সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার তার জীবনের শেষ লেখা হিসেবে ছাপার ফুটনোটসহ একটি অনলাইনে লেখা পাঠিয়েই নিজের মোবাইল বাসায় রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। খোঁজ না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা তার সন্ধান পেতে পুলিশের শরণাপন্ন হন, থানায় জিডি করেন। একদিন পরই বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ পাওয়া গেল মেঘনা নদীতে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারকে এই প্রজন্মের অনেকেই চিনেন না। জীবনের শেষ লেখায় বিভুরঞ্জন সরকার নিজের পচিয় দিয়েছেন এভাবে, “আমি বিভুরঞ্জন সরকার, ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। সাংবাদিকতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাঁচ দশকের বেশি সময়ের।’
পাঁচ দশকে তিনি দৈনিক আজাদ থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক রূপালীতে কাজ করেছেন। নিজে সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক ‘চলতিপত্র’। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ‘মৃদুভাষণ’ নামের সাপ্তাহিকে। ‘দৈনিক মাতৃভূমি’ নামের একটি দৈনিকের সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। এর বাইরেও অনেকগুলো পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। এই পরিচয় বিভুরঞ্জন সরকার নিজেই দিয়েছেন।
পাঁচ দশকের সাংবাদিক জীবন শেষে একজন মানুষ যখন অনেক আক্ষেপ নিয়ে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন, তখন অনেকের মনে তা দাগ কাটবে এটাই স্বাভাবিক। বিভুরঞ্জন সরকার আক্ষেপ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এ-ডাল ও-ডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি। আমার কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না। দুঃখই হোক আমার জীবনের শেষ সঙ্গী। আর পৃথিবীর সব প্রাণী সুখী হোক।’
বিভুরঞ্জনের এই আক্ষেপ ছাপিয়ে অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার একটি কথা, ‘সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়’। এ কথাটি অনেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যে বিভুরঞ্জন সরকার সত্য লিখেছেন বলে তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হলো। তার আত্মহত্যার জন্য কায়দা করে বর্তমান সরকারকে দায়ী করতেও ছাড়েনি অনেকে।
অথচ বিভুরঞ্জন সরকার তার শেষ লেখাতেই আত্মহত্যার পেছনের আক্ষেপ তুলে ধরেছেন। তার লেখা বিশ্লেষণ করলে এ আত্মহত্যার জন্য দায় রাষ্ট্রব্যবস্থার, সাংবাদিক সংগঠনগুলো, সাংবাদিক নেতারা ও ফ্যাসিবাদপন্থি সাংবাদিকরা।
রাষ্ট্র এ মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। কারণ ৫৮ বছরে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাংবাদিকদের জন্য এমন বিধিব্যবস্থা সৃষ্টি করা যায়নি। যেখানে একজন সাংবাদিক তার যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য পাওয়ানার নিশ্চয়তা নিয়ে চাকরি করতে পারেন।
সাংবাদিকদের সংগঠন ও সাংবাদিক নেতারাও এ দায় এড়াতে পারেন না। কারণ তারা সাংবাদিকতা পেশাটিকে একটা ‘অনিশ্চিত পেশা’ বানিয়ে রেখেছেন। এ থেকে উত্তরণের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা কখনোই দেখা যায়নি।
এবার আসা যাক ফ্যাসিবাদের পক্ষের সাংবাদিক গোষ্ঠী, যারা তার আত্মহত্যাকে বর্তমান সরকারের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করছেন, তারা নিজেরাই কীভাবে এই আত্মহত্যায় ভূমিকা রেখেছেন সে বিষয়ে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আর্থরাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অনেক রোগ ছিল তার শরীরে। তার সঙ্গে ফাইট দিয়ে চলতে মাসে শুধু ওষুধের খরচই ছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা।
চিকিৎসা খরচ ও সংসারের ব্যয় সংকুলান করতে গিয়ে তাকে ধারদেনা করতে হয়েছে। সেই ধারের চাপ ছিল তার মাথায়। এসব চাপ মাথায় নিয়ে আক্ষেপ নিয়ে বিভুরঞ্জন সরকার লিখেছেন, “শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা পরিচয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একপর্যায়ে লাজলজ্জা ভুলে আমিও শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্যের আবেদন করে কোনো ফল পাইনি। অনেক সাংবাদিক প্লট পেয়েছেন।
আমি দুবার আবেদন করেও সফল হইনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও নাকি কতজন ভাগ্য বদলেছেন। অথচ আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দুটি বইয়ের জন্য আমি দুই টাকাও রয়্যালটি পাইনি। একেই বলে কপাল! তবে হ্যাঁ, একবার শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল।
ওই সফরের জন্য কিছু হাতখরচের টাকা আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো ওই কোট, প্যান্ট, জুতো কিনতেই শুধু শেষ হয় আরো দেনা হয়েছে। ...শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অবিচল অবস্থানের কারণে আমাকে আজও ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনো বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি পেলাম না একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে ঋণের বোঝা বেড়েছে। স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে পরিবারের দায়বদ্ধতা আমাকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে রাখে।”
বিভুরঞ্জন সরকার ছিলেন মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগ। তিনি ১৬ বছর ধরে তার মাথা আওয়ামী বয়ান উৎপাদনে ব্যয় করেছেন। দু-একটা টিভি টকশোতে তার সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। তিনি মৃদুভাষী। তবে আওয়ামীভাষীই ছিলেন।
আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শেখ হাসিনা স্বপ্নপূরণের সফল কারিগর শিরোনামে বই লিখে তার জন্য রয়্যালটি পর্যন্ত না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। আগামী প্রকাশনীর মালিক আওয়ামী সুবিধাভোগী ওসমান গনি কেন লেখককে রয়্যালটি দেননি, সেই প্রশ্নটি কিন্তু কেউ তুলছেন না। বইটি সম্পর্কে অনলাইনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনিবার্য নাম শেখ হাসিনা।
সেই ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনো বিরোধীদলীয় নেতা আবার কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে ভূমিকা পালন করে আসছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। দুই অসাধারণ গুণ-সাহস ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সমাহার ঘটেছে তার চরিত্রে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় তিনি পার্বত্য শান্তিচুক্তি, বিডিআর বিদ্রোহ দমন, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি অসম সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ তা বাস্তবায়ন করেছেন।
ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিক হিসেবে শেখ হাসিনারও নিশ্চয়ই কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে তার মূল্যায়ন করতে হলে তাকে দেখতে হবে সমগ্রতায়। সমগ্রতার মূল্যায়নে তিনি নিশ্চিতভাবে এক সফল রাষ্ট্রনায়ক।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে লেখক শেখ হাসিনাকে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বইটি পড়া শেষ করলে পাঠক কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকবেন এবং এই উপলব্ধিতে পৌঁছাবেন যে, লেখক নিজের অথবা পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করেননি। আর নিন্দুকেরা বলতে বাধ্য হবেন, শেখ হাসিনাকে অপছন্দ করা যায়; কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না।’
বইটি সম্পর্কে যে সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে, তাতে কি কোনোভাবে লেখক বিভুরঞ্জন সরকারকে গণতন্ত্রের পক্ষের একজন নির্মোহ লেখক বলা যায়? ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে হয়েছে বইটি। যখন শেখ হাসিনাকে স্বপ্নপূরণের সফল কারিগর ও সফল রাষ্ট্র নায়ক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সোয়া তিন শ পৃষ্ঠা ব্যয় করে ফেলেছেন বিভুরঞ্জন সরকার, তখন শেখ হাসিনা চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছেন।
আসলে বিভুরঞ্জন সরকারের চেষ্টাটা ছিল শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করে অন্য কালচারাল ফ্যাসিস্ট ও সাংবাদিকদের মতোই কিছু আর্থিক আনুকূল্য আদায় করা। তিনি তা পেতে এডাল-ওডাল করেও সুবিধা করে উঠতে পারেননি। সেখানে বাধা হয়ে উঠেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষ নেওয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বিরাই। তাকে পেছনে ফেলে অন্যরা যে সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন, সে কথা লিখতেও ভুল করেননি বিভুরঞ্জন। তার অক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়ে নিজেই লিখেছেন, ‘আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এডাল-ওডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি। আমার কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না।’
আওয়ামী ফ্যাসিবাদ গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতায় কারিশমা দেখাতে পারেননি বিভুরঞ্জন সরকার। তিনি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সে দায় নিজেরা না নিয়ে ফ্যাসিবাদের পক্ষে দাঁড়ানো সাংবাদিকরা উল্টো গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে ঠেলে দিচ্ছে বলেই এই কথাগুলো লিখতে হচ্ছে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের দুটি সন্তানই মেধাবী। তার মেয়ে চিকিৎসক। তিনি সরকারি চাকরি করেন। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিষয়ে ক্লিনিক্যাল অংশে পাস করেছেন। বাকি আছে শুধু থিসিস। প্রথমবার কিছু বিচ্যুতির কারণে রেজাল খারাপ হলেও দ্বিতীয়বার খুব সহজেই পাস হয়ে যায়। তার ছেলেটি ছোটবেলা থেকে গুলেবারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হলেও মেধাবী। তিনি বুয়েট পাস ইঞ্জিনিয়ার। এমন দুটি মেধাবী সন্তানের বাবার কেন আত্মহত্যা করতে হবে! বিভুরঞ্জনের কাছের লোকদের কোনো অবহেলা বা অসহযোগিতা তাকে হতাশায় ঠেলে দিয়েছে কি না—সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।
তবে সাংবাদিকদের অনিশ্চয়তার পেশার অবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য বিভুরঞ্জন সরকারের আত্মহত্যা একটি শিক্ষা হতে পারে। সাংবাদিকদের জন্য সব প্রতিষ্ঠানে ওয়েজবোর্ড ও ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা জরুরি। অবসরকালীন সুবিধা নিশ্চিত করাটাও সময়ের দাবি।
মালিক পক্ষ চাইলেই যখন-তখন চাকরিচ্যুত করতে যেন না পারে সে বিষয়েও নজর দেওয়া উচিত। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর উচিত ব্র্যাকেটবন্দি পরিচয় বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে হয়তো কাউকে শেষ বয়সে আর বিভুরঞ্জন সরকারের মতো আত্মহননের পথ বেছে নিতে হবে না।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার তার জীবনের শেষ লেখা হিসেবে ছাপার ফুটনোটসহ একটি অনলাইনে লেখা পাঠিয়েই নিজের মোবাইল বাসায় রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। খোঁজ না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা তার সন্ধান পেতে পুলিশের শরণাপন্ন হন, থানায় জিডি করেন। একদিন পরই বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ পাওয়া গেল মেঘনা নদীতে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারকে এই প্রজন্মের অনেকেই চিনেন না। জীবনের শেষ লেখায় বিভুরঞ্জন সরকার নিজের পচিয় দিয়েছেন এভাবে, “আমি বিভুরঞ্জন সরকার, ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। সাংবাদিকতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাঁচ দশকের বেশি সময়ের।’
পাঁচ দশকে তিনি দৈনিক আজাদ থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক রূপালীতে কাজ করেছেন। নিজে সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক ‘চলতিপত্র’। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ‘মৃদুভাষণ’ নামের সাপ্তাহিকে। ‘দৈনিক মাতৃভূমি’ নামের একটি দৈনিকের সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। এর বাইরেও অনেকগুলো পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। এই পরিচয় বিভুরঞ্জন সরকার নিজেই দিয়েছেন।
পাঁচ দশকের সাংবাদিক জীবন শেষে একজন মানুষ যখন অনেক আক্ষেপ নিয়ে সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন, তখন অনেকের মনে তা দাগ কাটবে এটাই স্বাভাবিক। বিভুরঞ্জন সরকার আক্ষেপ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এ-ডাল ও-ডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি। আমার কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না। দুঃখই হোক আমার জীবনের শেষ সঙ্গী। আর পৃথিবীর সব প্রাণী সুখী হোক।’
বিভুরঞ্জনের এই আক্ষেপ ছাপিয়ে অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার একটি কথা, ‘সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়’। এ কথাটি অনেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যে বিভুরঞ্জন সরকার সত্য লিখেছেন বলে তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হলো। তার আত্মহত্যার জন্য কায়দা করে বর্তমান সরকারকে দায়ী করতেও ছাড়েনি অনেকে।
অথচ বিভুরঞ্জন সরকার তার শেষ লেখাতেই আত্মহত্যার পেছনের আক্ষেপ তুলে ধরেছেন। তার লেখা বিশ্লেষণ করলে এ আত্মহত্যার জন্য দায় রাষ্ট্রব্যবস্থার, সাংবাদিক সংগঠনগুলো, সাংবাদিক নেতারা ও ফ্যাসিবাদপন্থি সাংবাদিকরা।
রাষ্ট্র এ মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। কারণ ৫৮ বছরে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাংবাদিকদের জন্য এমন বিধিব্যবস্থা সৃষ্টি করা যায়নি। যেখানে একজন সাংবাদিক তার যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য পাওয়ানার নিশ্চয়তা নিয়ে চাকরি করতে পারেন।
সাংবাদিকদের সংগঠন ও সাংবাদিক নেতারাও এ দায় এড়াতে পারেন না। কারণ তারা সাংবাদিকতা পেশাটিকে একটা ‘অনিশ্চিত পেশা’ বানিয়ে রেখেছেন। এ থেকে উত্তরণের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা কখনোই দেখা যায়নি।
এবার আসা যাক ফ্যাসিবাদের পক্ষের সাংবাদিক গোষ্ঠী, যারা তার আত্মহত্যাকে বর্তমান সরকারের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করছেন, তারা নিজেরাই কীভাবে এই আত্মহত্যায় ভূমিকা রেখেছেন সে বিষয়ে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আর্থরাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অনেক রোগ ছিল তার শরীরে। তার সঙ্গে ফাইট দিয়ে চলতে মাসে শুধু ওষুধের খরচই ছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা।
চিকিৎসা খরচ ও সংসারের ব্যয় সংকুলান করতে গিয়ে তাকে ধারদেনা করতে হয়েছে। সেই ধারের চাপ ছিল তার মাথায়। এসব চাপ মাথায় নিয়ে আক্ষেপ নিয়ে বিভুরঞ্জন সরকার লিখেছেন, “শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা পরিচয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একপর্যায়ে লাজলজ্জা ভুলে আমিও শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্যের আবেদন করে কোনো ফল পাইনি। অনেক সাংবাদিক প্লট পেয়েছেন।
আমি দুবার আবেদন করেও সফল হইনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও নাকি কতজন ভাগ্য বদলেছেন। অথচ আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দুটি বইয়ের জন্য আমি দুই টাকাও রয়্যালটি পাইনি। একেই বলে কপাল! তবে হ্যাঁ, একবার শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল।
ওই সফরের জন্য কিছু হাতখরচের টাকা আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো ওই কোট, প্যান্ট, জুতো কিনতেই শুধু শেষ হয় আরো দেনা হয়েছে। ...শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অবিচল অবস্থানের কারণে আমাকে আজও ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনো বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি পেলাম না একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে ঋণের বোঝা বেড়েছে। স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে পরিবারের দায়বদ্ধতা আমাকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে রাখে।”
বিভুরঞ্জন সরকার ছিলেন মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগ। তিনি ১৬ বছর ধরে তার মাথা আওয়ামী বয়ান উৎপাদনে ব্যয় করেছেন। দু-একটা টিভি টকশোতে তার সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। তিনি মৃদুভাষী। তবে আওয়ামীভাষীই ছিলেন।
আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত শেখ হাসিনা স্বপ্নপূরণের সফল কারিগর শিরোনামে বই লিখে তার জন্য রয়্যালটি পর্যন্ত না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। আগামী প্রকাশনীর মালিক আওয়ামী সুবিধাভোগী ওসমান গনি কেন লেখককে রয়্যালটি দেননি, সেই প্রশ্নটি কিন্তু কেউ তুলছেন না। বইটি সম্পর্কে অনলাইনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনিবার্য নাম শেখ হাসিনা।
সেই ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনো বিরোধীদলীয় নেতা আবার কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে ভূমিকা পালন করে আসছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। দুই অসাধারণ গুণ-সাহস ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সমাহার ঘটেছে তার চরিত্রে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় তিনি পার্বত্য শান্তিচুক্তি, বিডিআর বিদ্রোহ দমন, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি অসম সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ তা বাস্তবায়ন করেছেন।
ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিক হিসেবে শেখ হাসিনারও নিশ্চয়ই কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে তার মূল্যায়ন করতে হলে তাকে দেখতে হবে সমগ্রতায়। সমগ্রতার মূল্যায়নে তিনি নিশ্চিতভাবে এক সফল রাষ্ট্রনায়ক।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে লেখক শেখ হাসিনাকে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বইটি পড়া শেষ করলে পাঠক কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকবেন এবং এই উপলব্ধিতে পৌঁছাবেন যে, লেখক নিজের অথবা পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করেননি। আর নিন্দুকেরা বলতে বাধ্য হবেন, শেখ হাসিনাকে অপছন্দ করা যায়; কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না।’
বইটি সম্পর্কে যে সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে, তাতে কি কোনোভাবে লেখক বিভুরঞ্জন সরকারকে গণতন্ত্রের পক্ষের একজন নির্মোহ লেখক বলা যায়? ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে হয়েছে বইটি। যখন শেখ হাসিনাকে স্বপ্নপূরণের সফল কারিগর ও সফল রাষ্ট্র নায়ক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সোয়া তিন শ পৃষ্ঠা ব্যয় করে ফেলেছেন বিভুরঞ্জন সরকার, তখন শেখ হাসিনা চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদের রূপ পরিগ্রহ করেছেন।
আসলে বিভুরঞ্জন সরকারের চেষ্টাটা ছিল শেখ হাসিনাকে তুষ্ট করে অন্য কালচারাল ফ্যাসিস্ট ও সাংবাদিকদের মতোই কিছু আর্থিক আনুকূল্য আদায় করা। তিনি তা পেতে এডাল-ওডাল করেও সুবিধা করে উঠতে পারেননি। সেখানে বাধা হয়ে উঠেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষ নেওয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বিরাই। তাকে পেছনে ফেলে অন্যরা যে সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন, সে কথা লিখতেও ভুল করেননি বিভুরঞ্জন। তার অক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়ে নিজেই লিখেছেন, ‘আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এডাল-ওডাল করে কোনো শক্ত ডাল ধরতে পারিনি। আমার কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না।’
আওয়ামী ফ্যাসিবাদ গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতায় কারিশমা দেখাতে পারেননি বিভুরঞ্জন সরকার। তিনি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সে দায় নিজেরা না নিয়ে ফ্যাসিবাদের পক্ষে দাঁড়ানো সাংবাদিকরা উল্টো গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে ঠেলে দিচ্ছে বলেই এই কথাগুলো লিখতে হচ্ছে।
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের দুটি সন্তানই মেধাবী। তার মেয়ে চিকিৎসক। তিনি সরকারি চাকরি করেন। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিষয়ে ক্লিনিক্যাল অংশে পাস করেছেন। বাকি আছে শুধু থিসিস। প্রথমবার কিছু বিচ্যুতির কারণে রেজাল খারাপ হলেও দ্বিতীয়বার খুব সহজেই পাস হয়ে যায়। তার ছেলেটি ছোটবেলা থেকে গুলেবারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হলেও মেধাবী। তিনি বুয়েট পাস ইঞ্জিনিয়ার। এমন দুটি মেধাবী সন্তানের বাবার কেন আত্মহত্যা করতে হবে! বিভুরঞ্জনের কাছের লোকদের কোনো অবহেলা বা অসহযোগিতা তাকে হতাশায় ঠেলে দিয়েছে কি না—সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।
তবে সাংবাদিকদের অনিশ্চয়তার পেশার অবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য বিভুরঞ্জন সরকারের আত্মহত্যা একটি শিক্ষা হতে পারে। সাংবাদিকদের জন্য সব প্রতিষ্ঠানে ওয়েজবোর্ড ও ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা জরুরি। অবসরকালীন সুবিধা নিশ্চিত করাটাও সময়ের দাবি।
মালিক পক্ষ চাইলেই যখন-তখন চাকরিচ্যুত করতে যেন না পারে সে বিষয়েও নজর দেওয়া উচিত। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর উচিত ব্র্যাকেটবন্দি পরিচয় বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে হয়তো কাউকে শেষ বয়সে আর বিভুরঞ্জন সরকারের মতো আত্মহননের পথ বেছে নিতে হবে না।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে