
বেঞ্জামিন আশরাফ

গাজা থেকে প্রায় চার হাজার মাইল দূরে, গোয়ার ঘন ম্যানগ্রোভে ঢাকা পাহাড়ে তরুণ ইসরাইলিরা ট্রান্স মিউজিকের তালে তালে নৃত্য করছে। এখানে শিশুর কাফনের পাশে মায়ের আর্তনাদ শোনা যায় না। গণহত্যার কোনো আঁচ এখানে লাগছে না।
আন্দিজের উপত্যকা থেকে শুরু করে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত, একই দৃশ্য দেখা যায়। ইসরাইলিরা একে বলে ‘তারমিলাউত’। সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর একটি আনুষ্ঠানিক প্রমোদভ্রমণ ও আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থা এটি।
২০১৮ সালের এক ইসরাইলি গবেষণায় বলা হয়েছিল, প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব শেষে ভ্রমণে যায়। কয়েক হাজার ডলারের বিনিময়ে ভ্রমণ সংস্থাগুলো এই প্যাকেজ বিক্রি করে। এতে ‘সবকিছু ভুলে মাতাল সময় পার করতে’ পারে সৈন্যরা। এতে থাকে ছাড়মূল্যে বিমান টিকিট, ইহুদি খাদ্য আর পাঁচতারা হোটেল।
নোভা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হত্যাকাণ্ড আর গাজার গণহত্যার দুই বছর পর ইসরাইলিরা এখন ‘মুক্তি’ শব্দটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে। ইসরাইলিরা বিদেশ ভ্রমণে যেতে চায় হা’মাতজাভ থেকে মুক্তি পেতে। যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘পরিস্থিতি’। এই শব্দের মধ্য দিয়ে ওরা গাজায় যা চলছে, তাকে ছোট করে দেখাতে চায়। এদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো মুক্তি নেই। গাজার সমুদ্র, আকাশ আর সব সীমান্ত পথ করে দেওয়া হয়েছে।
যখন ইসরাইলিরা ‘সবকিছু ভুলে মাতাল সময় পার করছে’, তখন ফিলিস্তিনিরা যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাচ্ছে।
একজন ইসরাইলি সৈন্য টানা তিন বছর দখলকৃত পশ্চিমতীরের চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের বুকের ওপর ঝোলানো এম-১৬ রাইফেলের কারণে ধীরে ধীরে তাদের দেহও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। এই অবস্থার প্রতিকার হিসেবে রাষ্ট্র তাদের হাতে তুলে দেয় একটি ভ্রমণের ব্যাগ আর ওয়ানওয়ে টিকিট। এই প্রমোদভ্রমণ শুধু তাদের কাজের পুরস্কার নয়, তাদের অপরাধকে মাটিচাপা দেওয়ার একটি বন্দোবস্তও বটে। তারা আশা করে এই ভ্রমণ ও আনন্দোৎসব তাদের অপরাধ স্মৃতি ভুলিয়ে দেবে।
এ কারণে তারমিলাউত ইসরাইলে প্রায় বাধ্যতামূলক একটা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র নিজেই তার নাগরিকদের এ কাজে উৎসাহিত করে। তারা যেমন ইউরোভিশন বা ব্র্যান্ড ইসরাইলের মতো অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সৈন্যদের অপরাধবোধ ভুলিয়ে রাখার কাজ করে, এটিও তেমন।
অ্যালডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড উপন্যাসের কথা মনে পড়ে? এতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মাদক ‘সোমা’ শুধু আরাম আর আনন্দের অনুভূতিই তৈরি করত না, এটি ব্যবহারকারীকে তার অপরাধ ভুলতেও সাহায্য করত।
ইসরাইলের ব্যাপারটিও এমন। আর সৈন্যরাও বোঝে, ভোগ বিলাস জিনিসটা নিতান্তই রাজনৈতিক বিষয়। খোদ ইসরাইলের কূটনীতিকরাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিসিম বেন-শিত্রিত বলেছিলেন, ‘আমরা সংস্কৃতিকে দেখি প্রথম শ্রেণির প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে। আমি প্রোপাগান্ডা আর সংস্কৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না।’
তিন বছর পর আরেক ইসরাইলি কূটনীতিক ইদো আহারোনি বলেছিলেনÑ‘ইসরাইলের জন্য আকর্ষণীয় হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সঠিক হওয়া নয়।’
ইসরাইল ‘সংস্কৃতি’ রপ্তানি করে যা অর্জন করতে পারে, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। সংস্কৃতির মাধ্যমে তারা দখলদারিত্বকে লাইফস্টাইলের অংশ হিসেবে তুলে ধরে। এরা প্রমাণ করেছে, সহিংসতা আর স্বাভাবিকতা একই সঙ্গে চলতে পারে, এমনকি মৌজ-মাস্তিও।
এটি একধরনের মুক্তির অনুভূতি দেয়। দেয় ‘নিজেকে হারিয়ে ফেলার’ সুযোগ। সেই সঙ্গে গণহত্যাকে ভুলে যেতেও সহযোগিতা করে। ইসরাইলিদের মানসপটে ফিলিস্তিনিরা তাই শুধু শান্তি বিঘ্নিতকারী উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইসরাইলিরা নিজেদের নিশ্চিন্ত আর উদারপন্থি হিসেবে তুলে ধরে। এর ফলে পশ্চিমারা কোনো অপরাধবোধ ছাড়াই নির্দ্বিধায় এই গণহত্যাকারীদের সঙ্গ উপভোগ করতে পারে। পশ্চিমারা ইসরাইলিদের পরিচয় করিয়ে দেয় ‘আমাদের একজন’ হিসেবে। আর ফিলিস্তিনিরা পশ্চিমাদের মধ্যে হাজির হলে ওদের পার্টি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়।
উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখা সত্যিকার অর্থেই ইসরাইলের একটি জাতীয় প্রকল্প। নিজেকে ভোগবিলাসের তীর্থস্থান হিসেবে তুলে ধরতে বহু দশক ধরে ইসরাইল কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে। ব্র্যান্ড ইসরাইল নামক প্রকল্পের কথাই ধরুন। ২০০৬ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্প ছিল রাষ্ট্র-পরিকল্পিত ব্র্যান্ডিং প্রকল্প। বিকিনি আর সমুদ্রসৈকত ছিল এর অন্যতম অনুষঙ্গ।
এর শুরুটা হয়েছিল ইসরাইলি কূটনীতিক ইদো আহারোনি কর্তৃক একটি টিম গড়ে তোলার মাধ্যমে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পিআর প্রতিষ্ঠান বারসন-মার্স্টেলার। এই প্রতিষ্ঠানটি আর্জেন্টাইন জান্তা আর ভোপাল দুর্ঘটনার পর ইউনিয়ন কার্বাইডকে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য কুখ্যাত ছিল।
আহারোনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ইসরাইলকে সঠিক প্রমাণ করা নয় বরং আকর্ষণীয় করে তোলাই আসল উদ্দেশ্য। এতে শালীনতার কোনো বালাই ছিল না। ব্র্যান্ড ইসরাইলের প্রথম দিককার কাণ্ডগুলোর একটি ছিল ম্যাক্সিম ম্যাগাজিনে আমেরিকান পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য একটি ফটোশুট। এর শিরোনাম ছিল ‘উইমেন অব দ্য ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস।’ সদ্য ‘মিস ইসরাইল’ খেতাব পাওয়া অভিনেত্রী গ্যাল গাদোত এতে অন্তর্বাস পরে হাজির হয়েছিলেন।
যদি এটি ২০২৫ সালে প্রকাশ পেত, আমরা হয়তো বলতাম, ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম থার্স্ট ট্র্যাপ তৈরি করছে।’ ব্র্যান্ড ইসরাইলের এই প্রজেক্ট পুরানা হয়ে গেলে এরা খোলামেলা পোশাকে নারী প্রদর্শনের বদলে সমকামীদের প্রাইড প্যারেড চালু করল।
২০১১ সালের মধ্যে ইসরাইলি পর্যটন বোর্ড প্রায় ১০ কোটি ডলার ব্যয় করছিল তেল আবিবকে ‘গে ভ্যাকেশন ডেস্টিনেশন’ হিসেবে প্রচার করার জন্য। তারপর থেকে এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের প্রতি মেকি দরদ দেখানো তাদের রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। আজও তেল আবিব ঝলমল আড়ম্বরের ভাবমূর্তি রক্ষা করে চলেছে।
এরা ইসরাইলিদের আকর্ষণীয় আর ফিলিস্তিনিদের পশ্চাৎপদ হিসেবে তুলে ধরে। সেই সঙ্গে এমন ভাব ধরে যেন ইসরাইল কুইয়ার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কাজ করে। এলিয়াস জাহশান লিখেছেন, এগুলো নিছক ঔপনিবেশিক ছলচাতুরী। অধিকার রক্ষার নামে সাতরঙা বোমা। এদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভাজন সৃষ্টি করা।
পার্টি, প্যারেড আর উৎসবগুলোর মুখোশ সরিয়ে ফেললেই বোঝা যায়, ইসরাইল মূলত ভোগ-বিলাসকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছে। এমন নয় যে এসব কৌশল প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্ণবৈষম্যমূলক দক্ষিণ আফ্রিকাও একই কাজ করেছিল। ক্রিকেট খেলা আর সানসিটির বিনোদনের মাধ্যমে শাসকরা তাদের ঔপনিবেশিক নৃশংসতা আড়াল করে রাখত।
এখন গোয়াসহ যেমন অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটের স্থানীয়রা ইসরাইলি ভ্রমণকারীদের নিয়ে অভিযোগ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে পুরো থ্রেড ভরে আছে তাদের উন্নাসিক মনোভাবের সমালোচনায়। তারা বলে, ইসরাইলিরা তাদের আনন্দ উপভোগকেও একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি মনে করে। তারা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গেও পাওনাদারের মতো আচরণ করে।
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। দখল করা পূর্ব জেরুসালেমে শুফাত শরণার্থীশিবিরের পাশে অবৈধ ইসরাইলি বসতি ফ্রেঞ্চ হিলের কাছে থাকাকালে আমি এদের আচরণ দেখেছি। ইসরাইলিরা নিজেদের দখলদারিত্বে নিজেরাই বিরক্ত হয়ে একই কথা বারবার বলতে থাকতÑ‘আমরা কেন শুধু একটু আনন্দ করতে পারি না?’
এদের আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে ইসরাইলি সমাজ আর বিকশিত হতে পারছে না। তারা অন্যদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা শান্তির খোঁজ করে। তাদের আনন্দ নির্ভর করে অন্যদের ধ্বংসের ওপর। ইসরাইল রাষ্ট্রটি যেমন বর্ণবাদী ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি এর জনগণের বিনোদনও নির্ভর করে একই ব্যবস্থার ওপর।
এরা অন্যদের ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজেরা ভোগবিলাসে মত্ত থাকে। আবার দুনিয়ার কাছে নিজেদেরই ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরে। তারা দেখাতে চায়, তারা ভুক্তভোগী বলেই মানসিক শান্তির জন্য এসব আনন্দ উৎসব তাদের দরকার।
আনন্দ উৎসবের জন্য বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার ছিল সানসিটি, আমেরিকার ছিল উডস্টক আর ইসরাইলের আছে গোয়া আর তেল আবিব প্রাইড। কিন্তু অন্যদের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যে আনন্দ গড়ে ওঠে, তা কখনোই প্রকৃত আনন্দ নয়। আর তা টেকেও না।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

গাজা থেকে প্রায় চার হাজার মাইল দূরে, গোয়ার ঘন ম্যানগ্রোভে ঢাকা পাহাড়ে তরুণ ইসরাইলিরা ট্রান্স মিউজিকের তালে তালে নৃত্য করছে। এখানে শিশুর কাফনের পাশে মায়ের আর্তনাদ শোনা যায় না। গণহত্যার কোনো আঁচ এখানে লাগছে না।
আন্দিজের উপত্যকা থেকে শুরু করে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত, একই দৃশ্য দেখা যায়। ইসরাইলিরা একে বলে ‘তারমিলাউত’। সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর একটি আনুষ্ঠানিক প্রমোদভ্রমণ ও আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থা এটি।
২০১৮ সালের এক ইসরাইলি গবেষণায় বলা হয়েছিল, প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব শেষে ভ্রমণে যায়। কয়েক হাজার ডলারের বিনিময়ে ভ্রমণ সংস্থাগুলো এই প্যাকেজ বিক্রি করে। এতে ‘সবকিছু ভুলে মাতাল সময় পার করতে’ পারে সৈন্যরা। এতে থাকে ছাড়মূল্যে বিমান টিকিট, ইহুদি খাদ্য আর পাঁচতারা হোটেল।
নোভা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হত্যাকাণ্ড আর গাজার গণহত্যার দুই বছর পর ইসরাইলিরা এখন ‘মুক্তি’ শব্দটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে। ইসরাইলিরা বিদেশ ভ্রমণে যেতে চায় হা’মাতজাভ থেকে মুক্তি পেতে। যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘পরিস্থিতি’। এই শব্দের মধ্য দিয়ে ওরা গাজায় যা চলছে, তাকে ছোট করে দেখাতে চায়। এদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো মুক্তি নেই। গাজার সমুদ্র, আকাশ আর সব সীমান্ত পথ করে দেওয়া হয়েছে।
যখন ইসরাইলিরা ‘সবকিছু ভুলে মাতাল সময় পার করছে’, তখন ফিলিস্তিনিরা যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাচ্ছে।
একজন ইসরাইলি সৈন্য টানা তিন বছর দখলকৃত পশ্চিমতীরের চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের বুকের ওপর ঝোলানো এম-১৬ রাইফেলের কারণে ধীরে ধীরে তাদের দেহও প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। এই অবস্থার প্রতিকার হিসেবে রাষ্ট্র তাদের হাতে তুলে দেয় একটি ভ্রমণের ব্যাগ আর ওয়ানওয়ে টিকিট। এই প্রমোদভ্রমণ শুধু তাদের কাজের পুরস্কার নয়, তাদের অপরাধকে মাটিচাপা দেওয়ার একটি বন্দোবস্তও বটে। তারা আশা করে এই ভ্রমণ ও আনন্দোৎসব তাদের অপরাধ স্মৃতি ভুলিয়ে দেবে।
এ কারণে তারমিলাউত ইসরাইলে প্রায় বাধ্যতামূলক একটা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র নিজেই তার নাগরিকদের এ কাজে উৎসাহিত করে। তারা যেমন ইউরোভিশন বা ব্র্যান্ড ইসরাইলের মতো অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সৈন্যদের অপরাধবোধ ভুলিয়ে রাখার কাজ করে, এটিও তেমন।
অ্যালডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড উপন্যাসের কথা মনে পড়ে? এতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মাদক ‘সোমা’ শুধু আরাম আর আনন্দের অনুভূতিই তৈরি করত না, এটি ব্যবহারকারীকে তার অপরাধ ভুলতেও সাহায্য করত।
ইসরাইলের ব্যাপারটিও এমন। আর সৈন্যরাও বোঝে, ভোগ বিলাস জিনিসটা নিতান্তই রাজনৈতিক বিষয়। খোদ ইসরাইলের কূটনীতিকরাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিসিম বেন-শিত্রিত বলেছিলেন, ‘আমরা সংস্কৃতিকে দেখি প্রথম শ্রেণির প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে। আমি প্রোপাগান্ডা আর সংস্কৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না।’
তিন বছর পর আরেক ইসরাইলি কূটনীতিক ইদো আহারোনি বলেছিলেনÑ‘ইসরাইলের জন্য আকর্ষণীয় হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সঠিক হওয়া নয়।’
ইসরাইল ‘সংস্কৃতি’ রপ্তানি করে যা অর্জন করতে পারে, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। সংস্কৃতির মাধ্যমে তারা দখলদারিত্বকে লাইফস্টাইলের অংশ হিসেবে তুলে ধরে। এরা প্রমাণ করেছে, সহিংসতা আর স্বাভাবিকতা একই সঙ্গে চলতে পারে, এমনকি মৌজ-মাস্তিও।
এটি একধরনের মুক্তির অনুভূতি দেয়। দেয় ‘নিজেকে হারিয়ে ফেলার’ সুযোগ। সেই সঙ্গে গণহত্যাকে ভুলে যেতেও সহযোগিতা করে। ইসরাইলিদের মানসপটে ফিলিস্তিনিরা তাই শুধু শান্তি বিঘ্নিতকারী উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইসরাইলিরা নিজেদের নিশ্চিন্ত আর উদারপন্থি হিসেবে তুলে ধরে। এর ফলে পশ্চিমারা কোনো অপরাধবোধ ছাড়াই নির্দ্বিধায় এই গণহত্যাকারীদের সঙ্গ উপভোগ করতে পারে। পশ্চিমারা ইসরাইলিদের পরিচয় করিয়ে দেয় ‘আমাদের একজন’ হিসেবে। আর ফিলিস্তিনিরা পশ্চিমাদের মধ্যে হাজির হলে ওদের পার্টি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়।
উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখা সত্যিকার অর্থেই ইসরাইলের একটি জাতীয় প্রকল্প। নিজেকে ভোগবিলাসের তীর্থস্থান হিসেবে তুলে ধরতে বহু দশক ধরে ইসরাইল কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে। ব্র্যান্ড ইসরাইল নামক প্রকল্পের কথাই ধরুন। ২০০৬ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্প ছিল রাষ্ট্র-পরিকল্পিত ব্র্যান্ডিং প্রকল্প। বিকিনি আর সমুদ্রসৈকত ছিল এর অন্যতম অনুষঙ্গ।
এর শুরুটা হয়েছিল ইসরাইলি কূটনীতিক ইদো আহারোনি কর্তৃক একটি টিম গড়ে তোলার মাধ্যমে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পিআর প্রতিষ্ঠান বারসন-মার্স্টেলার। এই প্রতিষ্ঠানটি আর্জেন্টাইন জান্তা আর ভোপাল দুর্ঘটনার পর ইউনিয়ন কার্বাইডকে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য কুখ্যাত ছিল।
আহারোনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, ইসরাইলকে সঠিক প্রমাণ করা নয় বরং আকর্ষণীয় করে তোলাই আসল উদ্দেশ্য। এতে শালীনতার কোনো বালাই ছিল না। ব্র্যান্ড ইসরাইলের প্রথম দিককার কাণ্ডগুলোর একটি ছিল ম্যাক্সিম ম্যাগাজিনে আমেরিকান পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য একটি ফটোশুট। এর শিরোনাম ছিল ‘উইমেন অব দ্য ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস।’ সদ্য ‘মিস ইসরাইল’ খেতাব পাওয়া অভিনেত্রী গ্যাল গাদোত এতে অন্তর্বাস পরে হাজির হয়েছিলেন।
যদি এটি ২০২৫ সালে প্রকাশ পেত, আমরা হয়তো বলতাম, ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম থার্স্ট ট্র্যাপ তৈরি করছে।’ ব্র্যান্ড ইসরাইলের এই প্রজেক্ট পুরানা হয়ে গেলে এরা খোলামেলা পোশাকে নারী প্রদর্শনের বদলে সমকামীদের প্রাইড প্যারেড চালু করল।
২০১১ সালের মধ্যে ইসরাইলি পর্যটন বোর্ড প্রায় ১০ কোটি ডলার ব্যয় করছিল তেল আবিবকে ‘গে ভ্যাকেশন ডেস্টিনেশন’ হিসেবে প্রচার করার জন্য। তারপর থেকে এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের প্রতি মেকি দরদ দেখানো তাদের রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। আজও তেল আবিব ঝলমল আড়ম্বরের ভাবমূর্তি রক্ষা করে চলেছে।
এরা ইসরাইলিদের আকর্ষণীয় আর ফিলিস্তিনিদের পশ্চাৎপদ হিসেবে তুলে ধরে। সেই সঙ্গে এমন ভাব ধরে যেন ইসরাইল কুইয়ার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কাজ করে। এলিয়াস জাহশান লিখেছেন, এগুলো নিছক ঔপনিবেশিক ছলচাতুরী। অধিকার রক্ষার নামে সাতরঙা বোমা। এদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভাজন সৃষ্টি করা।
পার্টি, প্যারেড আর উৎসবগুলোর মুখোশ সরিয়ে ফেললেই বোঝা যায়, ইসরাইল মূলত ভোগ-বিলাসকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছে। এমন নয় যে এসব কৌশল প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্ণবৈষম্যমূলক দক্ষিণ আফ্রিকাও একই কাজ করেছিল। ক্রিকেট খেলা আর সানসিটির বিনোদনের মাধ্যমে শাসকরা তাদের ঔপনিবেশিক নৃশংসতা আড়াল করে রাখত।
এখন গোয়াসহ যেমন অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটের স্থানীয়রা ইসরাইলি ভ্রমণকারীদের নিয়ে অভিযোগ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে পুরো থ্রেড ভরে আছে তাদের উন্নাসিক মনোভাবের সমালোচনায়। তারা বলে, ইসরাইলিরা তাদের আনন্দ উপভোগকেও একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি মনে করে। তারা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গেও পাওনাদারের মতো আচরণ করে।
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। দখল করা পূর্ব জেরুসালেমে শুফাত শরণার্থীশিবিরের পাশে অবৈধ ইসরাইলি বসতি ফ্রেঞ্চ হিলের কাছে থাকাকালে আমি এদের আচরণ দেখেছি। ইসরাইলিরা নিজেদের দখলদারিত্বে নিজেরাই বিরক্ত হয়ে একই কথা বারবার বলতে থাকতÑ‘আমরা কেন শুধু একটু আনন্দ করতে পারি না?’
এদের আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে ইসরাইলি সমাজ আর বিকশিত হতে পারছে না। তারা অন্যদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা শান্তির খোঁজ করে। তাদের আনন্দ নির্ভর করে অন্যদের ধ্বংসের ওপর। ইসরাইল রাষ্ট্রটি যেমন বর্ণবাদী ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি এর জনগণের বিনোদনও নির্ভর করে একই ব্যবস্থার ওপর।
এরা অন্যদের ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজেরা ভোগবিলাসে মত্ত থাকে। আবার দুনিয়ার কাছে নিজেদেরই ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরে। তারা দেখাতে চায়, তারা ভুক্তভোগী বলেই মানসিক শান্তির জন্য এসব আনন্দ উৎসব তাদের দরকার।
আনন্দ উৎসবের জন্য বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার ছিল সানসিটি, আমেরিকার ছিল উডস্টক আর ইসরাইলের আছে গোয়া আর তেল আবিব প্রাইড। কিন্তু অন্যদের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যে আনন্দ গড়ে ওঠে, তা কখনোই প্রকৃত আনন্দ নয়। আর তা টেকেও না।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

রাজশাহীর যে শহর একসময় পদ্মা, বারনই, নবগঙ্গা, বারহী, বড়াল, শিবনদী আর অসংখ্য খাল-বিলের জলধারায় জীবন্ত ছিল, আজ সেখানে কেবল শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ আর বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপ। নদী ছিল এই শহরের প্রাণ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের মূল উৎস।
৪ মিনিট আগে
সাধারণত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা জানেন সময় কত বেশি মূল্যবান। একটি প্রবাদ আছেÑ‘সময় হলো সোনার মতো দামি’। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করেন। আর ইসলামে সময় স্বর্ণ কিংবা বিশ্বের যেকোনো মূল্যবান বস্তুর চেয়ে বেশি দামি। সময়ের মূল্য কী, ইসলাম শুধু তা-ই শেখায় না। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম মানবজাতিকে বিশেষভাবে শেখ
৭ ঘণ্টা আগে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতার পক্ষে ঢোল জোরেশোরেই বাজছে ওয়াশিংটনে। নীতিনির্ধারণী মহলে কেউ কেউ ফিসফিস করে আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিৎকার করে বলছেন গাজায় সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য।
৭ ঘণ্টা আগে
আস্থা সংকটে উদ্যোক্তারা, গতি নেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেÑএই বাস্তবতা এখন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও যখন দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন কারখানা স্থাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা প্রযুক্তি খাতে বড় উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন অর্থনীতির মধ্যে প্রাণচাঞ্চ
৭ ঘণ্টা আগে