আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের গোড়ার কথা

আমীর খসরু

বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের গোড়ার কথা

বাংলাদেশের সামগ্রিক, অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটটি যে সবেমাত্র বা অতিসম্প্রতি ঘটেছে বা প্রকাশিত অথবা দৃশ্যমান হয়েছেÑএটা নয়। এমনকি এটিও বলা চলে, এই অঞ্চলের অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এ কথাটি প্রযোজ্য। তবে, আমাদের সংকটটি হচ্ছেÑকখনোই আমরা আমাদের সংকটের গোড়ায় যাইনি। এই লেখাটিসহ ভবিষ্যতের কয়েকটি লেখায় সংকটের মূল উদঘাটনের চেষ্টা করা হবে।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্রশক্তিগুলো সব সময়ই চেষ্টা করেছে, যে দেশটি বা ভূখণ্ডটি ঔপনিবেশিকতার অধীন করা সম্ভব হয়েছে, তাকে লুণ্ঠন করা। আর এর জন্য যেসব শোষণ-শাসন সম্ভব, তা তারা করেছে। এর জন্য কর, খাজনার নামে যত বেশি বর্বরতা, রক্তপাত করা সম্ভবÑতার সবই তারা করেছে। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায়, ঔপনিবেশিকতার অপর নাম ‘লুণ্ঠন’। আর এই লুণ্ঠন এবং ঔপনিবেশিক দস্যুতার মাধ্যমে যা যা করা দরকার, তার সবই তারা করেছে এবং এগুলো অনেকেরই জানা। এও জানা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা বাংলার শিল্প, অর্থনীতি ধ্বংস করে গড়ে তুলেছে শিল্পবিপ্লব, মুঘল আমলে সেচভিত্তিক কৃষিব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে খাদ্যসংকটে জর্জরিত এবং আমদানিনির্ভর খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা। এ কথা এখনো মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কৃষিভূমিনির্ভর একটি দেশ। এই ব্যবস্থাকে কয়েক শতাব্দী আগে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করার জন্য উচ্চমাত্রার ভূমিকর আরোপ, ব্রিটিশ কাপড় শিল্পোৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নীলপ্রাপ্তির লক্ষ্যে নীল চাষে বাধ্য করাসহ নানা বর্বর ব্যবস্থা চালু করেছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। এসব অনেকেরই হয়তো জানা। তবে অঙ্কের বা আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে কতটাÑতার হিসাবপত্র থাকলেও সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই মুহূর্তে করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি না। সময়-সুযোগ মতো এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল।

বিজ্ঞাপন

ভূমি, কৃষি এ বিষয়গুলো এ লেখায় বারবার আসবে। কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটটির মূল কারণ আলোচনায় এ বিষয়গুলো জরুরি। এ অঞ্চলের অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটটির শুরুর কারণ হিসেবে দুটো বিষয় আলোচনা অনিবার্য এবং জরুরি। এক. ১৭৬০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া কৃষক আন্দোলন এবং সংগ্রাম। দুই. ১৭৯৩ সালের ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে অনেকে না বুঝে অথবা কুমতলবে ভূমিব্যবস্থার বিষয় বলে বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে বড়মাত্রার ‘রাজনৈতিক ঘটনা’ হিসেবে যদি বিবেচনা করা না হয়Ñতবে তা হবে এক ঐতিহাসিক ভ্রান্তি এবং তাহলে কোনো হিসেবেই রাজনৈতিক সংকটের গোড়া বা মূল কারণ এবং প্রেক্ষাপটটি খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধটিও যে শুধু নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে ব্রিটিশদের লড়াইÑসে বিষয়টিও বোধ করি ঠিক নয়। বাংলাসহ পুরো ভারতে তখন মূলত পর্তুগিজ, ফরাসিসহ বেশ কিছু ঔপনিবেশিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা কোম্পানি ছিল। তাদের মধ্যেও যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব ছিলÑতাও ঐতিহাসিক সত্য। এর মধ্যে ব্রিটিশরা ছিল এগিয়ে। পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম একটি কারণ ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বন্দ্ব এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই। সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ ব্রিটিশরা মুঘল বাংলা সুবাহ (প্রদেশ বা অঞ্চল, যা বাংলা, বিহার, ওড়িশা নিয়ে গঠিত) দখল করে নেয়।

কিন্তু উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটেÑকৃষকশ্রেণি আসল বিষয়টি স্বল্পকালেই খুবই দৃঢ়ভাবে বুঝতে পারে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার কুৎসিত শোষণ, নির্যাতনের বিষয়টি। তারাই ব্রিটিশবিরোধী প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রামের সূচনা করেন। কৃষক আন্দোলন একই সময়ে, একযোগে, একক নেতৃত্বে শুরু হয়নি। বহুমাত্রিক ও বহুকেন্দ্রিক নেতৃত্ব ছিল তাদের। তিন দফায় বা পর্যায়ে কৃষক আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি শুরু হয়। এটির আবার তিনটি পর্যায় ছিলÑএক. ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৯, দুই. ১৭৭০-১৭৭২, তিন. ১৭৮৬ থেকে ১৭৯২ পর্যন্ত। এর পরেও দফায় দফায় কৃষক আন্দোলন হয়েছে বটে, তবে তা আলোচ্য কৃষক সংগ্রামের মতো ছিল না। এর মধ্যে প্রথমপর্যায়টি ছিল ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এবং তা তিন ভাগে অর্থাৎ ১৭৬৩ থেকে ১৭৭৮ সাল পর্যন্ত চলে।

এসব কৃষক সংগ্রাম, আন্দোলন এবং কখনো কখনো সশস্ত্র লড়াই একযোগে, একসময়ে, একক নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে কৃষক সংগ্রাম লড়াই সশস্ত্র যুদ্ধগুলো হয়েছে। অর্থাৎ এই আন্দোলনকে বহুকেন্দ্রিকতার বিশেষণে আখ্যা দেওয়া যায়। এই বিকেন্দ্রায়িত সংগ্রাম রণকৌশল হিসেবে খুবই ইতিবাচক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এর দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, যা এক কথায় অনন্য এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। প্রথমত, যৌথ নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত, অসাম্প্রদায়িকতা। যৌথ নেতৃত্বের সুবিধাটি হচ্ছে, কখনোই লড়াই বা সংগ্রাম নেতৃত্ব-শূন্যতায় পড়বে না। আর অসাম্প্রদায়ীকতার বিষয়টি হচ্ছেÑকৃষকরা একযোগে অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ‘দৃশ্যমান প্রতিনিধি’ এবং দালাল-শ্রেণিÑতারা হিন্দু বা মুসলমান যেই হোক। দীর্ঘ ইতিহাস সংক্ষিপ্ত আকারে বললে বলতেই হবে, শুধু যে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হয়েছে, তাই নয়। নীলকরবিরোধী সশস্ত্র লড়াই ছিল আরো ভয়ংকর এবং ব্রিটিশ শাসন ও তার দেশীয় দালালদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কৃষকদের অসংখ্য লড়াই, সংগ্রাম হয়েছেÑযাদের নামও আমাদের জানতে দেওয়া হয়নি। কারণ, ঔপনিবেশিক শক্তি এবং তার দালাল তথাকথিত ইতিহাসবিদদের কারণে। আর এভাবেই ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে এবং ইতিহাস পাল্টে দেওয়া হয়। যে কারণে তৎকালীন ত্রিপুরার (যা বাংলার অংশ ছিল) অসীম সাহসী বীর কৃষক নেতা শমসের গাজীকে (১৭৬৭-৬৮) চিত্রিত করা হয়Ñ‘ডাকাত সরদার’, দেবী চৌধুরাণীকে ‘দস্যুরাণী’, তিতুমীরকে ওহাবি আন্দোলনের নেতা, হাজি শরিয়তউল্লাহ ইসলামি ধর্মীয় নেতা। অথচ তারা সবাই ছিলেন কৃষক আন্দোলনের এক-একজন মহান পুরুষ এবং তাদের অবদান কোনো ক্রমেই অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ইতিহাস বদলের খেলায় তাদের চিত্রিত করা হচ্ছে ভিন্নভাবে। আর ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, নূরুলদীনের মতো অসংখ্য কৃষক নেতার কথা বাদই দিলাম।

এসব কৃষক আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল দুটিÑএক. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। দুই. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নিজস্ব বোঝাপড়া এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বন্দোবস্তের (Political and economic settlement) মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা। ১৭ শতকের কৃষকদের এই যে ‘বোঝাপড়া এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত’ হচ্ছে পরিপূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম, অংশীদারত্বমূলক রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের ধারণা। অতিসম্প্রতি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তত্ত্ব বা পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট থিওরি নামে নতুন একটি তত্ত্ব নিয়ে পণ্ডিতরা গবেষণা করছেন, যা বাংলার কৃষকরা সম্পন্ন করেছিলেন সেই ১৭ শতকে। তাহলে, প্রকৃত স্বাধীনতার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা কে? প্রকৃত বীর আমরা কাদের বলব? এটি অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের একেবারেই গোড়ার কথা নিয়ে আগেই বলেছিলাম ১৭৯৩ সালের ব্রিটিশদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা। ঔপনিবেশিকতায় আচ্ছন্ন ইতিহাসবিদরা একে শুধু ভূমিব্যবস্থার রদবদল বা সংস্কার হিসেবে দেখলেও বাস্তবে ঘটনাটি তা নয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে মুঘল আমলসহ ওই সময়ের যে ভূমিকর আদায়ের বা আদায়কারীর ব্যবস্থা ছিল, তার আমূল পরিবর্তন করা হলো। জমিদারি বা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি সৃষ্টির মাধ্যমে একটি দালাল গোষ্ঠী তৈরিই ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল উদ্দেশ্য। এর বাইরেও ভূমি ব্যবস্থাপনা সংস্কার এবং করের নামে আয় বৃদ্ধির কথা বলা হলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সঙ্গে যতদূর না ভূমিব্যবস্থা জড়িত, তার চেয়েও বড় মাপে জড়িত সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি এবং দালাল গোষ্ঠী তৈরি করে নিজেদের ক্ষমতার বা শক্তি বৃদ্ধির পাটাতনকে মজবুত করা। মুসলিম জমিদারদের বা ভূমি মালিক অথবা স্বত্বাধিকারীদের স্থানে সহযোগী, সমর্থক বা দালাল হিসেবে হিন্দু উচ্চবর্গের ব্যক্তিদের স্থান করে দেওয়া। এতে রাজনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থায় ওলট-পালট এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় বলেন, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পেছনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল দেশের অধিবাসীদের মধ্য থেকে এমন একটি শ্রেণি তৈরি করা, যে শ্রেণি দেশে ইংরেজ শাসনের স্তম্ভরূপে দণ্ডায়মান থেকে জনগণের ক্রোধানল থেকে এই শাসনকে রক্ষা করতে পারবে। (তথ্যসূত্র : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম; পৃষ্ঠা : ১৩৪)

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার The political parties in India বইয়ে বলেন, ‘ভূমির সঙ্গে সম্পর্কহীনদের জমিদারি পাইয়ে দেওয়া ছাড়াও ইংরেজি জানা একটি শ্রেণির জন্ম দেওয়ার জন্য প্রোপাগান্ডাও শুরু হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। আর রামমোহন রায় ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে এই লক্ষ্যে অর্থ ব্যয় করার পক্ষে প্রচার চালায়’। (তথ্যসূত্র : The political parties in India; পৃষ্ঠা : ১০৬ ও ১০৭)। এর ফলে ফার্সি জানা মুসলমান শিক্ষিত সমাজ পিছিয়ে পড়ে। আর ঔপনিবেশিকতার উদ্দেশ্যও হচ্ছে তাই।

এভাবেই লেখা হয় মতলবি ইতিহাসÑযার খলনায়ককে বানানো হয় নায়ক। আর প্রকৃত নায়ক কৃষক সমাজসহ সাধারণ মানুষকে চিহ্নিত করা হয় খলনায়কে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে ইংরেজি-পড়ুয়া ও জানা পৃথক একটি শ্রেণির জন্ম দেওয়া হয়। জন্ম হয় ইংরেজ বন্দনাকারী একটি নব্য শ্রেণির। যারা ব্রিটিশ-ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও মনেপ্রাণে, চিন্তায়-চেতনায়, মনস্তত্ত্ব ব্রিটিশ। ব্রিটিশদের দালাল শ্রেণি নীলকরবিরোধী কৃষক সংগ্রামকে কঠোর হাতে দমনের জন্য ব্রিটিশ গভর্নরের কাছে আর্জি জানিয়ে স্মারকলিপি পেশ করেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহিদের ঔপনিবেশিকতাবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামÑযাকে কার্ল মার্কস বলেছেন, ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামÑতাকে ওই দেশজ দালাল শ্রেণি বিরোধিতা করেছে। বরং তারা ব্রিটিশদের অর্থে তখন অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে। এই তারাই ১৯০৫ সালে বাংলা বিভক্তি বা বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গকে পৃথক করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলÑতার প্রচণ্ড বিরোধিতা করে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে পৃথক একটি নিজস্ব অঞ্চল, যা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিভূমি বা পাটাতন নির্মাণের স্বপ্নের শুরু হয়। পৃথক রাজনৈতিক, সামাজিক বোধ-বুদ্ধিরও সূচনা হয় এর মাধ্যমে। আর এটি বাতিল করতে বাধ্য করা হয় শুধু ভূমি মালিকানার জন্য বা বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো এই আবেগে নয়; বরং রাজনৈতিক আধিপত্য খোয়া যাওয়া বা হারানোর সীমাহীন ভয়ের কারণে। এখন অবশ্য মতলবি উদ্দেশ্যে আবেগকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে নানা বয়ান তৈরি করা হচ্ছে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবও বাস্তবায়ন করা যায়নি।

কৃষক আন্দোলনের আপাত সফলতা না আসা এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত্তিভূমি বা পাটাতনের বিশাল ভাঙনের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগ এবং দেশভাগের আন্দোলনের বিশাল যে দুর্বলতা এবং সৃষ্ট সংকটÑতা হচ্ছে, কেউই ঔপনিবেশিকতার জঞ্জাল অর্থাৎ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিকসহ সীমাহীন ঔপনিবেশিকতার অনিবার্য ক্ষতির মূল কারণগুলো কতটা ব্যাপক, তা পরিমাপ করে দেখেনি। সর্বক্ষেত্রের ক্ষতির ভারে ভেঙে যাওয়া কাঠামোগত ভিত্তির এবং বিকলাঙ্গ মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের হাত থেকে মুক্তির বিষয়ে সামান্য চিন্তা পর্যন্ত করেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুধু ব্যস্ত ছিলেন দেশ ভাগাভাগিতে। এই সংকট দিনে দিনে ভয়াল সংকটে রূপ নিয়েছে, তা কেউই লক্ষ করেনি।

এ কথা বলতেই হবে উপনিবেশ-উত্তর সমাজ, রাষ্ট্রকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে যে বিনাশ এবং ধ্বংসাত্মক উত্তরাধিকার ঔপনিবেশিকতা রেখে যায়, তা থেকে মুক্তির কোনো প্রচেষ্টা না থাকাই হচ্ছে রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ।

এই সংকটকে বহাল এবং ‘যে অবস্থায় যেমন আছে’Ñতা বহাল রেখে ঔপনিবেশিকতার মতো ভয়াল শক্তি এবং তাদের রোপিত বিষবৃক্ষ ও বিষফলকে বহাল রেখে দেশভাগে মত্ত হলেন নেতারা। শান্তিপূর্ণ পন্থায় অহিংস পথে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতার কুফল থেকে রাষ্ট্র পাওয়া যায় কিন্তু কুফলমুক্ত হওয়া যায় নাÑএ কথাটি বুঝতে না পারাও রাজনৈতিক সংকটের কারণ। কিন্তু সেই পথই আমাদের পূর্বপুরুষরা বেছে নিলেন। এখানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Robert E Kiligaard তার এক নিবন্ধে অহিংস পন্থার মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাধারণত সত্যাগ্রহ বা অহিংস পথকে দেখা হয় ভবিষ্যতের আশাবাদ বা প্রত্যাশা হিসেবে। দ্বন্দ্ব-বিবাদ নিরসনে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতীক্ষার শান্তিপূর্ণ পথ’। এ ক্ষেত্রে বিপ্লবী পথের কথা বলেছেন ফরাসি দার্শনিক Franty Fanon তার The Wretchel of the Earth বইয়ে বলেছেন, ‘বি-ঔপনিবেশিকতা বা ঔপনিবেশিকতার কুফল থেকে মুক্তি আসলে বিপ্লবের মতো শান্তি ভঙ্গের পথ। এটা তারই এজেন্ডা। তবে, এটাও সত্য, কোনো জাদুর কাঠি বা অলৌকিক লাঠি নেই, যা দিয়ে ঔপনিবেশিকতাবাদের কুফল ও ব্যাধি দূর করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন বিপ্লব নামের ভায়োলেন্স।’

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের পূর্বপুরুষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসব মাথায় না নিয়ে চটজলদি বা ইন্সট্যান্ট দেশভাগের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রস্তুতিবিহীন অবস্থায় দেশভাগ করলেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার বইয়ে এ সম্পর্কে বলেন, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো দেশভাগকেই তাদের প্রধান এজেন্ডা হিসেবে নিয়েছিল। কিন্তু দেশভাগের পরে কীভাবে চলবে, তেমন কোনো কর্মসূচি বা কর্মপরিকল্পনা তাদের ছিল না। অথচ উন্নত দেশে এ কর্মপরিকল্পনা একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। ফলে দুটো দেশ ভারত এবং পাকিস্তান হয়েছে সত্য, তবে ঔপনিবেশিকতার কঠিন রোগ, যা সমাজে, রাষ্ট্রেসহ সর্বত্র আরো জোরদার সংকট হিসেবে বিদ্যমান থাকল। বিখ্যাত রাজনীতিবিজ্ঞানী হামজা আলাভী একে শুধু ‘শাসক বদল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যাকে তিনি তত্ত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেনÑ‘Over Developed State’ হিসেবে অর্থাৎ সবকিছু ঠিকঠাক রেখে শুধু শাসক বদল।

আর এ কারণে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি একপর্যায়ে সামরিক শাসনকে দীর্ঘমেয়াদি করেছে। পাকিস্তান গণতন্ত্রকে বিদায় জানিয়েছে। ১৯৪৭-এর পর ১৯৫৯ সালের নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পাকিস্তানপ্রাপ্তির পরে ৯ বছরের মাথায় এসে একটি সংবিধান পাওয়া গেলেও তা অকার্যকর পুস্তক হিসেবেই এখন পর্যন্ত চিহ্নিত রয়েছে। ১৯৭০-এর আগে পাকিস্তানে কোনো সাধারণ নির্বাচন হয়নি। তবে, ঔপনিবেশিকতার কুফলে আক্রান্ত দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেন্টো, সিয়াটোসহ নানা সামরিক চুক্তিতে এবং বিভিন্ন দেশের ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে। দেশ শাসন করেছে সেনাবাহিনী। আর তার সহযোগী হিসেবে গড়ে উঠেছে অভিজাত কুলীন শ্রেণি, আমলাতন্ত্র, ধনিক গোষ্ঠী, বিদেশি ঋণনির্ভর ব্যবসায়ী শ্রেণিসহ ‘অলিগার্কি’।

পাকিস্তানের রাজনীতিবিজ্ঞানী আয়েশা জালাল Democracy and Authoritarianism in South Asia শীর্ষক বইয়ে বলেন, ভারতের সবল নেতৃত্ব প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি করে সাধারণ নির্বাচন দিতে পারলেও পাকিস্তান সে ক্ষেত্রেও ব্যর্থ হয়েছে।

এখানে বলা একান্তই বাঞ্ছনীয়, যে বন্দোবস্তের কারণে বোঝাপড়ার জন্য ১৭৬৩ থেকে ১৮ শতকের এক বিশাল সময়কালে সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম এবং লড়াই হয়েছিল অর্থাৎÑএক. নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, দুই. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নিজস্ব বোঝাপড়া এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বন্দোবস্তÑতা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৪৭ সালে এবং পরে পাকিস্তানের সময়ে কৃষকদের ওই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষাকে অবজ্ঞা তো বটেই বরং অস্বীকার করা হয়েছে। রাজনৈতিক গবেষক, লেখক তাজুল ইসলাম হাসমী তার বই ‘পাকিস্তান : দ্য পিজনস ইউটোপিয়া’তে দেখিয়েছেন, বিশেষ করে পূর্বপাকিস্তানের কৃষকদের কাছে পাকিস্তান একটি কল্পরাজ্য বা স্বপ্নলোক। অর্থাৎ পাকিস্তান তাদের কাছে একটি আশাভঙ্গের বাস্তবতা।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ আসলে যে বিপ্লব ছিল এবং এটি ছিল অপ্রাপ্তির আবার হিস্যা আদায়ের বিপ্লবÑতাও আমলে নেওয়া হয়নি ইচ্ছাকৃতভাবে। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে এসে বিপ্লবকে অর্থাৎ মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে আবার ব্যর্থ করে দেওয়া হলো। একদলীয় শাসন, জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, ফ্যাসিস্ট শাসনসহ অনেক কিছুই আমাদের দেখতে হচ্ছে। এখানে তার আর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই এ কারণে যে, সবাই এর ভুক্তভোগী।

১৯৭১-এর বদলা হিস্যা অর্থাৎ ন্যায়-নীতি-ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধে আবার ২০২৪-এর বিপ্লব। এই বিপ্লবকেও অবজ্ঞা, অবহেলা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন ভোট, সংস্কারসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যাকে জরাজীর্ণ ভবনে চুনকাম, কুশ্রী চেহারায় মুখোশ পরানো অথবা প্লাস্টিক সার্জারির সঙ্গে তুলনা করা চলে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ‘ন্যায়-নীতি-ন্যায্যতা’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বোঝাপড়া ও বন্দোবস্ত’ সম্পন্ন হবে এবং ‘আমি বা আমার’ বদলে ‘আমাদের দেশে’ পরিণত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বারবার-অসংখ্যবার ন্যায্য প্রাপ্য হিস্যা আদায়ে নেমে আসবে রাজপথে। ১৯৪৭-এর পরিণতি ১৯৭১, আবার ১৯৭১-এর পরিণতি ২০২৪। এই দুষ্টচক্র থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবেই।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিজ্ঞানী Hanna Arendt-এর বক্তব্য দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। হান্না আরন্ডেট তার বই On Revolution-এ বলছেন, বিপ্লবের অর্থ শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়। বিপ্লবের আসল অর্থ হচ্ছে জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, দারিদ্র্য, অধিকারহীনতা থেকে রাজনৈতিক মুক্তি বা স্বাধীনতা। এটি শুধু সামাজিক বা অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান নয়। বরং একটি নতুন রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠাÑযাতে জন-অংশীদারত্ব থাকবে এবং নতুন রাজনৈতিক কাঠামো বিনির্মাণ বা তৈরি হবে। আরন্ডেট স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবেই মনে করেছেন, যেখানে মানুষ একসঙ্গে জনপরিসরে একত্র হয়ে চিন্তা করার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায়। এই সুযোগ যেন হয় নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতা সৃষ্টি। (তথ্যসূত্র : Hanna Arendt; On Revolution; Penguin Books, Nwe York; 1991)

এমন এক জনবান্ধব রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রত্যাশায় জনমানুষ উন্মুখ হয়ে আছে। আর যদি তা বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে পথ যত কঠিন, পিচ্ছিল, রক্তস্নাতই হোকÑকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ অর্জনে ও প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ আবার ন্যায্য হিস্যা আদায়ে পথে নামবে।

লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন