Ad T1

প্রযুক্তির যুগে শিক্ষায় আলগোরিদমের ভূমিকা

রহমান মৃধা
প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৫, ১৫: ০১
প্রতীকী ছবি

বিশ্ব আজ প্রযুক্তিনির্ভর। প্রতিটি ডিজিটাল কার্যক্রমের মূলে রয়েছে একটি শক্তিশালী নিয়ামক আলগোরিদম। টাকা তোলা, গুগলে কিছু অনুসন্ধান করা কিংবা অনলাইন কেনাকাটা সবকিছুতেই রয়েছে সূক্ষ্মভাবে গঠিত আলগোরিদমের উপস্থিতি। কিন্তু, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে? ভবিষ্যতের প্রযুক্তিপ্রধান বিশ্বে টিকে থাকার জন্য কি আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুত?

আলগোরিদম বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের ধাপে ধাপে নির্দেশনা। এটি শুধু কোড লেখার কৌশল নয়, বরং একটি কাঠামোবদ্ধ চিন্তাভাবনার পদ্ধতি যা বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে কার্যকরী। এটি সুনির্দিষ্টভাবে গঠিত, কার্যক্ষম, একটি নির্দিষ্ট পরিসমাপ্তি রয়েছে এবং নির্দিষ্ট ইনপুট নিয়ে কাংখিত আউটপুট প্রদান করে। যদি শিক্ষার্থীরা শৈশব থেকেই আলগোরিদম শেখে, তাহলে তারা শুধু প্রযুক্তির ব্যবহারকারী নয়, বরং সৃষ্টিকর্তা হয়ে উঠবে। আজকের বিশ্বে এটি কেবল সফটওয়্যার বা রোবটিক্সে নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনেও ভূমিকা রাখছে। যেমন গুগল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে আমাদের প্রতিদিনের অনুসন্ধানের পেছনে জটিল অ্যালগোরিদম কাজ করছে। অ্যামাজন ইভ ফ্লিপকার্ট এর রিকমেন্ডেশন সিস্টেম ক্রেতার পছন্দ বুঝে সাজানো হয়। গুগল ম্যাপ দ্রুততম পথ খুঁজে দেওয়ার জন্য গ্রাফ-ভিত্তিক অ্যালগোরিদম ব্যবহার করে, আবার স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ক্যান্সারের মতো রোগ দ্রুত শনাক্ত করা হচ্ছে।

বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে কম্পিউটেশনাল থিংকিং গড়ে তোলার জন্য অ্যালগোরিদম শেখাচ্ছে। বাংলাদেশেও যদি এই উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিপ্রধান কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। শিক্ষার্থীদের স্ক্র্যাচ, ব্লকলি ও কোড.অর্গ এর মতো ভিজ্যুয়াল প্রোগ্রামিং টুল ব্যবহার করে শেখানো যেতে পারে। গেম এবং প্রতিযোগিতা আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা যেতে পারে, আবার আরডুইনো, লেগো মাইন্ডষ্টর্ম এর মাধ্যমে হাতে-কলমে শেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটেশনাল থিংকিং বিকাশের জন্য স্কুল পর্যায়ে অ্যালগোরিদম ও প্রোগ্রামিং অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশেও যদি এই মডেল অনুসরণ করা হয়, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। তবে কেবল একা স্কুলের ভূমিকা যথেষ্ট নয়। এই পরিবর্তন আনতে হলে বাবা-মা, শিক্ষক, এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

বাবা-মা যদি শিশুর কৌতূহলকে উৎসাহিত করেন এবং প্রযুক্তিবিষয়ক বই ও অ্যাপ্লিকেশন সরবরাহ করেন, তাহলে তারা শুরু থেকেই সঠিক দিক-নির্দেশনা পাবে। শিক্ষকরা যদি অ্যালগোরিদম ও প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষিত হন এবং শিক্ষায় গেমিফিকেশন ও হাতে-কলমে শেখানোর কৌশল প্রয়োগ করেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ বাড়বে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের উচিত একাডেমিক পাঠ্যক্রমে অ্যালগোরিদম অন্তর্ভুক্ত করা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে ইন্টারনেট ও অনলাইন কোর্সের ব্যবস্থা করা, এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হ্যাকাথন ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন শিক্ষার্থীদের শেখার পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনছে। ব্যক্তিগতকৃত শিক্ষা (পার্সোনালাইজড লার্ণিং) ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তাদের শেখার ধরন অনুযায়ী কনটেন্ট সাজানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, খান একাডেমী, ডুয়োলিঙ্গো এর মতো প্ল্যাটফর্ম শিক্ষার্থীদের শেখার প্যাটার্ন বুঝে কাস্টমাইজড লার্নিং প্ল্যান তৈরি করছে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ও সিমুলেশন টুল ব্যবহার করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

আলগোরিদম শেখানো মানে শুধু একটি প্রযুক্তি শেখানো নয় বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বিকাশ করা। আজকের শিক্ষার্থী যদি কম্পিউটেশনাল থিংকিং আয়ত্ত করতে পারে, তবে আগামীতে সে শুধু একজন প্রযুক্তি ব্যবহারকারী নয় বরং সৃষ্টিকর্তা হবে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আলগোরিদম এবং কম্পিউটেশনাল থিংকিং অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি। এজন্য রাষ্ট্র, শিক্ষাব্যবস্থা এবং অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কারণ আলগোরিদম হলো ভবিষ্যৎ চিন্তার ভিত্তি- এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র কাজ শিখবে না, বরং সমস্যার সমাধানে নতুন উপায় আবিষ্কার করতে শিখবে।

লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত