্য আড়াল হয়ে যাওয়ার একটা বড় উদাহরণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেওয়া যায়। সে সময় জার্মানির বিরুদ্ধে নৃশংসতার মনগড়া কাহিনি প্রচার করা হয়েছিল, যা মিত্রশক্তির জনমতকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিল। ইরাক যুদ্ধের সময়ও ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (WMDs) থাকার ভুয়া অভিযোগ আনা হয়েছিল, যা যুদ্ধের একটি মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়, যদিও পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
যুদ্ধে সত্য নিহত হওয়ার আরেকটি কারণ সেন্সরশিপ। যুদ্ধে লিপ্ত সরকার বা সামরিক বাহিনী প্রায়ই যুদ্ধের সময় তথ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তারা এমন খবর প্রকাশে বাধা দেয়, যা তাদের জনসমর্থন কমিয়ে দিতে পারে বা শত্রুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিতে পারে। এর ফলে সাধারণ মানুষ যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে না। ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে প্রথমদিকে মার্কিন সরকার যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
আবেগ ও পক্ষপাতিত্বও যুদ্ধকালে সত্য খুন হওয়ার অন্যতম কারণ। যুদ্ধের সময় মানুষের মধ্যে প্রবল আবেগ, ভয়, ঘৃণা এবং দেশপ্রেম কাজ করে। এই আবেগগুলো যুক্তিসংগত বিচারকে প্রভাবিত করে এবং মানুষ সহজেই মনগড়া বা বিকৃত তথ্য বিশ্বাস করে ফেলে। প্রতিটি পক্ষই নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাকে দেখে এবং অন্যপক্ষের বক্তব্যকে অবিশ্বাস করে। যেমনÑরুয়ান্ডার গণহত্যা বা বলকান যুদ্ধের সময় প্রতিটি পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সব অভিযোগ আনত, যার মধ্যে অনেকগুলোই অতিরঞ্জিত বা ভিত্তিহীন ছিল।
আসলে যুদ্ধ এমন এক চরম পরিস্থিতি, যেখানে একমাত্র বেঁচে থাকা এবং বিজয়ী হওয়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সত্যকে প্রায়ই বিসর্জন দেওয়া হয়। আর এ কারণেই যুদ্ধে সবার আগে সত্য নিহত হওয়ার কোটেশনটিই চরম সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
এতক্ষণ যুদ্ধে সত্য নিহত হওয়ার যে চিরায়ত সত্য, সে সম্পর্কে কিছু বলা হলো। কিন্তু যুদ্ধের বাইরে শান্তির সময়েও কি সত্য নিহত হয় না? অবশ্যই হয় এবং এখন জগৎজুড়ে চলছে সেই কাল। আমরা এমন একসময়ে বাস করছি, যেখানে সত্যের সংজ্ঞা প্রায়ই ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ বা অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল। এই সময়কালকেই বলা হচ্ছে পোস্ট-ট্রুথ যুগ। এই ধারণাটি ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারি কর্তৃক ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
পোস্ট-ট্রুথ মূলত এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য বা প্রমাণ জনসাধারণের মতামত গঠনে খুব কম প্রভাব ফেলে, বরং আবেগ এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাসই বেশি প্রাধান্য পায়। এর মানে এই নয় যে সত্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বরং সত্যকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় বা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, যা জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। দেশে দেশে এই পোস্ট-ট্রুথ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো তথ্যের দ্রুত প্রসারে সাহায্য করে। এখানে প্রায়ই ভুয়া খবর, গুজব এবং ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা সত্যকে যাচাই করার সুযোগ দেয় না। মানুষ শুধু তাদের নিজস্ব বিশ্বাসকে সমর্থন করে এমন তথ্যই দেখতে আগ্রহী এবং তা দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলে।
পোস্ট-ট্রুথ তত্ত্বের প্রভাব বলয় বিস্তারের আরো অনেকগুলো কারণ আছে। সেই কারণগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া খুব সহজেই বলে দেওয়া যায়, যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লেও আমরা পোস্ট-ট্রুথ নামের এমন একসময়কালে বাস করছি, যখন প্রতিনিয়তই নানাভাবে সত্য নিহত হচ্ছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ ‘আশির দশকে স্মৃতিচারণমূলক একটি ট্রিলজি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ নামে। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে বইটি তখনকার জননন্দিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময়েই বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। দারুণ আলোচিত হয়েছিল ট্রিলজিটির দ্বিতীয় খণ্ড। সেটির শিরোনাম ছিল : ‘সত্য বাবু মারা গেছেন’। ওই খণ্ডে মরহুম ফয়েজ আহমেদ কৌতুক ও হাস্যরসের ছলে আমাদের তীক্ষ্ণ জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। আনন্দরসে অবগাহন করতে করতে আমরা অনুভব করতে পারি অন্তঃসলিলা বেদনার ধারা, বিদীর্ণ হই নানা জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নজালে এবং এভাবেই নিজেদেরই জানতে পারি আরো গভীরভাবে।
সত্য বাবুর মৃত্যু নিয়ে রাজধানীর নাটকপাড়া বেইলি রোডের মঞ্চে একটা নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছিল বলে মনে পড়ে। সত্য বাবুর মৃত্যু ও আনুষঙ্গিক আরো কিছু নিষ্ঠুর বাস্তবতা তুলে ধরে একটি ছড়া-কবিতাও পড়েছিলাম অনেক আগে। রচয়িতার নাম ভুলে গেলেও ছড়া-কবিতাটি এখনো স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে। সেটি এ রকম : সত্য বাবু মারা গেছেন/বিবেক বাবুর গায়ে জ্বর/নীতি বাবু দেশ ছেড়েছেন/কেউ রাখে না তার খবর/উচিত বাবুর কানে তালা/জুলুম বাবুর বেজায় জোর/শান্তি বাবুর অশান্তিতে/হবে না আর হয়তো ভোর।
মৃত সত্য বাবুর আত্মার সদগতির জন্য প্রার্থনা করতে করতে আমরা এখন একটি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পারি। প্রশ্নটি হচ্ছে, এই পোস্ট-ট্রুথ জামানায় মারণাস্ত্রের যুদ্ধে না জড়ালেও আমরা কি সত্যিই যুদ্ধের বাইরে আছি? এই প্রশ্ন আমাদের নিয়ে যায় গণচীন বিপ্লবের মহানায়ক মাও সেতুংয়ের একটি কালজয়ী উক্তির কাছে। তিনি বলেছিলেন : ‘যুদ্ধ হচ্ছে রক্তপাতময় রাজনীতি আর রাজনীতি হচ্ছে রক্তপাতহীন যুদ্ধ’। কী দারুণ কথা! আমরা তাহলে সামরিক সংঘাতে লিপ্ত না হয়েও এক রক্তপাতহীন যুদ্ধে জড়িয়ে আছি। এ যুদ্ধ রাজনীতির যুদ্ধ। এই যুদ্ধ করেই এক বছর আগে এ জাতির সাহসী তরুণ সন্তানরা এক ঘৃণ্য ঘাতক রাজনীতিকে পরাস্ত করেছে। সে ছিল রাজনীতির নামে রক্তখেলা, জীবন নেওয়া, নির্যাতন করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অধিকার হরণ, লুঠতরাজ, দলবাজি, অবিচার ও অনাচারের এক কুৎসিত লীলা। রক্ত ঢেলে সেই অপরাজনীতিকে পরাস্ত করতে হয়েছে। কিন্তু তারপর?
তারপরও এখনো আমাদের রাজনীতির রক্তপাতহীন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত সবার আগে নিহত হচ্ছে সত্য। আমাদের রাজনীতির ভাষ্যে, সংবাদমাধ্যমের প্রচারণায়, সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যাচারে ভরা রটনায়, আমাদের শাসনে-প্রশাসনে, আইনরক্ষা ও বিচারে সত্য জখম হচ্ছে, রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নিহত সত্য বাবুর আত্মা ভূত হয়ে এসে কি সব মিথ্যাচারীর ঘাড় মটকে দেবে না?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com
বিশ শতকের গোড়ার দিকে হিরাম জনসন ছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত একজন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। তিনি ১৯১১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ার ২৩তম গভর্নর এবং ১৯১৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন সিনেটে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগ্রেসিভ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯১২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে থিওডোর রুজভেল্টের রানিং মেট ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হিসেবে বেশ কিছু সংস্কারমূলক আইন পাস করেছিলেন হিরাম জনসন। তিনি সিনেটে থাকাকালে শ্রমিকদের অধিকার, বেসরকারি ইউটিলিটিগুলোর বিরুদ্ধে এবং জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
সেই হিরাম জনসনের একটা বিখ্যাত উক্তি অনেককাল পেরিয়ে এখনো জ্বলজ্বল করছে। তিনি বলেছিলেন : ‘The first casualty when war comes is truth.’ এ কথার মানে হলো, ‘যুদ্ধ শুরু হলে প্রথম নিহত হয় সত্য।’ তার আগে-পরে আরো অনেকেই এর কাছাকাছি উক্তি করেছেন। যেমন : চীনা সমরবিশারদ সান জু, প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার এস্কিলাস, ব্রিটিশ সাহিত্যিক স্যামুয়েল জনসন, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আর্থার পনসনবি, উইন্সটন চার্চিল এবং আরো অনেকে। তবে এর মধ্যে হিরাম জনসনের উক্তিটিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
যুদ্ধে সবার আগে যে সত্য নিহত হয়Ñএই উক্তিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইতিহাসের পাতায় এর অসংখ্য প্রমাণ মেলে। খুব সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ হয়ে গেল। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র সে যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে ইরানের আন্ডারগ্রাউন্ড পারমাণবিক প্রকল্পে বোমা হামলা চালাল। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল, ক্ষয়ক্ষতি ও জয়-পরাজয়ের আসল ছবি ঢাকা পড়ে গেল বিভিন্ন পক্ষের প্রচারণার ধূম্রজালে।
যুদ্ধের উন্মত্ত পরিবেশে সত্য প্রায়ই বিকৃত হয়, চাপা পড়ে যায় অথবা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর অনেক কারণ আছে। যেমন : যুদ্ধরত পক্ষগুলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তথ্যকে নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করে। শত্রুদের খারাপ প্রমাণ করতে এবং নিজেদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায়সংগত প্রতিপন্ন করতে তারা মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। এতে প্রকৃত ঘটনা আড়াল হয়ে যায় এবং জনমতকে প্রভাবিত করা হয়। প্রোপাগান্ডার তোড়ে সত্য আড়াল হয়ে যাওয়ার একটা বড় উদাহরণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেওয়া যায়। সে সময় জার্মানির বিরুদ্ধে নৃশংসতার মনগড়া কাহিনি প্রচার করা হয়েছিল, যা মিত্রশক্তির জনমতকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিল। ইরাক যুদ্ধের সময়ও ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (WMDs) থাকার ভুয়া অভিযোগ আনা হয়েছিল, যা যুদ্ধের একটি মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয়, যদিও পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
যুদ্ধে সত্য নিহত হওয়ার আরেকটি কারণ সেন্সরশিপ। যুদ্ধে লিপ্ত সরকার বা সামরিক বাহিনী প্রায়ই যুদ্ধের সময় তথ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তারা এমন খবর প্রকাশে বাধা দেয়, যা তাদের জনসমর্থন কমিয়ে দিতে পারে বা শত্রুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিতে পারে। এর ফলে সাধারণ মানুষ যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে না। ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে প্রথমদিকে মার্কিন সরকার যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
আবেগ ও পক্ষপাতিত্বও যুদ্ধকালে সত্য খুন হওয়ার অন্যতম কারণ। যুদ্ধের সময় মানুষের মধ্যে প্রবল আবেগ, ভয়, ঘৃণা এবং দেশপ্রেম কাজ করে। এই আবেগগুলো যুক্তিসংগত বিচারকে প্রভাবিত করে এবং মানুষ সহজেই মনগড়া বা বিকৃত তথ্য বিশ্বাস করে ফেলে। প্রতিটি পক্ষই নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাকে দেখে এবং অন্যপক্ষের বক্তব্যকে অবিশ্বাস করে। যেমনÑরুয়ান্ডার গণহত্যা বা বলকান যুদ্ধের সময় প্রতিটি পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সব অভিযোগ আনত, যার মধ্যে অনেকগুলোই অতিরঞ্জিত বা ভিত্তিহীন ছিল।
আসলে যুদ্ধ এমন এক চরম পরিস্থিতি, যেখানে একমাত্র বেঁচে থাকা এবং বিজয়ী হওয়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সত্যকে প্রায়ই বিসর্জন দেওয়া হয়। আর এ কারণেই যুদ্ধে সবার আগে সত্য নিহত হওয়ার কোটেশনটিই চরম সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
এতক্ষণ যুদ্ধে সত্য নিহত হওয়ার যে চিরায়ত সত্য, সে সম্পর্কে কিছু বলা হলো। কিন্তু যুদ্ধের বাইরে শান্তির সময়েও কি সত্য নিহত হয় না? অবশ্যই হয় এবং এখন জগৎজুড়ে চলছে সেই কাল। আমরা এমন একসময়ে বাস করছি, যেখানে সত্যের সংজ্ঞা প্রায়ই ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ বা অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল। এই সময়কালকেই বলা হচ্ছে পোস্ট-ট্রুথ যুগ। এই ধারণাটি ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারি কর্তৃক ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
পোস্ট-ট্রুথ মূলত এমন একটি পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য বা প্রমাণ জনসাধারণের মতামত গঠনে খুব কম প্রভাব ফেলে, বরং আবেগ এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাসই বেশি প্রাধান্য পায়। এর মানে এই নয় যে সত্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বরং সত্যকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় বা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, যা জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। দেশে দেশে এই পোস্ট-ট্রুথ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো তথ্যের দ্রুত প্রসারে সাহায্য করে। এখানে প্রায়ই ভুয়া খবর, গুজব এবং ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা সত্যকে যাচাই করার সুযোগ দেয় না। মানুষ শুধু তাদের নিজস্ব বিশ্বাসকে সমর্থন করে এমন তথ্যই দেখতে আগ্রহী এবং তা দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলে।
পোস্ট-ট্রুথ তত্ত্বের প্রভাব বলয় বিস্তারের আরো অনেকগুলো কারণ আছে। সেই কারণগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া খুব সহজেই বলে দেওয়া যায়, যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লেও আমরা পোস্ট-ট্রুথ নামের এমন একসময়কালে বাস করছি, যখন প্রতিনিয়তই নানাভাবে সত্য নিহত হচ্ছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ ‘আশির দশকে স্মৃতিচারণমূলক একটি ট্রিলজি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ নামে। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে বইটি তখনকার জননন্দিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময়েই বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। দারুণ আলোচিত হয়েছিল ট্রিলজিটির দ্বিতীয় খণ্ড। সেটির শিরোনাম ছিল : ‘সত্য বাবু মারা গেছেন’। ওই খণ্ডে মরহুম ফয়েজ আহমেদ কৌতুক ও হাস্যরসের ছলে আমাদের তীক্ষ্ণ জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। আনন্দরসে অবগাহন করতে করতে আমরা অনুভব করতে পারি অন্তঃসলিলা বেদনার ধারা, বিদীর্ণ হই নানা জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নজালে এবং এভাবেই নিজেদেরই জানতে পারি আরো গভীরভাবে।
সত্য বাবুর মৃত্যু নিয়ে রাজধানীর নাটকপাড়া বেইলি রোডের মঞ্চে একটা নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছিল বলে মনে পড়ে। সত্য বাবুর মৃত্যু ও আনুষঙ্গিক আরো কিছু নিষ্ঠুর বাস্তবতা তুলে ধরে একটি ছড়া-কবিতাও পড়েছিলাম অনেক আগে। রচয়িতার নাম ভুলে গেলেও ছড়া-কবিতাটি এখনো স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে। সেটি এ রকম : সত্য বাবু মারা গেছেন/বিবেক বাবুর গায়ে জ্বর/নীতি বাবু দেশ ছেড়েছেন/কেউ রাখে না তার খবর/উচিত বাবুর কানে তালা/জুলুম বাবুর বেজায় জোর/শান্তি বাবুর অশান্তিতে/হবে না আর হয়তো ভোর।
মৃত সত্য বাবুর আত্মার সদগতির জন্য প্রার্থনা করতে করতে আমরা এখন একটি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পারি। প্রশ্নটি হচ্ছে, এই পোস্ট-ট্রুথ জামানায় মারণাস্ত্রের যুদ্ধে না জড়ালেও আমরা কি সত্যিই যুদ্ধের বাইরে আছি? এই প্রশ্ন আমাদের নিয়ে যায় গণচীন বিপ্লবের মহানায়ক মাও সেতুংয়ের একটি কালজয়ী উক্তির কাছে। তিনি বলেছিলেন : ‘যুদ্ধ হচ্ছে রক্তপাতময় রাজনীতি আর রাজনীতি হচ্ছে রক্তপাতহীন যুদ্ধ’। কী দারুণ কথা! আমরা তাহলে সামরিক সংঘাতে লিপ্ত না হয়েও এক রক্তপাতহীন যুদ্ধে জড়িয়ে আছি। এ যুদ্ধ রাজনীতির যুদ্ধ। এই যুদ্ধ করেই এক বছর আগে এ জাতির সাহসী তরুণ সন্তানরা এক ঘৃণ্য ঘাতক রাজনীতিকে পরাস্ত করেছে। সে ছিল রাজনীতির নামে রক্তখেলা, জীবন নেওয়া, নির্যাতন করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অধিকার হরণ, লুঠতরাজ, দলবাজি, অবিচার ও অনাচারের এক কুৎসিত লীলা। রক্ত ঢেলে সেই অপরাজনীতিকে পরাস্ত করতে হয়েছে। কিন্তু তারপর?
তারপরও এখনো আমাদের রাজনীতির রক্তপাতহীন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত সবার আগে নিহত হচ্ছে সত্য। আমাদের রাজনীতির ভাষ্যে, সংবাদমাধ্যমের প্রচারণায়, সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যাচারে ভরা রটনায়, আমাদের শাসনে-প্রশাসনে, আইনরক্ষা ও বিচারে সত্য জখম হচ্ছে, রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নিহত সত্য বাবুর আত্মা ভূত হয়ে এসে কি সব মিথ্যাচারীর ঘাড় মটকে দেবে না?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা এ ঘটনাকে ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা করে বলেছিলেন, এটা শুধু সোভিয়েতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়
৩৩ মিনিট আগেআমাদের এবং আমাদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস মূলত জালিম ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস। যুগে যুগেই এই মাটির সন্তানরা বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে মুক্তির জন্য।
৩৭ মিনিট আগেএ পদ্ধতির সুবিধা হলো, সরকারের নিজস্ব বাজেট থেকে বিপুল অর্থ খরচ না করে বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে দ্রুত মামলা পরিচালনা করা সম্ভব।
৪১ মিনিট আগেদুনিয়ার সব স্বৈরশাসকদের পাশে থাকে কিছু পোষা ব্যবসায়ী। ধনবান ও প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
১ ঘণ্টা আগে