কেবল নির্বাচনের দিন ভোটার তার পছন্দের প্রার্থী ঠিক করে এমন না, প্রচারণা-সামাজিক মাধ্যমে অজস্র তথ্য ধারাবাহিকভাবে ভোটারকে প্রভাবিত করতে পারে। গবেষণা বলছে, ভুয়া খবর আর প্রোপাগান্ডা খুব সহজেই ভোটারদের মন পরিবর্তন করে ফেলতে পারে নিমিষে। ফলে ভোটার খুব ভেবে-চিন্তে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেটিও ব্যাহত হয়।
এক. গুজব শুধু ফেসবুক থেকে আসে না
আমরা অনেক সময় ধরে নিই, ভুয়া খবর মানেই ফেসবুক পোস্ট, ইউটিউব লাইভ বা ভুয়া কোনো পেজ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এসবের বাইরে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্যের শুরুই হয় মূলধারার গণমাধ্যম থেকে; বা টিভি টকশো, অনলাইন পোর্টাল এমনকি পত্রিকার অসাবধানী শিরোনাম থেকে।
পরে সেই খবরই কপি-পেস্ট হয়ে হাজার হাজার পোস্টে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সাংবাদিকরা শুধু ভুয়া খবরের শিকার নন, কখনও কখনও নিজেরাই গুজবের উৎসও হয়ে যান।
দুই. তথ্যযুদ্ধ চালানো হতে পারে দেশের বাইরে থেকেও
আজকের ডিজিটাল দুনিয়া সীমান্ত মানে না। বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে ভারতসহ একাধিক দেশের কিছু টিভি গণমাধ্যম ও অজস্র মাধ্যমে অতিরঞ্জিত বা নিছক প্রোপাগান্ডা কারো চোখ এড়ায়নি। পরে সেগুলোই আবার আমাদের দেশের ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এমনকি গণমাধ্যম হয়ে ঘুরেফিরে এসেছে। ফলে ‘বিদেশি মিডিয়া বলছে’ বা ইংরেজিতে বলেছে বলেই সত্য ধরে প্রচার করা যাবে না। নির্বাচন কাভার করা সাংবাদিকদের তাই এখন থেকে বিদেশি সোর্সের খবরও স্থানীয় বাস্তবতা আর অন্য উৎস দিয়ে মিলিয়ে দেখতে হবে। কেননা, দেখা গেছে, ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রাশিয়ার ভূমিকা, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক দেশে ভিন্ন দেশ থেকে নির্বাচন এবং নির্বাচনে ভোটারদের মতকে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা এখন ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশেও তা হতে পারে।
তিন. ভুয়া খবর ঠেকাতে দিতে হবে আরো বেশি বেশি তথ্য
আমাদের দেশে অনেক দিন সত্যিকারের কোনো নির্বাচন না থাকলেও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্বাচনের সময় গুঞ্জন ওঠে—‘গোপন জরিপ হয়ে গেছে’, ‘ফলাফল ঠিক হয়ে গেছে’, ‘অমুক দেশ অমুক দলকে সমর্থন করছে’ ইত্যাদি। এসব অপ্রমাণিত গুজব বা ভুয়া খবর মূলত জনগণের কাছে যথাযথ তথ্য না থাকলেই ডালপালা গজিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা শুধু বলে দেওয়া নয় যে ‘এই খবরটি গুজব’, বরং ব্যাখ্যা করা। ভুয়া জরিপের বেলায় বলা জরিপ কীভাবে হয়, আমরা কী জানি, কী জানি না, কোন কোন তথ্য এখনো অপ্রমাণিত। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যত দ্রুত, বিস্তারিত ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়, তত দ্রুত উত্তেজনা প্রশমিত করা যায়।
চার. ভিন্নমত বলে প্রচারে যেন ‘ফলস ব্যালেন্স’ তৈরি না হয়
নির্বাচনে সরকারের বা বিরোধী দলের আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই, থাকা উচিতও। সেই সমালোচনা প্রকাশের জায়গা গণমাধ্যমকে দিতে হবে। কিন্তু ভিন্নমত প্রচার করতে গিয়ে অনেক সময় মিডিয়াগুলো ফলস ব্যালেন্স তৈরি করে পুরো ন্যারেটিভকে ঘুরিয়ে দেয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে ডেকলান ফাহি দেখিয়েছেন, ‘ব্যালেন্স’ বা দুই পক্ষকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টায় সাংবাদিকরা কীভাবে বিভ্রান্তিকর মতগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। যেমন, তিনি তার বিশ্লেষণ করা প্রতিবেদনগুলোতে দেখিয়েছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রায় শতভাগ ঐকমত্য থাকলেও অল্প কয়েকজন ভিন্নমতের বিজ্ঞানীর বক্তব্যকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যেখানে ‘ভিন্নমত’ সম্বলিত বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই অস্বীকার করত যা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। এতে পাঠকের মনে হতে থাকে, দুই পক্ষ বোধ হয় সমান। মিডিয়ার এই পরিস্থিতিকেই গবেষকেরা ‘ভ্রান্ত ভারসাম্য’ (false balance) হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাই ভিন্নমত বলেই কারো বিভ্রান্তিকর, উসকানিমূলক বা সন্ত্রাস উসকে দেয় এমন ভাষ্য প্রচার করা সঠিক না।
পাঁচ. সবার আগে খবর নয়, সবার আগে নির্ভুল ও বিস্তারিত খবর
অনলাইন ও টেলিভিশনের দৌড়ে সবাই চায় সবার আগে ‘এক্সক্লুসিভ’ দিতে। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষও জানে ভুয়া খবর কত সহজে ছড়ায়। এতে একই সঙ্গে গণমাধ্যমের উপরেও জনগণের আস্থা কমে আসছে।
তাই নির্বাচন কাভারেজের সময় তাই হয়তো কোনো খবর কয়েক মিনিট দেরিতে যাবে, কিন্তু তার মধ্যে যদি একটি বাড়তি ফোনকল করা যায়, একটি অতিরিক্ত সূত্র মিলিয়ে দেখা যায়, কিংবা অন্তত একটি ছোট বক্সে লেখা যায়, ‘খবরটি নিশ্চিত’ বা ‘এখনো নিশ্চিত করা যায়নি’; তাহলে পাঠক-দর্শকের আস্থা বাড়বে, কমবে না।
আগামী নির্বাচনগুলোতে সাংবাদিকদের কাজ শুধু দ্রুত খবর দেওয়া নয়; দায়িত্বশীলভাবে তথ্যের এই জটিল ভুবনে নাগরিকদের পথ দেখানোও। গণমাধ্যম যদি নিজের ভূমিকা বুঝে একশন নিতে পারে, তাহলে উপকৃত হবে সমাজ, রাষ্ট্র, সর্বোপরি জনগণ, আস্থায় বাড়বে গণমাধ্যমের।
মিনহাজ আমান
ইনফরমেশন ইন্টেগ্রিটি গবেষক
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

