আদনান সারোয়ার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে নির্বাচন-সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ আদায়ে নিজেদের মতামতের সঙ্গে ঐকমত্যের শরিক ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। বিএনপি বর্তমানে তাদের রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করছে এবং নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এলে জনগণের কল্যাণে তা বাস্তবায়নের আশা ব্যক্ত করছেন দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের ভিন্নমত বা পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেখা যাচ্ছে, তবুও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অনেকটা একই কাতারে এলেও কিছুটা ভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে এনসিপি। মৌলিক সংস্কার ব্যতিরেকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সংবিধান পুনর্লিখন ও শাসন কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন, এর তত্ত্বাবধানে নতুন সংবিধান তৈরি এবং সেই সংবিধানের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিচ্ছে এনসিপি।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু তাতে ভিন্নমত বা মতপার্থক্য দূর হওয়ার কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচনী রোডম্যাপ ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, দেশের জনগণ আসলে কী চায়? কিছুদিন আগেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে দেশের জনসাধারণ তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে ওঠেন। এ সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং নির্বাচন বিলম্বিত করার মধ্যে কিছু গোষ্ঠীর পরোক্ষ ইচ্ছা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যোগ্য নেতৃত্বই এই পাহাড় সমান জনসমর্থন আদায়ে প্রধান হাতিয়ার। তবে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজগুলোর একটি তাদের নেতৃত্বে চলমান সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা। কিন্তু এই কার্যক্রম নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের মধ্যে একটি হলো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। তারা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সংস্কার প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন প্রস্তাবনাসহ ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে যে সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশনা দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এদিকে প্রতিবেদন প্রকাশের পর এর কিছু সুপারিশ নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
এই সুপারিশমালায় ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইনকে নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুপারিশমালায় মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে অভিন্ন পারিবারিক আইন ঐচ্ছিকভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও ধর্মীয় আইনকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে করা সুস্পষ্ট অবমাননা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত করে। মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টানÑ সব সম্প্রদায়ের বিদ্যমান ধর্মীয় পারিবারিক আইন বাতিল করে একটি কথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আইন প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রস্তাব শুধু ইসলামের বিরুদ্ধেই নয়, বরং হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিও বিরুদ্ধাচরণ করে।
ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে এমন একটি ব্যবস্থা কার্যত ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির ওপর হস্তক্ষেপ এবং পরোক্ষভাবে ধর্মত্যাগকে উৎসাহিত করার এক ধরনের কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যৌনকর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা সবচেয়ে বেশি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যৌন পেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইনে একে স্বীকৃতি দেওয়া।’ শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এ ধরনের ঘৃণ্য ও ইসলামবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া ঠিক কোন যুক্তিতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তি আইন অনুযায়ী বৈধ। তবে পতিতা হিসেবে কাজ করতে হলে তাকে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে এবং আদালতে উপস্থিত হয়ে এই মর্মে একটি হলফনামা জমা দিতে হবে যে, তারা তাদের নিজস্ব পছন্দ ও জোরজবরদস্তি ছাড়াই পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় খুব সামান্যই। বাংলাদেশের অধিকাংশ যৌনকর্মী অপ্রাপ্তবয়স্ক। এদের জোরপূর্বক এ কাজে বাধ্য করা হয়। অনেক নারী, শিশুকে ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়, যার অধিকাংশ পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক পরিচয়ে বৈধতা পেলে জোরপূর্বক এই পেশায় সংশ্লিষ্ট নিগৃহীত যৌনকর্মীদের অবস্থা যে শোচনীয় হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তাদান এবং শোষণ, সহিংসতা থেকে রক্ষার জন্য আইনি সুরক্ষার বিধান করার সুপারিশ করেছে। কিন্তু যৌন পেশাকে শ্রম আইনে স্বীকৃতি দিলে যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা, সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত করা বাস্তবিক অর্থে কখনোই সম্ভব নয়। একটি কার্যকর পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজে তাদের পুনর্বাসিত করার মধ্য দিয়ে যৌনকর্মীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ভোকেশনাল ট্রেনিং, সাক্ষরতা ও সাধারণ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ, আত্মবিশ্বাস এবং নিজস্ব মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা, নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি উপায়ে একটি কার্যকর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এটি একটি সংবেদনশীল ও বহুমাত্রিক বিষয়।
বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামনে নির্বাচন, চলছে রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে নানা আলোচনার ধারা। এটি একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত হলেও প্রশ্ন থেকে যায় এই সংস্কার কি শুধু ওপরে ওপরে, নাকি এটি কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে? জনগণ কি এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে জড়িত, নাকি আবার শুধু দর্শক হয়ে রইল? ইতিহাস আমাদের এক অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের শরীরে ছিল এমন এক জিন, যা তাদের হলুদ জ্বরের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েছিল। কিন্তু এই জিনগত সুবিধাই হয়ে ওঠে তাদের অভিশাপ। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা এই প্রতিরোধক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাদের দাস বানায়। সমাজে এই কৃষ্ণাঙ্গদের স্থান হয় সবচেয়ে নিচে এবং ক্ষমতার কাঠামো তাদের কোনোদিন সমান চোখে দেখেনি। আমরা যদি এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে বুঝতে পারব শুধু শক্তি থাকলেই তা যথেষ্ট না, সচেতনতা ও অংশগ্রহণ না থাকলে সেই শক্তি ব্যবহৃত হয় অন্যের স্বার্থে, নিজের বিপরীতে।
গণতন্ত্র শুধু রাজনৈতিক নেতাদের বিষয় নয়, এটি নাগরিকেরও দায়। যখন সংস্কারের কথা ওঠে, তখন সেই সংস্কার যেন সবার অংশগ্রহণমূলক হয়, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব জনগণেরও। কোন প্রক্রিয়ায়, কাদের মাধ্যমে, কী উদ্দেশ্যে এই প্রশ্নগুলো করা এবং জানার চেষ্টা করাই সচেতন নাগরিক হওয়ার প্রথম শর্ত। সচেতনতা মানে শুধু সংবাদ পড়া নয় সচেতনতা মানে বিষয়টিকে ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করা, নিজের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে দেখা। কারণ, আজকের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা।
লেখক : শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে নির্বাচন-সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ আদায়ে নিজেদের মতামতের সঙ্গে ঐকমত্যের শরিক ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। বিএনপি বর্তমানে তাদের রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করছে এবং নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এলে জনগণের কল্যাণে তা বাস্তবায়নের আশা ব্যক্ত করছেন দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়নের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের ভিন্নমত বা পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেখা যাচ্ছে, তবুও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অনেকটা একই কাতারে এলেও কিছুটা ভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে এনসিপি। মৌলিক সংস্কার ব্যতিরেকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সংবিধান পুনর্লিখন ও শাসন কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন, এর তত্ত্বাবধানে নতুন সংবিধান তৈরি এবং সেই সংবিধানের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিচ্ছে এনসিপি।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু তাতে ভিন্নমত বা মতপার্থক্য দূর হওয়ার কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচনী রোডম্যাপ ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, দেশের জনগণ আসলে কী চায়? কিছুদিন আগেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে দেশের জনসাধারণ তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে ওঠেন। এ সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং নির্বাচন বিলম্বিত করার মধ্যে কিছু গোষ্ঠীর পরোক্ষ ইচ্ছা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যোগ্য নেতৃত্বই এই পাহাড় সমান জনসমর্থন আদায়ে প্রধান হাতিয়ার। তবে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজগুলোর একটি তাদের নেতৃত্বে চলমান সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা। কিন্তু এই কার্যক্রম নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের মধ্যে একটি হলো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। তারা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সংস্কার প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন প্রস্তাবনাসহ ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে যে সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশনা দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এদিকে প্রতিবেদন প্রকাশের পর এর কিছু সুপারিশ নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
এই সুপারিশমালায় ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইনকে নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুপারিশমালায় মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে অভিন্ন পারিবারিক আইন ঐচ্ছিকভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও ধর্মীয় আইনকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে করা সুস্পষ্ট অবমাননা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত করে। মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টানÑ সব সম্প্রদায়ের বিদ্যমান ধর্মীয় পারিবারিক আইন বাতিল করে একটি কথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আইন প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রস্তাব শুধু ইসলামের বিরুদ্ধেই নয়, বরং হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিও বিরুদ্ধাচরণ করে।
ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে এমন একটি ব্যবস্থা কার্যত ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির ওপর হস্তক্ষেপ এবং পরোক্ষভাবে ধর্মত্যাগকে উৎসাহিত করার এক ধরনের কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যৌনকর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা সবচেয়ে বেশি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যৌন পেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইনে একে স্বীকৃতি দেওয়া।’ শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এ ধরনের ঘৃণ্য ও ইসলামবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া ঠিক কোন যুক্তিতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তি আইন অনুযায়ী বৈধ। তবে পতিতা হিসেবে কাজ করতে হলে তাকে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে এবং আদালতে উপস্থিত হয়ে এই মর্মে একটি হলফনামা জমা দিতে হবে যে, তারা তাদের নিজস্ব পছন্দ ও জোরজবরদস্তি ছাড়াই পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় খুব সামান্যই। বাংলাদেশের অধিকাংশ যৌনকর্মী অপ্রাপ্তবয়স্ক। এদের জোরপূর্বক এ কাজে বাধ্য করা হয়। অনেক নারী, শিশুকে ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়, যার অধিকাংশ পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক পরিচয়ে বৈধতা পেলে জোরপূর্বক এই পেশায় সংশ্লিষ্ট নিগৃহীত যৌনকর্মীদের অবস্থা যে শোচনীয় হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তাদান এবং শোষণ, সহিংসতা থেকে রক্ষার জন্য আইনি সুরক্ষার বিধান করার সুপারিশ করেছে। কিন্তু যৌন পেশাকে শ্রম আইনে স্বীকৃতি দিলে যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা, সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত করা বাস্তবিক অর্থে কখনোই সম্ভব নয়। একটি কার্যকর পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজে তাদের পুনর্বাসিত করার মধ্য দিয়ে যৌনকর্মীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ভোকেশনাল ট্রেনিং, সাক্ষরতা ও সাধারণ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ, আত্মবিশ্বাস এবং নিজস্ব মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা, নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি উপায়ে একটি কার্যকর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এটি একটি সংবেদনশীল ও বহুমাত্রিক বিষয়।
বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামনে নির্বাচন, চলছে রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে নানা আলোচনার ধারা। এটি একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত হলেও প্রশ্ন থেকে যায় এই সংস্কার কি শুধু ওপরে ওপরে, নাকি এটি কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে? জনগণ কি এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে জড়িত, নাকি আবার শুধু দর্শক হয়ে রইল? ইতিহাস আমাদের এক অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের শরীরে ছিল এমন এক জিন, যা তাদের হলুদ জ্বরের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েছিল। কিন্তু এই জিনগত সুবিধাই হয়ে ওঠে তাদের অভিশাপ। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা এই প্রতিরোধক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাদের দাস বানায়। সমাজে এই কৃষ্ণাঙ্গদের স্থান হয় সবচেয়ে নিচে এবং ক্ষমতার কাঠামো তাদের কোনোদিন সমান চোখে দেখেনি। আমরা যদি এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে বুঝতে পারব শুধু শক্তি থাকলেই তা যথেষ্ট না, সচেতনতা ও অংশগ্রহণ না থাকলে সেই শক্তি ব্যবহৃত হয় অন্যের স্বার্থে, নিজের বিপরীতে।
গণতন্ত্র শুধু রাজনৈতিক নেতাদের বিষয় নয়, এটি নাগরিকেরও দায়। যখন সংস্কারের কথা ওঠে, তখন সেই সংস্কার যেন সবার অংশগ্রহণমূলক হয়, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব জনগণেরও। কোন প্রক্রিয়ায়, কাদের মাধ্যমে, কী উদ্দেশ্যে এই প্রশ্নগুলো করা এবং জানার চেষ্টা করাই সচেতন নাগরিক হওয়ার প্রথম শর্ত। সচেতনতা মানে শুধু সংবাদ পড়া নয় সচেতনতা মানে বিষয়টিকে ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করা, নিজের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে দেখা। কারণ, আজকের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্মের অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা।
লেখক : শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৩ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৪ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে